নিজস্ব প্রতিবেদক :
উন্নত জীবনের আশায় যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে দেশে ফেরত আসতে হচ্ছে বাংলাদেশিদের। অবৈধভাবে অবস্থানের অভিযোগে দেশটি থেকে এ দফায় ৩০ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে ১১টার দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাদের বহনকারী ফ্লাইট অবতরণ করে। ফেরত আসা অভিবাসীদের মধ্যে ২৯ জন পুরুষ ও একজন নারী রয়েছেন।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার প্রত্যক্ষদর্শী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাত ১১টার পরপর বিমানটি নামলেও তিন ঘণ্টা সেটি রানওয়েতে ছিল। এ ৩ ঘণ্টায় তাদের হাতকড়া ও শেকল খোলা হয়। বিমান বন্দরের অ্যারাইভাল এরিয়াতে পৌঁছানোর আগেই সবাইকে শেকলমুক্ত করে দেওয়া হয়। পরে রাত ২টার দিকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যদিয়ে তাদের বিমানবন্দরে আনা হয়। এসময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ টিম, কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ টিম এবং যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের পক্ষ থেকে তাদের বাড়ি পৌঁছানোর জন্য অর্থ সহায়তা দেওয়া হয় বলে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দীর্ঘযাত্রা ও শেকল পরে থাকায় আগতরা ছিলেন বিধ্বস্ত। ওই সময় নোয়াখালীর ২২ বছর বয়সী আব্দুল্লাহ্ বিমানবন্দরে হতাশা প্রকাশ করে বলতে থাকেন, এ লম্বা যাত্রায় পুরোটা সময় হাতে পায়ে আসামিদের মতো শেকল পরিয়ে রেখেছিল, একে তো দেশে ফেরত আসার হতাশা তার ওপরে টেরোরিস্টের মতো হাতেপায়ে শেকল পরিয়ে মাতৃভূমিতে আসার ভয়াবহ পরিস্থিতি আর কারো না হোক।
ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর অভিযান আরও জোরদার করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় কয়েক দফায় বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে। গত কয়েক মাসে অন্তত ১৮০ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানোর তথ্য জানা গেছে।
প্রথম দিকে হাতকড়া ও শেকল না পরানো হলেও ২ আগস্ট একটি সামরিক পরিবহন উড়োজাহাজ সি-১৭ করে এক নারীসহ ৩৯ বাংলাদেশিকে দেশে পাঠানো হয়। তাদের সবার হাতকড়া ও শেকল ছিল। বৃহস্পতিবারও সবার হাতে হাতকড়া ও শেকল ছিল।
ফেরত আসা ব্যক্তিরা জানান, প্রায় ৬০ ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রায় তাদের হাতকড়া ও শেকলে বেঁধে রাখা হয়েছিল। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যন্ত্রণা নিয়ে বসে থাকতে হয়েছে। খেতে দেওয়া হয়েছে শুধু রুটি আর পানি। এমনকি টয়লেটে যাওয়ার সময়ও একজন অফিসার নিয়ে যেতেন, আবার শেকলে বেঁধে দিতেন।
পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ ও এইচএসআইএ’র ইমিগ্রেশন বিভাগের সূত্র বলছে, চলতি বছরের ৮ জুন একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে ৪২ বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনা হয়।
এর আগে ৬ মার্চ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত একাধিক ফ্লাইটে আরও অন্তত ৩৪ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। ২০২৪ সালের শুরু থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো বাংলাদেশির সংখ্যা ১৮০ ছাড়িয়েছে।
মার্কিন আইন অনুযায়ী বৈধ কাগজপত্র ছাড়া অবস্থানকারী অভিবাসীদের আদালতের রায় বা প্রশাসনিক আদেশে দেশে ফেরত পাঠানো যায়। আশ্রয়ের আবেদন ব্যর্থ হলে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই) তাদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করে। সাম্প্রতিক সময়ে এ প্রক্রিয়া দ্রুততর করার কারণে চার্টার্ড ও সামরিক ফ্লাইটের ব্যবহার বেড়েছে। বেশির ভাগ অভিবাসী মেক্সিকো বা লাতিন আমেরিকার দেশ বা অন্য কোনো পন্থায় ৩০ থেকে ৭৫ লাখ টাকা খরচ করে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছিলেন।
গতকালও ফিরে আসা কর্মীদের বড় একটি অংশ জানিয়েছিল তারা মানবপাচার চক্রের মাধ্যমে মেক্সিকোতে মাফিয়াদের কাছে আটক হয়। অন্তত ৬ জন জানিয়েছে তাদের জিম্মি করে, অত্যাচার করে পরিবারের থেকে ৪০-৫০ লাখ টাকা করে আদায় করে।
মুন্সিগঞ্জের তানজিল হাসান বলেন, তিনিসহ অনেকেই এ মানবপাচার চক্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আইনগত ব্যবস্থা নিতে চান। তাদের কারও কাছ থেকে ৭৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে এ চক্র। তারা তাদের সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে মানবপাচারকারী চক্রকে এ টাকা দিতে বাধ্য হয়। তিনি আরো বলেন এমন অগণিত বাংলাদেশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের মাধ্যমে অপহরণ অবস্থায় আছেন।
২০১৬ সালে ২৭ বাংলাদেশিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে। তারা বিশেষ ফ্লাইটে এসেছিলেন, আর যাত্রাপথে হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়েছিল। এ দৃশ্য তখন দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। এভাবে শেকল পরানোয় মানবাধিকার ও মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তখন, যা নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ও মার্কিন প্রশাসনের মধ্যে আলোচনাও হয়েছিল।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রত্যাবাসনের সময় হাতকড়া ও শেকল ব্যবহার পরানো উচিত নয়। সাধারণ অভিবাসীদের হাতকড়া বা শেকল পরিয়ে ফেরত পাঠানোটা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের পরিপন্থি।
অভিবাসীদের এভাবে হাতকড়া বা শেকল পরিয়ে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) শরিফুল হাসান বলেন, উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে মানুষ বিদেশে যেতে চায়। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় অনেক সময় পাচারের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে ল্যাটিন আমেরিকা বা মেক্সিকো হয়ে ৩০-৪০ লাখ টাকা নিয়ে লোকজনকে অবৈধ পথে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়।
নথি ঠিক না থাকলে গন্তব্য দেশ চাইলে তাদের ফিরিয়েও দিতে পারে। তবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাতকড়া পরিয়ে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এটি অভিবাসনপ্রত্যাশী মানুষের জন্য সারা জীবনের ট্রমা হয়ে থাকে। আমরা আশা করি, আগামীতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরও মানবিক হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে গুরুত্ব দেবে।
অভিবাসীদের এভাবে হাতকড়া বা শেকল পরিয়ে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) শরিফুল হাসান জাগোনিউজকে বলেন, উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে মানুষ বিদেশে যেতে চায়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় অনেক সময় পাচারের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে ল্যাটিন আমেরিকা বা মেক্সিকো হয়ে ৩০-৪০ লাখ টাকা নিয়ে লোকজনকে অবৈধ পথে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। নথি ঠিক না থাকলে গন্তব্য দেশ চাইলে তাদের ফিরিয়েও দিতে পারে।
তবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাতকড়া পরিয়ে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এটি একজন মানুষের জন্য সারা জীবনের ট্রমা হয়ে থাকে। আমরা আশা করি, আগামীতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরও মানবিক হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে গুরুত্ব দেবে,’ বলেন তিনি।