নিজস্ব প্রতিবেদক :
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ভারত যদি বাংলাদেশের স্বৈরাচারী সরকারকে আশ্রয় দিয়ে দেশের মানুষের বিরাগভাজন হয়ে পড়ে, তাতে বিএনপির কিছুই করার নেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণই ইতিমধ্যে সেই সম্পর্ক নিয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে, আর তিনি থাকবেন দেশের মানুষের পক্ষেই।
বিবিসি বাংলার তরফে প্রশ্ন ছিল, একটা বিষয় যদি বলি, পাঁচই আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এবং আপনিও জানেন যে, শেখ হাসিনা দিল্লিতে গেছেন এবং সেখানে আছেন। ভারতের সঙ্গে একটা সম্পর্কের শীতলতা দেখা গেছে, গত এক বছর ধরে। যেমন ধরুন সেটি যাওয়া আসার ক্ষেত্রে ব্যবসার ক্ষেত্রে নানা রকম, সেই ক্ষেত্রে কী কোন পরিবর্তন আপনার সরকারে আসলে হবে বা পরিবর্তনের ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন, এমন কোন চিন্তা কি আপনাদের আছে?
তারেক রহমান বলেন, এখন তারা যদি স্বৈরাচারকে সেখানে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের বিরাগভাজন হয়, সেখানে তো আমাদের কিছু করার নেই। এটা বাংলাদেশের মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তাদের সঙ্গে শীতল থাকবে। সো, আমাকে আমার দেশের মানুষের সঙ্গেই থাকতে হবে।
বিবিসি বাংলার প্রশ্ন ছিল বিগত সরকারের সময় বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে যেই সম্পর্ক ছিল, সেটা নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে। তো ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে আপনাদের নীতি কী হবে?
তারেক রহমান বলেন, আমার মনে হয়, আপনি একটু আগে যে প্রশ্নগুলো করেছেন, সেখানে বোধহয় আমি ক্লিয়ার করেছি পুরো ব্যাপারটা। সবার আগে বাংলাদেশ। এখানে তো আপনি পার্টিকুলার (সুনির্দিষ্ট) একটি দেশের কথা বলেছেন। এখানে ওই দেশ বা অন্য দেশ তো বিষয় না। বিষয় তো হচ্ছে, ভাই বাংলাদেশ আমার কাছে আমার স্বার্থ, আমি আগে আমার দেশের মানুষের স্বার্থ দেখবো, আমার দেশের স্বার্থ দেখবো। ওটাকে আমি রেখে আপহোল্ড করে আমি যা যা করতে পারবো, আমি তাই করবো।
বিবিসি বাংলা আরও প্রশ্ন ছিল, বাংলাদেশের স্বার্থ আপনারা সবার আগে নেবেন, সেটা আপনি পরিষ্কার করেছেন। ভারতের কথা বিশেষভাবে আসছে যেহেতু সেটি বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ এবং বাংলাদেশের তিন পাশেই এই দেশটির সীমান্ত রয়েছে। এবং এটি নিয়ে আপনিও জানেন যে, বিভিন্ন সময়ে কথা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও কথা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সময় তো সম্পর্ক নিয়ে বললামই সেটা নিয়ে কথা হয়েছে। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত বা কেমন থাকা প্রয়োজন- এ নিয়ে আপনার চিন্তা কি?
তারেক রহমান বলেন, অবশ্যই আমি আমার পানির হিস্যা চাই। অবশ্যই আমি দেখতে চাইনা না যে, আরেক ফেলানী ঝুলে আছে। অবশ্যই আমরা এটা মেনে নেবো না।
বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে তারেক রহমানের কাছে প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশের স্বার্থের প্রসঙ্গে আপনি বলছেন যে, পানির হিস্যা চাওয়া এবং সীমান্ত হত্যার বিষয়টি নিয়ে আপনারা সোচ্চার থাকবেন?
তারেক রহমান এই প্রশ্নের জবাবে বলেন, না না, আমি উদাহরণ দিয়ে বললাম। দুটো উদাহরণ দিয়ে বুঝালাম আপনাকে, যে আমাদের স্ট্যান্ডটা কি হবে। আমরা আমাদের পানির হিস্যা চাই। অর্থাৎ আমার দেশের হিস্যা, মানুষের হিস্যা আমি চাই, হিসাব আমি চাই। আমার যেটা ন্যায্য সেটা আমি চাই। অবশ্যই ফেলানী হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে আমি বুঝাতে চেয়েছি যে, আমার মানুষের উপরে আঘাত আসলে অবশ্যই সেই আঘাতকে এভাবে আমি মেনে নেবো না।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিবিসি বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সংস্কার, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এবং রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। প্রায় দুই দশক পর প্রথম কোনো গণমাধ্যম হিসেবে বিবিসি বাংলার মুখোমুখি হয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি।
বিবিসি বাংলা জানতে চেয়েছিল, সংস্কারের কিছু বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলের কিছুটা মতপার্থক্য বা মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে। যেমন- এক ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা বা দলের প্রধান থাকতে পারবেন না, এরকম একটা প্রস্তাব এসেছে, যাতে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। এক ব্যক্তি একইসঙ্গে তিন পদে থাকলে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা তৈরির সুযোগ থাকে কি না?
উত্তরে তারেক রহমান বলেন, সকলের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, এই যে বাংলাদেশে রাষ্ট্র মেরামতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার প্রয়োজন। একজন ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না, থাকবেন না। এরকম আরো যে বিষয়গুলো আছে, এগুলো বাংলাদেশে যখন স্বৈরাচার ছিল- তাদের মুখের উপরে, তাদের চোখের দিকে চোখ রেখে আমরা বিএনপিই বলেছিলাম।এখন হয়তো অনেকে সংস্কারের কথা বলছেন। সেদিন কিন্তু সংস্কারের ‘স’-ও তারা বলেননি। তার পরেও সকলের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে আমি বলতে চাই যে, বিএনপি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিলে সেটি সমস্যা, অর্থাৎ বিএনপিকে এগ্রি (সম্মত) করতে হবে সবার সাথে, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু বিএনপি যদি কোনোটার সাথে একমত না হয়, তাহলে বেঠিক। এটি তো গণতন্ত্র হলো না। মানে, আমাকে অন্যের সাথে একমত হতে হবে, তাহলে গণতন্ত্র। আমি যদি অন্যের সাথে দ্বিমত করি, তাহলে গণতন্ত্র না। এটি কেমন গণতন্ত্র? কারণ গণতন্ত্রের মানেই তো হচ্ছে, বিভিন্ন মতামত থাকবে। আমরা অনেক ব্যাপারেই একমত হব হয়তো। সকল ব্যাপারে একমত হবো না, কিছু ব্যাপারে হয়তো দ্বিমত থাকতেই পারে, এটাই তো গণতন্ত্র, এটাই তো এসেন্স অব গণতন্ত্র।
তিনি বলেন, আমরা তো কোনো হাইড অ্যান্ড সিক করছি না। আমি যেটা মনে করছি যে ভাই আমি মনে করছি যেটা আমার দৃষ্টিতে ঠিক না, আমি বলছি ঠিক না।
এরপর বিবিসি বাংলার প্রশ্ন ছিল, বিএনপির ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবে রাষ্ট্রপতি- প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনার কথা বলা হয়েছে। তাহলে এসব বিষয়ে আপত্তি কেন?
জবাবে তারেক রহমান বলেন, আমরা যেটাতে বলেছিলাম, আমরা সেখানে এখনো আছি। যতটুকু ভারসাম্য হওয়া উচিত, যে যে বিষয়ে যতটুকু বিবেচনা করা উচিত, আমরা সে বিষয়ের মধ্যে এখনো কমবেশি আছি। আমাদের অবস্থান থেকে তো আমরা অবস্থান পরিবর্তন করিনি।
তারেক রহমানকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে বা সরকার গঠন করে, তখন ৩১ দফা নাকি জুলাই সনদ—কোনটা অগ্রাধিকার পাবে?
জবাবে বিএনপি নেতা বলেন, আমরা যেগুলোতে একমত হয়েছি, প্রথমে আমরা সেগুলোর উপরেই জোর দেব। সেটা আপনি যে নামেই বলেন না কেন, স্বাভাবিকভাবে আমরা ঐকমত্য কমিশনে যেগুলোতে সকলে মিলে একমত হয়েছি, আমরা প্রথমে সেগুলোতে ইনশাআল্লাহ সরকার গঠনের সুযোগ পেলে প্রথমে সেগুলোতেই অবশ্যই জোর দেব। আর, তারপরে আপনি যেটা ৩১ দফার কথা বললেন, অবশ্যই ৩১ দফা আমাদের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট জনগণের প্রতি। আমরা তো আমাদের ৩১ দফার মধ্যে যেগুলোর এটার সাথে মিলে গিয়েছে, সেগুলো তো আমরা করবই। এর বাইরে যেগুলো থাকবে ৩১ দফায় আছে, সেগুলোও বাস্তবায়ন করবো। কারণ ওটা তো আমাদের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট। এটাও যেমন পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট, ওটাও আমাদের পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট। এটা আমরা রাজনৈতিক দলগুলো মিলে একত্রিত হয়ে বলেছি। ওটাও আমরা অনেকগুলো রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়েই কিন্তু ৩১ দফা দিয়েছি।
বিবিসি বাংলা জানতে চেয়েছিল, এক এগারোর সরকার বা সেনা সমর্থিত সরকারের সময় নিয়ে রাজনীতিতে অনেক আলোচনা আছে। সেই সময় ঘিরে আপনার মূল্যায়ন কী?
উত্তরে তারেক রহমান বলেন, এক বাক্যে বা সংক্ষেপে যদি বলতে হয়, এক এগারোর সরকার তো একটি উদ্দেশ্য প্রণোদিত, অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত একটি সরকার ছিল। আমরা দেখেছি সেই সরকার আসলে কীভাবে দেশের যতটুকু যেমনই হোক বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে যতটুকুই রাজনীতি গড়ে উঠেছিল, গণতান্ত্রিক ভিত্তি ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল ভুল- ত্রুটি সবকিছুর ভিতর দিয়েই। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, কিভাবে তারা সবকিছু ভেঙে গুড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, বিরাজনীতিকরণ করতে চেয়েছিল। দেশকে একটি অন্ধকার দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। পরবর্তীতে দেখেছি যে, খুব সম্ভবত তাদেরই ভিন্ন আরেকটি রূপ; অন্যভাবে দেখেছি আমরা ‘ইন দি নেম অফ ডেমোক্রেসি’।
বিবিসি বাংলা জানতে চেয়েছিল, গত দুই দশকে বিএনপির রাজনীতির কতটা পরিবর্তন হয়েছে, ভবিষ্যৎ বিএনপি কেমন হবে?
উত্তরে দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতা তারেক বলেন, আমাদের রাজনীতির মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হচ্ছে, জনগণ, দেশ ও দেশের সার্বভৌমত্ব। আমরা দুটো বিষয় নিয়ে বাংলাদেশে খুবই গর্ব করি, অহংকার করি, একটি হচ্ছে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প, আরেকটি হচ্ছে প্রবাসীরা দিন-রাত পরিশ্রম করে যে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান- এই দুটোই কিন্তু বিএনপি শুরু করেছিল। আমরা দেখেছি, বিএনপির সময় শুরু হয়েছিল প্রবাসীদের বিদেশ যাওয়া, একই সাথে গার্মেন্ট শিল্পের প্রসার। এর বাইরেও যদি আমরা দেখি, ১৯৭৪ সালে যে দুর্ভিক্ষটা হয়েছিল, পরবর্তীতে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলেন, আমরা দেখেছি কিভাবে ধীরে ধীরে দুর্ভিক্ষ পীড়িত একটি দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসপূর্ণ করে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণ না, অল্প পরিমাণ করে হলেও আমরা কিন্তু সেই সময় বিদেশে খাদ্য রপ্তানি, চাল রপ্তানি করেছিলাম। আর রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা দেখি, যেখানে একসময় সকল দলকে নিষিদ্ধ করে একটি দল বাকশাল করা হয়েছিল। আমরা দেখেছি যে, বিএনপির কাঁধে যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে, তখন কীভাবে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চালু আবার করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, কাজেই আপনি বললেন অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ইয়েস, আমরা অতীতে এই ভালো কাজগুলো করেছি। ভবিষ্যতে ইনশাআল্লাহ এই বিষয়গুলো কনসিডারেশন (বিবেচনায়) রেখেই আমরা সামনে এগিয়ে যাব। আমাদের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে, ভবিষ্যৎ বিএনপির গণতন্ত্রের যে বুনিয়াদ, একটি শক্তিশালী বুনিয়াদ তৈরি করা। জবাবদিহিতা তৈরি করা।”
তারেক রহমানের কাছে প্রশ্ন ছিল, দেড় যুগ ধরে আপনি নির্বাসনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। নেতৃত্ব নিয়ে আপনার চিন্তাধারায় কি ধরনের পরিবর্তন এসেছে?
উত্তরে তিনি বলেন, গত ১৭ বছর প্রবাস জীবনে আছি এবং অনেকগুলো বছর আমি বাংলাদেশের সাথে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা টাইম ডিফারেন্স, ডিস্টেন্স ডিফারেন্স তো আছেই। রিচিং ডিফারেন্স তো একটা ডিফিকাল্টিস তো আছেই। এটি একটি বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এক্ষেত্রে প্রথমেই আমি আমার পরিবার অর্থাৎ আমার স্ত্রী এবং আমার সন্তানকে এখানে ধন্যবাদ দিতে চাই। কারণ তাদের সহযোগিতা না থাকলে হয়তো এই ডিফিকাল্ট কাজটি করা আমার জন্য আরো ডিফিকাল্ট হতো। ওনাদের সহযোগিতা ছিল সেজন্য আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। একই সাথে আমি আবারো ধন্যবাদ দিতে চাই আমার হাজারো- লক্ষ নেতাকর্মীকে। যারা এই ডিফিকাল্টিজের মধ্যে থেকেও আমাকে সহযোগিতা করেছেন, দলকে সুসংগঠিত রাখতে, দলকে রাজপথে নিয়ে যেতে শত অত্যাচার বাধাবিঘ্নর মাঝেও জনগণের কথা তুলে ধরতে, জনগণের দাবির ব্যাপারে সোচ্চার থাকতে।
তারেক রহমান বলেন, আপনি জিজ্ঞেস করেছেন মনে হয় যে, এখান (যুক্তরাজ্য) থেকে কী কী দেখেছি, শিখেছি বা জেনেছি- আমি মনে করি যে, এই দেশ থেকে ভালো যা কিছু দেখেছি বা শিখেছি, দেশের নাগরিক হিসেবে এবং যেহেতু আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী হয়তো আমার একটি সুযোগ আছে দেশের জন্য ভালো কিছু করার। যদি আমি ইনশাআল্লাহ সেই সুযোগটি পাই, তাহলে সেই সুযোগটিকে যতটুকু সম্ভব দেশের মানুষের জন্য বা দেশের জন্য কিছু করার, এভাবে বিষয়টিকে আমি বিবেচনা করি।
বিবিসি বাংলা জানতে চেয়েছিল, বিগত সরকারের আমলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ছিল। বিএনপি ক্ষমতায় এলে এমন পরিস্থিতি হবে না, তার নিশ্চয়তা কি দিতে পারেন?
উত্তরে তারেক বলেন, জ্বি, ইয়েস পারি। একদম দিতে পারি। আপনি ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত পত্রপত্রিকা খুলুন। আমি কারো নাম উল্লেখ করবো না, কোনো পত্রিকার কথা উল্লেখ করবো না। শুধু খুলে দেখুন কিভাবে অনেক খবর ছাপা হয়েছিল। যার সত্যতা কিন্তু ছিল না, অপপ্রচার ছিল। কিন্তু অপপ্রচারটা সংবাদ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আপনি কি শুনেছেন, আপনি কি আমাকে প্রমাণ দিতে পারবেন- বলতে পারবেন যে বিএনপির সময়, আমি কিন্তু বলতে পারবো অনেক অনেক সাংবাদিকের নাম যারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন স্বৈরাচারের সময় এবং পরবর্তীতে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ইভেন, এখনো অনেকে প্রবাস জীবনে আছেন, এরকম বহু সাংবাদিক।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, আমি বলতে পারব, স্বৈরাচারের সময় বহু সাংবাদিককে বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন করে বিভিন্ন রকম ভয়ভীতি প্রদর্শন-ধমক দেওয়া হতো। বিএনপির সময় এগুলো করা হয়নি, কারণ তখন সংবাদপত্রে যে খবরগুলো প্রকাশিত হয়েছে তৎকালীন বিএনপি সরকার সম্পর্কে, আমার সম্পর্কে যে খবরগুলো প্রকাশিত হয়েছে, যদি ওইরকম হতো তাহলে কিন্তু ওরকম খবর প্রকাশিত হতো না।
তিনি বলেন, অর্থাৎ বিএনপির সময় যদি অত্যাচার- নির্যাতন থাকতো, তাহলে খবরগুলো প্রকাশিত হতো না স্বাভাবিকভাবে। যা হয়নি বিগত সরকারের সময় স্বৈরাচার সরকারের সময়। কাজেই আপনাকে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, বিএনপির অতীত সরকারের সময় যেরকম সাংবাদিকদের গুম করা হয়নি। সাংবাদিকদেরকে নির্যাতন করা হয়নি। সাংবাদিকদেরকে দেশ ছেড়ে যেতে হয়নি, বাধ্য হতে হয়নি। ইনশআল্লাহ ভবিষ্যতেও হবে না।”
বিবিসি বাংলা এবার প্রশ্ন রাখে, তাহলে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতার সীমাবদ্ধ করে- এ ধরনের আইন কি বিএনপি বাতিল করবে?
উত্তরে তারেক রহমান বলেন, অবশ্যই, আমরা সকলে মিলে বসবো, আলোচনা করব। আপনাদের মত সাংবাদিকসহ যারা আছেন, তাদের সাথে আলোচনা করব। আলোচনা করে সেগুলোকে আমরা এরকম কালো আইন যা যা আছে, আমরা আস্তে আস্তে ঠিক করব। তবে এখানে বোধহয় একটি বিষয় আবার আমাকে উল্লেখ করতে হয়- যেটি আমি সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে বলেছি। দেখুন, এটি তো সবাইকে মিলে করতে হবে। অপপ্রচারকে তো অবশ্যই সংবাদ হিসেবে তো প্রচার করা ঠিক নয়, তাই না? আমাদের কাছে আপনাদের যেরকম চাওয়া থাকবে, ভবিষ্যৎ সরকারের কাছে, যারাই আসুক সরকারে, রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমাদেরও অনুরোধ থাকবে আপনাদের প্রতি, যে অপপ্রচার সংবাদ হিসেবে যেন প্রচারিত না হয়, এই বিষয়টিকে একটু সকলকে সচেতন বা খেয়াল রাখতে হবে।
তারেক রহমানের কাছে বিবিসি বাংলা জানতে চেয়েছিল, আপনাকে নিয়ে অনেক মিম তৈরি হয়, অনেক কার্টুন হয়। যেমন জুমে আপনার বক্তব্য দেওয়া বা ওয়ার্ক ফ্রম হোম নিয়ে একটা মিম অনেক শেয়ার হয়েছিল। এ ধরনের মিমকে আপনি কিভাবে দেখেন?
তারেকের ঝটপট উত্তর, আমি এনজয় করি বেশ, বেশ আমি এনজয় করি।
জানতে চাওয়া হয়, আপনি দেখেন এগুলো? আপনার চোখে পড়ে?
বিএনপি নেতা বলেন, হ্যাঁ, চোখে পড়বে না কেন অবশ্যই চোখে পড়ে। তবে এখানে একটি কথা আছে, যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়ার বিষয়টি আসলো আমার মনে হয়, এই বিষয়ে একটু এড করা উচিত। দেখুন সোশ্যাল মিডিয়া এমন একটি বিষয় আমি নিজেও আছি সোশ্যাল মিডিয়াতে কমবেশি। বহু বহু মানুষ আছেন, লক্ষ কোটি মানুষ আছেন সোশ্যাল মিডিয়াতে। এটি দিয়ে যেমন খুব দ্রুত একজনের সাথে আরেকজনের যোগাযোগ করা যায়। আমরা মাঝে মাঝে বলি যে, দেখেন অনেক সময় অনেক আলোচনায় আসে, সেমিনার বক্তব্যে আসে যে, ডিনামাইটটা যখন আবিষ্কৃত হয়, ডিনামাইটটা আবিষ্কৃত হয়েছিল আপনার পাহাড় ভেঙে কীভাবে মানুষের চলাচলের জন্য রাস্তাঘাট তৈরি করা যায়; হয়তো কিভাবে চাষের জমি করা যায়। এরকম লক্ষ্যকে সামনে রেখেই, উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই কমবেশি ডিনামাইটের ব্যবহারটা শুরু হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা দেখেছি, এটি মানুষ হত্যার মত জঘন্য কাজেও ব্যবহার করা হয়েছে।
তারেক রহমান বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে আমি বলতে চাই যে, অবশ্যই প্রত্যেকটি মানুষের অধিকার আছে। যেহেতু আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। মানুষের বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতায় আমরা বিশ্বাস করি। প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে, তার মতামত প্রকাশ করার। তবে আমরা যদি সকলে এতটুকু সচেতন হই যে, আমি আমার মত প্রকাশ করলাম, কিন্তু এই মত প্রকাশের ফলে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলো কি-না? এই বিষয়টিকে যদি আমরা বিবেচনায় রাখি, একটি মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হলো কি-না, ক্ষতিগ্রস্ত হলো কিনা? এই বিষয়টিকে বোধহয় আমাদের বিবেচনায় রাখা উচিত; এটি এক নম্বর। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়ার বহুল ব্যবহারের ফলে ডিসইনফরমেশন বা মিসইনফরমেশন এই বিষয়টিও চলে এসেছে সামনে। এ কথাটিও চলে এসেছে। একটি জিনিস আমি দেখলাম বা শুনলাম, সাথে সাথেই আমি সেটিতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম- তা না করে আমার মনে হয়, ফ্যাক্ট চেক বলে যেই কথাটি আছে সোশ্যাল মিডিয়াতে, এটা সব জায়গায় আছে- এ ব্যাপারেও যদি আমরা একটু এলার্ট থাকি সবাই, এ ব্যাপারে যদি একটু সচেতন থাকি যে ঠিক আছে, এটি একটু যাচাই বাচাই করে নেই।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, যদি সত্য হয় অবশ্যই আমার সেখানে মতামত থাকবে, কিন্তু যদি মিথ্যা হয় বিষয়টি, কেন আমি এখানে মতামত দিব। একটি মিথ্যার সাথে আমি কেন নিজেকে সংশ্লিষ্ট করব। একটি খারাপ কিছুর সাথে কেন আমি নিজেকে সংশ্লিষ্ট করব। এটি আমি আমার মতামতটা প্রকাশ করলাম।
বিবিসি বাংলা জানতে চেয়েছিল, আপনাকে সম্প্রতি প্রাণী অধিকার রক্ষা নিয়ে বেশ সোচ্চার দেখা গেছে। আপনার পোষা বিড়ালের সঙ্গে আপনার নিয়মিত ছবি দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তো এটি আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কীভাবে?
উত্তরে তারেক রহমান বলেন, প্রথমত এখানে একটু ক্লিয়ার করে নিই, বিড়ালটি আমার মেয়ের বিড়াল। ও এখন অবশ্য সবারই হয়ে গিয়েছে। আমরা সবাই ওকে আদর করি। বিষয়টি হচ্ছে, এরকম শুধু বিড়াল নয়, আমি এবং আমার ভাই যখন ছোট ছিলাম আমাদের একটি ছোট কুকুরও ছিল। ইভেন, তখন আমাদের বাসায় আম্মা হাঁস মুরগি পালতেন, ছাগলও ছিল আমাদের বাসায়। উনি ছাগলও কয়েকটি পালতেন। তো স্বাভাবিকভাবেই আপনি যেই দৃষ্টিকোণ থেকেই বলেন, পোষা কুকুর বিড়ালই বলেন, বাই দা ওয়ে কবুতরও ছিল আমাদের বাসায়। শুধু কবুতর না, আমাদের বাসায় একটি বিরাট বড় একটি খাঁচা ছিল। সেই খাঁচার মধ্যে কিন্তু পাখি ছিল, বিভিন্ন রকমের এবং আবার আরেকটি খাঁচা ছিল যেটার মধ্যে একটা ময়না ছিল।
তিনি বলেন, ময়নাটা আমরা বরিশাল থেকে এনেছিলাম। ও আবার বরিশালি ভাষায় কথাও বলতো। টুকটুক করে মাঝে মাঝে কিছু কিছু কথাও বলতো। তো কাজেই এই বিষয়টি হঠাৎ করেই না। এই পশুপাখির প্রতি যেই বিষয়টি, এটির সাথে আমি কমবেশি ছোটবেলা থেকে জড়িত আছি। হয়তো এটি এখন প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্নভাবে। বাট এটির সাথে আমি বা আমার পরিবার, আমরা অনেক আগে থেকেই আছি। কুকুর- বিড়াল ছিল, গরু- ছাগল ছিল, হাঁস মুরগি ছিল, পাখি ছিল, ময়না ছিল, কবুতর ছিল। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা চিন্তা করি, আমাদেরকে আল্লাহ সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তৈরি করেছেন। আমাদের দায়িত্ব কিন্তু আল্লাহর সৃষ্টি যা কিছু আছে প্রকৃতির, তার প্রতি কিন্তু যত্ন নেওয়া আমাদের দায়িত্ব। এটি একটি বিষয়। আর আমরা যদি মানবিক দৃষ্টিকোণ অথবা আমরা যদি নেচার থেকেও বিষয়টি দেখি, দেখুন ওরা না থাকলে কিন্তু আমাদের জন্য বেঁচে থাকা কষ্টকর। প্রকৃতি যদি না থাকে, প্রকৃতির ব্যালেন্স যদি না থাকে।
চলতি বছরের জুনের মাঝামাঝি সময়ে লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎ হয়। তারা সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে দীর্ঘ সময় কথা বলেন। তবে তাদের মধ্যে কী আলোচনা হয়েছে, সে বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো চিত্র গণমাধ্যমে আসেনি।
জবাবে তারেক রহমান বলেন, ‘উনি একজন স্বনামধন্য মানুষ। অত্যন্ত বিজ্ঞ মানুষ উনি। তার সঙ্গে সৌজন্যমূলক কথাবার্তা হয়েছে। উনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, জনগণ যদি আপনাদের সুযোগ দেয় তাহলে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য-এই বিষয়গুলো আলোচনা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশের মানুষ, জনগণ এবং দেশকে নিয়ে আমার কিছু চিন্তাভাবনা, আমরা দেশের মানুষের জন্য কী করতে চাই সে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’
তারেক রহমান বলেন, ভবিষ্যতের বিএনপি হবে গণতন্ত্রের শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো একটি জবাবদিহিতামূলক রাজনৈতিক দল।
তিনি বলেন, আমাদের রাজনীতির মূল লক্ষ্য—জনগণ, দেশ ও দেশের সার্বভৌমত্ব। অতীতের ভালো কাজগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী গণতান্ত্রিক বুনিয়াদ গড়তে চাই।
তারেক রহমান আরও বলেন, আমরা গর্ব করি যে, বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প ও প্রবাসীদের প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রা—এই দুটো ক্ষেত্রই বিএনপির শাসনামলেই শুরু হয়েছিল। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশকে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছিলাম। এমনকি সেই সময় বাংলাদেশ বিদেশে খাদ্য রপ্তানিও করেছিল।
তিনি বলেন, যখন দেশে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সব দল নিষিদ্ধ ছিল, তখন বিএনপির হাত ধরেই বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরেছিল। সেই ইতিহাস আমাদের অনুপ্রেরণা।
রাজনীতিতে জবাবদিহিতা নিয়ে প্রশ্নে তারেক রহমান বলেন, অভিযোগ থাকতেই পারে। অভিযোগকে আমরা বিবেচনায় রাখব। তবে সুযোগ পেলে প্রমাণ করব, জবাবদিহিতা কেমন হওয়া উচিত। এটা একদিনে সম্ভব নয়, ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
তিনি বলেন, দেশ গঠনের কাজে শুধু রাজনীতিক নয়, নাগরিকরাও অংশীদার। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি—আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে।
প্রবাসজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, গত ১৭ বছর আমি বিদেশে আছি। পরিবারের সহযোগিতা ছাড়া এই দূরত্ব থেকে নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব হতো না। আমার স্ত্রী ও সন্তানকে ধন্যবাদ জানাই, কারণ তাদের সহায়তা না থাকলে এই কঠিন কাজ আরও কঠিন হতো।
তারেক রহমান আরও বলেন, নানা বাধা-বিপত্তি, দমন-পীড়নের মধ্যেও যারা দলকে সুসংগঠিত রেখেছেন, রাজপথে সক্রিয় থেকেছেন, জনগণের দাবির পক্ষে সোচ্চার ছিলেন—আমি তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞ। যুক্তরাজ্যে থেকে ভালো যা কিছু দেখেছি বা শিখেছি, সুযোগ পেলে সেই অভিজ্ঞতা দেশের মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাতে চাই।