নিজস্ব প্রতিবেদক :
নতুন বাজেট উত্তাপ ছড়াচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের পর ইতিমধ্যেই বাড়তে শুরু করেছে মাছ-মাংস, ডিম, সবজিসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম। ফলে বেশ বিপাকে পড়তে হচ্ছে সাধারণ ক্রেতাদের।
সবজির বাজার চড়া; সেই সঙ্গে মাছ, গরু ও মুরগির মাংসের বাজারেও কোনো সুখবর নেই। গত সপ্তাহে ব্রয়লার মুরগির দাম কিছুটা কমে প্রতিকেজি বিক্রি হয়েছিল ১৯০-২০০ টাকায়। তবে নতুন করে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ১০-১৫ টাকা বেড়ে বর্তমানে প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ২১০-২২০ টাকায়।
অন্যদিকে কক মুরগি, সোনালি মুরগি, গরুর মাংস, খাসির মাংসসহ সব ধরনের মাছের দাম আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে। তবে নতুন করে এসব পণ্যের দাম না বাড়লেও আমিষের চাহিদা পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ।
শুক্রবার (২ জুন) রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
গত সপ্তাহের তুলনায় আজকের কাঁচাবাজারে সবজির দাম প্রায় অপরিবর্তিত। কিছু সবজি সামান্য কম-বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। তবে বেড়েছে বেগুন আর শসার দাম। বেগুন ৮০-৯০ টাকা, শসা ৮০ টাকা, করল্লা ৭০-৭৫ টাকা, পেঁপে ৬০-৭০ টাকা, কাঁকরোল ৮০ টাকা, গাজর ৮০-১২০ টাকা, টমেটো ১০০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৪০ টাকা, চাল কুমড়া ৫০ টাকা, ঢেঁড়স ৬০-৭০ টাকা, পটল ৮০-১০০ টাকা, চিচিঙ্গা ৬০-১০০ টাকা, ধুন্দল ৭০-৯০ টাকা, সজনে ১৫০ টাকা, বরবটি ৮০ টাকা, কচুরমুখী ১০০ টাকা, কাঁচা মরিচ ১২০ টাকা, ধনেপাতা ১০০ টাকা কেজি। লাউ ৬০-৭০ টাকা পিস।
সবজি বিক্রেতা মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, সবজির দাম খুব একটা বাড়ে নাই। বাড়ছে বেগুন আর শসার দাম। গত সপ্তাহে বেগুন ছিল ৬০-৭০ টাকা, আজকে ৮০-৯০ টাকা। আর শসা ছিল ৫০-৬০ টাকা, আজকে ৮০ টাকা কেজি।
মালিবাগ কাঁচাবাজারে সাপ্তাহিক বাজার করতে এসেছেন বেসরকারি চাকরিজীবী খন্দকার আশরাফুল ইসলাম। বাজার ঘুরে সবজির চলমান অতিরিক্ত দামে তিনি হতাশ। তিনি বলেন, কয়েকমাস ধরে অতিরিক্ত বাড়তি দামে সব ধরনের সবজি বিক্রি হচ্ছে। এতে কি পরিমাণে অস্বস্তিতে আছে সাধারণ ক্রেতারা, বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবছে না, ভালোভাবে বাজার মনিটরিং হলে তাও হয়তবা কিছুটা কম দামে সবজি আমরা কিনে খেতে পারতাম। বাজেট ঘোষণার আগে যেমন বাড়তি দামে সবজি বিক্রি হচ্ছিল তেমনি বাজেটের পরেও বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে।
সবজি বাড়তি দামে বিক্রির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিক্রেতারা বলছেন, বেশ কিছু সবজির মৌসুম এখন না, ক্ষেতে আগের ফসল শেষের পথে। নতুন করে সবজি উঠলে তখন হয়তবা দাম কমতে পারে।
রাজধানীর মহাখালী বাজারে আসা গার্মেন্টসকর্মী আব্দুর রহিম মিয়া বলেন, বাজারে ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই, উপরে আছে ৭০/৮০ টাকা। সবজির দামই যদি এত হয়, তাহলে আমাদের মতো নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষ কীভাবে সবজি কিনবে। এই অবস্থায় অল্প স্বল্প করে সবজি কিনে কোনোভাবে চলছি। মাছ মাংসের অতিরিক্ত দামের কারণে সব সময় কেনা যায় না।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ২১০ থেকে ২২০ টাকার নিচে ব্রয়লার মুরগি মিলছে না। কক মুরগি প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়, লেয়ার মুরগি প্রতিকেজি ৩৮০ টাকা, সোনালি মুরগি প্রতিকেজি ৩৪০-৩৫০ টাকা।
মুরগির মাংসের পাশাপাশি ডিমের দামও এখন বাড়তি। গত সপ্তাহে প্রতি ডজন ফার্মের মুরগির ডিম ১৩০-১৩৫ টাকায় বিক্রি হলেও এ সপ্তাহে ১০-১৫ টাকা দাম বেড়ে এলাকা ভেদে প্রতি ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৪৫ টাকায়। আর হাঁসের ডিম প্রতি ডজন ১৮০-২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি মুরগির ডিম প্রতি ডজন ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পোল্ট্রি বাজারের এমন পরিস্থিতির জন্য বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়ী করছেন পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা।
এসব বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দু’মাস আগেও ব্রয়লার মুরগি কেনা যেতো ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজিতে। কিন্তু এখন সেটি বিক্রি হচ্ছে ২১০-২২০ টাকায়। মাস চারেক আগেও যেখানে কক মুরগি বা সোনালি মুরগি প্রতিকেজি ২৫০-২৬০ টাকায় কেনা যেত, তারও দাম বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৩৫০ টাকায়। দেশি মুরগির বিকল্প হিসেবে আগে কক মুরগির বিক্রি বেশি থাকলেও বর্তমানে দাম বাড়ায় এর বিক্রিতে কিছুটা টান পড়েছে। ফলে মুরগির বাজারে এখন চাহিদার শীর্ষে আছে ২০০-২২০ টাকায় বিক্রি হওয়া ব্রয়লার মুরগি। বাজারে এক কেজি সোনালি মুরগি কিনতে লাগছে ৩৩০ থেকে ৩৫০ টাকা। পাশাপাশি দেশি মুরগির দাম উঠেছে ৫৫০ টাকা কেজি।
বেসরকারি চাকরিজীবী মাকসুদুর রহমান। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি তার, তাই মেরাদিয়া হাটে এসেছিলেন ব্রয়লার মুরগি কিনতে। তিনি বাংলানিউজকে জানান, গত দুই মাসের মধ্যে ব্রয়লার মুরগির দাম অস্বাভাবিক ভাবে ৫০-৭০ টাকা বাড়লেও সে তুলনায় দাম কমে-বাড়ে ১০-১৫ টাকা করে। আগে ব্রয়লার মুরগি খেতে কিছুটা ঝামেলা হত। কিন্তু ব্রয়লারের মতো অন্য সব মুরগির দাম বেড়ে যাওয়াতে এখন কিছুটা কমে ব্রয়লারই কিনতে হচ্ছে। বর্তমানে প্রতিটি দোকানে ব্রয়লার মুরগি বেশি বেশি বিক্রি হচ্ছে। কারণ আগের থেকে ব্রয়লারের চাহিদা অনেক বেড়েছে।
অন্যদিকে, দু’মাসের ব্যবধানে কেজিতে ২০০ টাকা বেড়ে খাসির মাংস এখন বিক্রি হচ্ছে ১১০০ টাকা। আর ছাগলের মাংস বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৯৫০ থেকে এক হাজার টাকায়। আগের বাড়তি দামেই গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৭৮০-৮০০ টাকায়।
এদিকে মাছের বাজারে হাইব্রিড তেলাপিয়া মাছ গত সপ্তাহে ছিল ২০০ টাকা কেজি। যা এ সপ্তাহে কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকায়। পাঙাস প্রতিকেজি ২০০-২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, দেশি কই মাছ প্রতিকেজি ৪৫০ টাকা, শিং প্রতিকেজি ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, আইড় মাছ প্রতিকেজি ১৪০০ টাকা, রুপচাঁদা প্রতিকেজি ১৬০০ টাকা, আকার ভেদে পুঁটি মাছ প্রতিকেজি ৫০০-৭০০ টাকা, বড় সাইজের গলদা চিংড়ি প্রতিকেজি ১৩০০-১৪০০ টাকা, বাইলা মাছ প্রতিকেজি ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মেরাদিয়া হাটের মাছ বিক্রেতা ইদ্রিস আলী বলেন, দেশি নদীর মাছ বাজারে এখন কম আসছে। চাহিদাও বেশি, তাই দেশি সব মাছের দাম বর্তমানে কিছুটা বেশি। আড়াই থেকে তিন কেজির বেশি রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে ৩৬০ টাকা কেজিতে। আড়াই কেজির মধ্যে রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে ৩৩০-৩৪০ টাকায়।
মাছ ব্যবসায়ীরা বলছেন, মাছের দাম নাগালের মধ্যেই আছে। ক্রেতারা বলছেন, মুরগি ও গরুর মাংসের দাম বাড়ায় মাছের দিকেই ঝুঁকছেন বেশির ভাগ ক্রেতা।
এছাড়া মুদি দোকান ঘুরে জানা যায়— চিনি, তেল, ডালের মতো দ্রব্যাদির দাম। আগের মতোই অপরিবর্তিত রয়েছে এসব পণ্যের দাম। তবে দাম বেড়েছে প্যাকেট পোলাওয়ের চালের। আগে বিক্রি হতো কেজি ১৫০ টাকা করে আর এখন ১৬৫ টাকায়। মুসরের ডাল ১৩০ টাকা, মুগ ডাল ১২০ টাকা, খেসারি ডাল ৮০ টাকা, বুটের ডাল ৯৫ টাকা, ছোলা ৮৫ টাকা, চিনি ১৩০ টাকা, আটা ১৩০ টাকা (২ কেজির প্যাকেটে), খোলা ময়দা ৬৩ টাকা, সয়াবিন তেল (প্যাকেট) ১৯৯ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল ১৮০ টাকা এবং খোলা সরিষার তেল ২৫০ টাকা লিটার।
সেলিম জেনারেল স্টোরের বিক্রেতা মো. সেলিম বলেন, সব কিছুর দাম মোটামুটি আগের মতোই আছে। তবে প্যাকেট পোলাওয়ের চালের দাম বেড়েছে। ঈদের পরপরও আমরা ১৫০ টাকা করে বিক্রি করতাম, এখন হয়েছে ১৬৫ টাকা। সামনে আরও বাড়বে কিনা কে জানে।
বাজার করতে আসা বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, দিনদিন মাছ-মাংসের দাম বেড়েই চলেছে। গত সপ্তাহের তুলনায় আজ দেখছি মাছের বাজার চড়া। যেকারণে কিনতে গেলেও বারবার হিসাব করতে হয়। এখন আর আগের মতো প্রতি সপ্তাহেই গরুর মাংস কেনা যায় না।
বাজারে বাজেটের প্রভাব কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাজেটের মূল প্রভাব হয়তো আরও কিছুদিন পর পড়বে। তবে এখন যেটা দেখছি সেটা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার অংশ। বাজেট ঘোষণা হতেই বলা হচ্ছে সব জিনিসের দাম বাড়বে। এসব শুনে ব্যবসায়ীরা বাজেটের পরদিনই দাম বাড়িয়ে দিতে শুরু করেছে।