শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০১:১৩ পূর্বাহ্ন

অবৈধ দখলে ধলেশ্বরী নদীর দুই তীর

মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি
আপডেট : শুক্রবার, ১ জুলাই, ২০২২
অবৈধ দখলে ধলেশ্বরী নদীর দুই তীর
অবৈধ দখলে ধলেশ্বরী নদীর দুই তীর

প্রভাবশালীদের অবৈধ দখলের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে মুন্সীগঞ্জ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ধলেশ্বরী নদীর দুই তীর। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নদীর তীর অবৈধভাবে দখল করে গড়ে তুলেছেন বড় বড় শিল্প-কারখানা, কাঠ-ইট-বালির ব্যবসা, ফল ও শাক-সবজির আড়তসহ স্থায়ী-অস্থায়ী বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ নানা ধরনের স্থাপনা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, গড়ে উঠেছে বেসরকারি বিভিন্ন শিল্পসহ ছোট-বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তৈরি হয়েছে দেড় শতাধিক অবৈধ স্থাপনাসহ একাধিক ইট ও বালুর মহাল। এতে হুমকির মুখে পড়েছে নদীর মৎস্য খাত, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।

সদর উপজেলার নদীতীরবর্তী বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, মিরকাদিম লঞ্চঘাট থেকে মুন্সীগঞ্জ লঞ্চঘাট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১১ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদীর দক্ষিণ তীরে গড়ে উঠেছে শত শত অবৈধ স্থাপনা। মিরকাদিম লঞ্চঘাটের পূর্বপাশ থেকে কাঠপট্টি এলাকায় রয়েছে কাঠের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, অটো রাইসমিলসহ বিভিন্ন কলকারখানা। সেখান থেকে পূর্ব দিকে মুন্সীগঞ্জ লঞ্চঘাট পর্যন্ত রয়েছে অবৈধ অসংখ্য স্থাপনা।

২০১৯ সালে ২৫৬টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে তা উচ্ছেদের লক্ষ্যে অভিযান পরিচালনা করে বিআইডব্লিউটিএ। অভিযানে অর্ধশতাধিক স্থাপনা উচ্ছেদের পর নদীতীরে পানিস্বল্পতা দেখিয়ে অভিযান বন্ধ করে দেয়া হয়। অভিযান বন্ধের দু-তিন মাসের মধ্যে উচ্ছেদ হওয়া জায়গায় পুনরায় স্থাপনা নির্মাণ করেন দখলদাররা। এছাড়া আগের উদ্ধার অভিযানে বেঁচে যাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো ফের নতুন নতুন স্থাপনা তৈরি করে নদীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

অন্যদিকে বেশ কয়েক জায়গায় দেখা গিয়েছে নদীর তীরে ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। কারখানার ছাই ফেলে ভরাট করে সেখানেই অস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে সদর উপজেলার পঞ্চসার ইউনিয়নের মালিপাথর এলাকায়। পরবর্তী সময়ে সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।

স্থানীয়রা জানান, ধলেশ্বরী নদীর তীরে দখলদারদের কারণে নদীটি সংকীর্ণ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। এসব অবৈধ স্থাপনা কিংবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো নদীতে বাঁশ দিয়ে, মাটি ফেলে আবার কোথাও ময়লা ফেলে ভরাট করে গড়ে উঠছে। অভিযানের সময় যেসব স্থাপনা ভেঙে ফেলার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, অভিযান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নদীর জায়গা দখল করে সেসব প্রতিষ্ঠান আগের মতোই বহাল তবিয়তে রয়েছে।

কাঠপট্টি এলাকায় নদীর তীরে অস্থায়ী শেড নির্মাণ করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন কাঠের ব্যবসায়ীরা। বড় বড় গাছের গুঁড়ি নদীর তীরে রাখায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাঁধও। এছাড়া বিভিন্ন কলকারখানা এবং রাইস মিল মালিকরা তাদের প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলছেন।

সরেজমিনে আরো দেখা গেছে, মিরকাদিম লঞ্চঘাট, কাঠপট্টি, ফিরিঙ্গিবাজার, মুক্তারপুর এবং মুন্সীগঞ্জ লঞ্চঘাট এলাকাজুড়ে রয়েছে অজস্র অবৈধ স্থাপনা। আর ভরাট ও দখলের কারণে পানিপ্রবাহ কমে গিয়ে নাব্য সংকটে অস্তিত্ব হারাচ্ছে প্রায় শতবছরের প্রাচীন মিরকাদিম কমলাঘাট বন্দর ও মিরকাদিম লঞ্চঘাট। দীর্ঘদিন এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান না হওয়ায় দখলদারদের গ্রাসে ধীরে ধীরে অস্তিত্ব হারাচ্ছে ধলেশ্বরীর দুই তীর।

পঞ্চসার ইউনিয়নের মালিপাথর এলাকার বাসিন্দা রবিন দেওয়ান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে নদীর দুই পাশ দখল করে গড়ে উঠেছে একের পর এক অবৈধ স্থাপনা। এ নিয়ে স্থানীয়রা সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে একাধিকবার অভিযোগ করলেও টনক নড়েনি কারো। লোক দেখানো কিছু অভিযান পরিচালনার পর তা বন্ধ হয়ে যায়।

মিরকাদিমের কাঠপট্টি এলাকার বাসিন্দা সেলিম সরদার। তিনি বলেন, কাঠপট্টি এলাকায় ২০১৯ সালে বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হলেও অবৈধভাবে দখল করে থাকা বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে উচ্ছেদের জন্য কোনো নোটিস দেয়া হয়নি। তিনি অভিযোগ করেন, ছোটখাটো অস্থায়ী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা উচ্ছেদের পর অভিযান শেষ না করেই বিআইডব্লিউটিএর সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়।

মৎস্য ব্যবসায় নিয়োজিত স্থানীয় জেলেদের অভিযোগ, দখল আর দূষণের কারণে বর্ষা মৌসুমেও নদীতে মাছ মিলছে না। এতে জেলে সম্প্রদায়ের জীবন-জীবিকা এখন হুমকির মুখে পড়েছে। প্রভাবশালীরা বড় বড় স্থাপনা তৈরি করে নদীর জায়গা দখল করে নিলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন নির্বিকার। অভিযানে ছোট স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করা হলেও বড় স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ অভিযান থেকে বাদ পড়ে যায়।

তবে এ ব্যাপারে অভিযুক্ত একাধিক দখলদারের সঙ্গে আলাপকালে দাবি করেন, বিআইডব্লিউটিএ থেকে এসব জমি লিজ নিয়েছেন তারা। কেউ কেউ ভেঙে ফেলার শর্তে অস্থায়ী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।

বিআইডব্লিউটিএর নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ অঞ্চলের নদীবন্দরের যুগ্ম পরিচালক শেখ মাসুদ কামাল বণিক বার্তাকে বলেন, নদীর জায়গায় গড়ে ওঠা সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, দোকানপাটসহ অবৈধ সব ধরনের স্থাপনা উচ্ছেদ করার অভিযান চলমান আছে। শিগগিরই বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে মুন্সীগঞ্জে নদীর তীরে গড়ে ওঠা অবৈধ সব স্থাপনার তালিকা প্রস্তুত করা হবে। এরপর দ্রুত ধলেশ্বরী নদীর তীরে গড়ে ওঠা অবৈধ সব স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা হবে।

বিআইডব্লিউটিএর এ কর্মকর্তা আরো বলেন, শুধু ছোট স্থাপনা নয়, বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর সব স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। এবার কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। নির্দেশনা অনুযায়ী শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ সব ধরনের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে নদীর পার শতভাগ দখলমুক্ত করা হবে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ বিভাগের আরো সংবাদ

আবহাওয়া