নিজস্ব প্রতিবেদক :
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমাকে প্রধান অতিথি বলায় একটু কষ্ট পেলাম। যেন আমাকে খেলার মাঠ থেকে বাইরে রাখা হলো। হওয়া উচিত ছিল তো আমার খেলার ক্যাপ্টেন। কিন্তু আমাকে করা হলো অতিথি। আমি অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখতে চাই না। আমি ক্যাপ্টেন হিসেবে বক্তব্য রাখতে চাই।
রোববার (১৬ ফেব্রুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের শাপলা হলে ৩ দিনব্যাপী ডিসি সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধান অতিথি সম্বোধন করা প্রসঙ্গে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এখানে আমাকে প্রধান অতিথি হিসেবে বলাতে আমি একটু কষ্ট পেলাম। যেন আমাকে বাইরে রাখা হলো এ খেলার মাঠ থেকে। হওয়া উচিত ছিল আমার খেলার ক্যাপ্টেন। কিন্তু আমাকে করলেন অতিথি। আমি অতিথি হিসেবে বক্তব্য দিতে চাই না। আমি ক্যাপ্টেন হিসেবে বক্তব্য দিতে চাই। আমাদের করণীয় কী।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের কাজ একেবারে হাতে গোনা, মাপা জিনিস। এটা নিত্যনৈমিত্তিক, নতুন কিছু আসছে তা না—একই জিনিস বারেবারে আসছে, বিভিন্ন ভঙ্গিতে আসছে। সেগুলো আমরা কে কীভাবে করছি, কী হলে আরও ভালো হতো, কো-অর্ডিনেশনটা কীভাবে হলে ভালো হতো, ক্যাপ্টেনের সিগনালটা কীভাবে ফিল্ডে গেলে ভালো হতো—এসব নিয়েই আলোচনা।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে যা কিছু করণীয়, সেই করণীয়ের দায়িত্বে আমরা সবাই আছি, এমনভাবে যেমন চিন্তা করুন আমরা একটা খেলার—ক্রিকেট বা ফুটবল খেলার খেলোয়াড়। আমাদের আজকে এ খেলোয়াড়দের সমাবেশ। প্রস্তুতি নেওয়া, যে আমাদের স্ট্র্যাটেজি কী হবে, অবজেকটিভ কী হবে, আমাদের কার কী করণীয়—এসব ঠিক করা।
টিম স্পিরিট এবং নিজ নিজ জায়গায় প্রত্যেককে দায়িত্বশীল হওয়ার তাগিদ দিয়ে ড. ইউনূস বলেন, আমরা টিম হলাম কিনা? যদি এটা বাংলাদেশ সরকার হয়ে থাকে, বাংলাদেশ সরকারকে একটা টিম হতে হবে। এটা টিম ওয়ার্ক। এটা এমন না যে আমি আমার মতো করলাম, ও ওর মতো করলো—ওইটা হয় না, কোনো কাজেই হয় না। টিম গঠনের জন্য যখন একত্রিত হয়, তখন টিমের চিন্তা, করণীয় সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। কার কী আছে, তোমার কারণে আমারটা নষ্ট হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, কাজেই খেলা হলো একটা সামগ্রিক জিনিস। একজনের ভুল কাজে পুরো টিম তার সাফল্য থেকে বঞ্চিত হয়। কাজেই আমরা কেউ যেন এমন কোনো ভুল কাজ না করি, যাতে পুরো টিমের সাফল্য ব্যাহত হয়, আমাদের গন্তব্যে পৌঁছানো ব্যাহত হয়। এটা নিয়েই আমাদের আলোচনা—আমরা কী করছি।
অন্তর্বর্তী সরকার এখন পুরো খেলার জন্য প্রস্তুত মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সরকার গঠনের পর থেকে ছয় মাস চলে গেল। এটা আমাদের প্রথম পর্ব। আয়োজন করার জন্য যে সময় লাগে। অনেক ভুল-ভ্রান্তি হয়েছে এ আয়োজনের সময়। এখন সেগুলো ঠিকঠাক করে আমরা পুরো খেলার জন্য প্রস্তুত। সেই প্রস্তুতিটা আমাদের হলো কি না, না হলে কী কী ঘাটতি আছে, সেগুলো ঠিক করা।
ডিসি সম্মেলনের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, এটা মহাশক্তিধর একটি সমাবেশ। আমরা যা করি, যা চিন্তা করি, যা পরিকল্পনা করি, সেটাই সরকার। সেটাই সরকারের চিন্তা, সরকারের ভাবনা। সেটাই সরকারের কর্তব্য। কাজেই এ মহাশক্তি নিয়ে আমরা কী কাজ করবো, কী কাজের জন্য আমরা তৈরি, কী কাজে আমরা সফল, কী কাজে আমরা বিফল—সেগুলোই আজকের সমাবেশের আলোচ্য বিষয়। সেখানে কাউকে স্তুতি দিয়ে সময় নষ্ট করার কোনো সুযোগ নেই। এ স্তুতি বাক্য পরিহার করার আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। সভা-সমিতিতে স্তুতি বাক্য খুব অগ্রহণযোগ্য জিনিস বলে আমরা চালু করবো।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এটা যদি কোনো কোম্পানির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরদের বৈঠক হতো, তাতে যারা শরিক হচ্ছে, তারা কী বলতো? নিশ্চয়ই ম্যানেজিং ডিরেক্টরের প্রশংসায় সময় নষ্ট করতো না। তারা বলতো, এ কাজ দিয়েছেন আমাকে, আমি এ কাজ করেছি, আমার এ সাফল্য হয়েছে, আমি আরও এ কাজের জন্য প্রস্তুত।
তিনি আরও বলেন, আমি দুইভাবে দেখালাম—একটা হলো মাঠে খেলার খেলোয়াড়, আর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ফিল্ড অফিসারদের বক্তব্য। এ সরকারের যারা খেলোয়াড় আছে, তাদের এ ভূমিকা ওই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে কোনটার মতো হতে হবে? আমরা কী করছি, কী করা দরকার, কোথায় আমরা আটকে যাচ্ছি সেগুলো নিয়ে আলোচনা।
জেলা প্রশাসকদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এ সরকারের আমলে কারো রক্তচক্ষু বা ধমকের কারণে কোনো কাজ করার প্রয়োজন নেই। কারো ধমক শুনবেন না।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নিজের মতো করে যেটা আইন, যেটা দেশের জন্য করা দরকার, সেটা করতে হবে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে জেলা প্রশাসকদের সজাগ থাকার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তিনি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারদর নিয়ন্ত্রণে রাখতে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।
তিনি বলেন, আমরা আইন করে দিয়েছি, কিন্তু গ্রামে-গঞ্জে পৌঁছায়নি। অথচ আমরা এখানে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছি। এই যে দূরত্ব এটা যেন না থাকে। বিনা কারণে মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে। হয়রানি করাটাই যেন আমাদের ধর্ম। সরকার মানেই মানুষকে হয়রানি করা, এটাকে উল্টে দিতে হবে। সরকার ভিন্ন জিনিস। আপনার অধিকার পৌঁছে দেওয়াই আমাদের কাজ।
সরকার মানেই হয়রানি এ ধারণা উল্টে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিনা কারণে মানুষকে হয়রানি করা হয়। হয়রানি করাটাই যেন আমাদের ধর্ম! সরকার মানেই মানুষকে হয়রানি—এটার থেকে উল্টে দাও। সরকার ভিন্ন জিনিস, আপনার অধিকার আপনার দরজায় পৌঁছে দেওয়া আমাদের কাজ। এটাই যেন আমরা স্মরণ রাখি।
দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আমরা যেহেতু এমন পরিস্থিতিতে এসেছি, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা মস্ত বড় ইস্যু হয়ে গেল। এটাতে আমরা কে কী পরিমাণে অগ্রসর হলাম, কী করণীয়—এটা এক নম্বর বিবেচ্য বিষয়। আইন-শৃঙ্খলায় আমরা যেন বিফল না হই, কারণ এটাতে আমাদের সমস্ত অর্জন সফলভাবে অর্জিত হতে বা বিফলতায় পর্যবসিত হতে পারে। সেটাই নিয়ে এই সম্মেলনে আলোচনা হোক। ফিরে যাওয়ার পর যেন এটা বোঝার মধ্যে কোনো গলদ না থাকে।