স্পোর্টস ডেস্ক :
শেষ ৬ ওভারে হাতে ৬ উইকেট নিয়ে ৬৪ রান দরকার পড়ল ভারতের। ফাইনালের চাপের মঞ্চে এমন সমীকরণ মেলানো সহজ নয়। তবে কিছুক্ষণ পরপর খেলার রঙ বদলালেও পাল্লা ভারী থাকল তাদের দিকেই। শেষমেশ ২ বল বাকি থাকতেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে গেল দলটি। রোমাঞ্চকর লড়াইয়ে পাকিস্তানকে আবারও হারিয়ে শিরোপা ধরে রাখল ভারত।
রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) এশিয়া কাপের ফাইনালে প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হয় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল। দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে ৫ উইকেটে জিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ভারত। টস হেরে আগে ব্যাট করে ভালো শুরু পাওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান ১৯.১ ওভারে অলআউট হয় ১৪৬ রানে। জবাবে ১৯.৪ ওভারে ৫ উইকেটে ১৫০ রান তুলে জয় নিশ্চিত করে ভারত। হারিস রউফকে মিড অন দিয়ে চার মেরে খেলা শেষ করে দেন টুর্নামেন্টে প্রথমবার খেলতে নামা রিঙ্কু সিং।
মহাদেশীয় এই টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ট্রফি জয়ের রেকর্ড আরও সমৃদ্ধ করল ভারত। এটি টি-টোয়েন্টি সংস্করণের আসরে তাদের দ্বিতীয় ও সব মিলিয়ে নবম শিরোপা। টুর্নামেন্টে গ্রুপ পর্ব ও সুপার ফোরে আগের দুই সাক্ষাতে অনায়াসে জিতেছিল ভারত। আর জমজমাট ফাইনালেও তারাই মাঠ ছাড়ল শেষ হাসি নিয়ে। ফলে এবারের আসরে তাদের কাছে তৃতীয়বারের মতো হারল পাকিস্তান।
শুরুতে ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ার পর রান তাড়ায় ভারতের নায়ক তিলক বর্মা। চারে নেমে ৬৯ রানের অপরাজিত গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেন তিনি। দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে ৪১ বলে ফিফটি ছুঁয়ে ৫৩ বল মোকাবিলায় তিনি হাঁকান তিনটি চার ও চারটি ছক্কা। এছাড়া, সঞ্জু স্যামসন ২১ বলে ২৪ ও শিবাম দুবে ২২ বলে ৩৩ রান করেন।
তিলকের আগে বল হাতে দারুণ অবদান রাখেন কুলদীপ যাদব। ৪ ওভারে ৩০ রান খরচায় ৪ উইকেট নিয়ে তিনি ভারতের সবচেয়ে সফল বোলার। অথচ খরুচে বোলিংয়ে প্রথম ২ ওভারে ২৩ রান দিয়ে উইকেটশূন্য ছিলেন তিনি। এই বাঁহাতি রিস্ট স্পিনার ইনিংসের ১৭তম ও নিজের শেষ ওভারেই শিকার করেন ৩ উইকেট। দুটি করে উইকেট পান অক্ষর প্যাটেল, বরুণ চক্রবর্তী ও জসপ্রিত বুমরাহ।
চতুর্থ উইকেটে সঞ্জু স্যামসনের সঙ্গে ৫০ বলে ৫৭ রানের জুটিতে বিপর্যয় সামলে নেন তিলক। এরপর জরুরি সময়ে দুবের সঙ্গে তার পঞ্চম উইকেট জুটি জমে যায়। রানের চাকা সচল করে জুটিতে আসে ৪০ বলে ৬০ রান। দুবে শেষ পর্যন্ত টিকতে না পারলেও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মুহূর্তে ক্রিজে ছিলেন তিলক। তিনি বুনো উল্লাসে মাতেন রিঙ্কুকে নিয়ে।
ব্যাটিং ব্যর্থতায় সাদামাটা পুঁজির পর পাকিস্তানকে লড়াইয়ে রাখেন বোলাররা। স্কোরবোর্ডে মাত্র ২০ রান জমা করতে ৩ উইকেট পড়ে যায় ভারতের। প্রতিটি উইকেটই পড়ে স্লোয়ার ডেলিভারিতে। দ্বিতীয় ওভারে ফাহিম আশরাফকে ছক্কা মারতে গিয়ে বল আকাশে তুলে দেন অভিষেক শর্মা। ফাইনালে আর প্রতিপক্ষের জন্য আতঙ্ক হয়ে উঠতে পারেননি তিনি। মিড অনে তিনি ধরা পড়েন হারিস রউফের হাতে। ৬ বলে তার রান ৫।
পরের ওভারে শাহিনের অফ স্টাম্পের বাইরে ডেলিভারিতে ভারতের অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব ঠিকমতো টাইমিং করতে পারেননি। তালগোল পাকিয়ে ফেললেও শেষমেশ বলে হাতে জমান পাকিস্তানের অধিনায়ক সালমান আগা। ৫ বলে সূর্যকুমার করেন ১ রান। ব্যাট হাতে ব্যর্থতার মিছিলে যোগ দেন গিলও। ফাহিমের করা চতুর্থ ওভারে অফ স্টাম্পের বেশ বাইরের বল মারতে গিয়ে তিনি তোলেন ক্যাচ। আউট হন ১০ বলে ১২ রানে।
ক্যাচ মিস না হলে ভারতের চাপ আরও বাড়তে পারত। নবম ওভারে আক্রমণে যান লেগ স্পিনার আবরার আহমেদ। গিয়েই পেতে পারতেন সাফল্য। তার ডেলিভারি সীমানার বাইরে পাঠাতে গিয়ে ব্যাটে-বলে ঠিকঠাক সংযোগ ঘটাতে পারেননি স্যামসন। সহজ ক্যাচ যায় ডিপ মিড উইকেটে। কিন্তু ছুটে এসে দুই হাত ছোঁয়ালেও বল হাতে জমাতে পারেননি হুসাইন তালাত।
ব্যক্তিগত ১২ রানে বেঁচে যাওয়া স্যামসন বড় ইনিংস খেলতে না পারলেও তার সঙ্গে তিলকের জুটি মূলত পাকিস্তানকে উল্টো চাপে ফেলে দেয়। তবে হারের পর দলটির মনে বড় কাঁটা হয়ে বিঁধতে পারে রউফের এলোমেলো ও খরুচে বোলিং। আবরার, শাহিন, ফাহিমের পাশাপাশি মোহাম্মদ নওয়াজ ও সাইম আইয়ুব আঁটসাঁট থাকলেও এই ডানহাতি গতিময় পেসার ৩.৪ ওভারে দেন ৫০ রান।
স্যামসন পরবর্তীতে আবরারেরই শিকার হন। আর ১৯তম ওভারের শেষ ডেলিভারিতে দুবে ছক্কা মারার চেষ্টায় আউট হলে ভীষণ রোমাঞ্চ ছড়ায় লড়াইয়ে। শেষ ওভারে ভারতের প্রয়োজন পড়ে ১০ রানের। তখন আবার হারিসের ওপর চড়াও হয় ভারত। প্রথম বলে ডাবল নিয়ে দ্বিতীয় বলে ছক্কা হাঁকান তিলক। তৃতীয় বলে তিনি সিঙ্গেল নিলে স্ট্রাইক পেয়ে রিঙ্কু জিতিয়ে দেন দলকে।
অথচ ম্যাচের শুরুটা কী দারুণ হয়েছিল পাকিস্তানের। টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে খুব আগ্রাসী না হলেও পাওয়ার প্লেতে আসে বিনা উইকেটে ৪৫ রান।
দারুণ সব শট খেলে সাহিবজাদা ফারহান ফিফটি করেন ৩৫ বলে। ভারতের বিপক্ষে টানা দুই ম্যাচে পঞ্চাশ স্পর্শ করলেন তিনি।
দশম ওভারে ভারুন চক্রবর্তিকে ছক্কার পরের বলে আরেকটির চেষ্টায় ক্যাচ দিয়ে শেষ হয় ৫ চার ও ৩ ছক্কায় গড়া সাহিবজাদার ৩৮ বলে ৫৭ রানের দারুণ ইনিংস। আসরে আগের ছয় ম্যাচের চারটিতে শূন্য রানে ফেরা সাইম আইয়ুব এদিন দুটি চার মেরে শুরুটা ভালোই করেন। ত্রয়োদশ ওভারে কুলদিপের বলে সাইমের বিদায়ের পরই মূলত পাল্টে যায় চিত্র। পরের ওভারে আকসার প্যাটেলের বলে শূন্য রানে ফেরেন হারিস। ভারুনকে একটি ছক্কা মেরে পরের বলে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন ফাখার জামান (৩৫ বলে ৪৬)। হুসাইন তালাকে ফিরিয়ে দ্বিতীয় শিকার ধরেন আকসার।
সপ্তদশ ওভারে মাত্র এক রান দিয়ে সালমান আলি আগা, আফ্রিদি ও ফাহিমের উইকেট তুলে নেন কুলদিপ। পরপর দুই ওভারে শেষ দুটি উইকেট নিয়ে পাকিস্তানের ইনিংস গুটিয়ে দেন পেসার জাসপ্রিত বুমরাহ। ভারতের বিপক্ষে সুপার ফোরের ম্যাচে হাত দিয়ে বিমান বানিয়ে তা ভূপাতিত হওয়ার উদযাপন করেছিলেন রউফ, তাকে বোল্ড করে একইরকম ভঙ্গি করেন বুমরাহ। প্রথম তিন ব্যাটসম্যান ছাড়া পাকিস্তানের আর কেউ দুই অঙ্কে যেতে পারেননি।
চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পাশাপাশি পাকিস্তানের বিপক্ষে মুখোমুখি লড়াইয়ে একচেটিয়া দাপটও ধরে রাখল ভারত। টি-টোয়েন্টিতে দুই দলের ১৬ বারের দেখায় ১৩টিতে জিতল তারা। সবশেষ পাঁচ ম্যাচের সবকটিতে জয় ভারতের।
এবারের এশিয়া কাপে এই দুই দলের ম্যাচ নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি। গ্রুপ পর্বে টসের সময় পাকিস্তান অধিনায়ক সালমানের সঙ্গে হাত মেলাননি ভারত অধিনায়ক সুরিয়াকুমার। ম্যাচের পর পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাত না মিলিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটাররা মাঠ ছেড়ে ড্রেসিং রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেন।
প্রতিবাদে সেদিন ম্যাচের পর পুরস্কার বিতরণী আয়োজন বর্জন করেন সালমান। পাকিস্তান দল পরে বর্জন করে সংবাদ সম্মেলন। সেই ঘটনার জের ধরে অনেক কিছুই হয়ে যায়। পরেও একাধিক সংবাদ সম্মেলন বর্জন করে পাকিস্তান। ম্যাচ রেফারির অপসারণের দাবি তুলে টুর্নামেন্ট থেকে সরে দাঁড়ানো হুমকিও তারা দিয়েছিল।
ওই ম্যাচের পরের মন্তব্যের জন্য জরিমানা করা হয় সুরিয়াকুমারকে। সুপার ফোর পর্বে দুই দলের ম্যাচে বিতর্কিত উদযাপনের জন্য জরিমানা করা হয় পাকিস্তানের রউফকে, সতর্ক করা সাহিবজাদাকে।
ফাইনালে শেষেও হাত মেলায়নি দুই দল। ভারত যখন উদযাপনে ব্যস্ত, পাকিস্তান শিবির তখন হতাশার, স্বপ্নভঙ্গের আঁধারে নিমজ্জিত।