করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশে মার্চ মাস থেকে সব ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। ভাইরাসটির সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। এ সময়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান চালিয়ে নিতে সরকার সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে ও অনলাইনে ক্লাসের ব্যবস্থা করে। তবে এ পাঠদান কার্যক্রমের আওতার বাইরেই থেকে যাচ্ছে অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী। দূরশিক্ষণের মাধ্যমে পাঠদানের প্রভাব নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক গবেষণার তথ্য বলছে, দেশের প্রায় ৬১ শতাংশ শিক্ষার্থী সংসদ টেলিভিশনের ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারে না।
মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ওপরে পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে তৈরি বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারীর কারণে বিদ্যালয় বন্ধ থাকার ফলে প্রাক-প্রাথমিক ও টারশিয়ারি লেভেলের ৩ কোটি ৬০ লাখ শিক্ষার্থীর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সরকারি বৃত্তি সহায়তা পেয়ে থাকে এমন ৬ হাজার ১৫৩ জনের একটি তালিকা থেকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে এ জরিপ চালানো হয়। সেখান থেকে সংসদ টেলিভিশনের কাভারেজের আওতায় আছে এমন ২ হাজার ৪০৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১ হাজার ৬৫৬ জন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের বিস্তারিত সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। আর কোনো টিভি চ্যানেলই দেখার সুযোগ নেই বাকি ৩ হাজার ৭৪৫ জন শিক্ষার্থীর। ফলে সংসদ টেলিভিশনের ক্লাসে অংশগ্রহণ করার সুযোগ থেকেও তারা বঞ্চিত। সরকারি শিক্ষা সহায়তা পাওয়া এসব শিক্ষার্থীর মাত্র ১৫ শতাংশ ইন্টারনেট সেবাপ্রাপ্তির সুযোগ রয়েছে। এছাড়া অন্য গ্রুপে ৯০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫২৫ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের মাত্র ১০ শতাংশ ইন্টারনেট পরিষেবার অন্তর্ভুক্ত।
নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের পর থেকেই নিজ গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছে নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী বৃষ্টি আক্তার। সে জানায়, ২৯ মার্চ ক্লাস চালু হওয়ার পর দুই-তিনটা ক্লাসে অংশ নিতে পেরেছি। পরিবারের ও শিক্ষকের চাপ না থাকার কারণে এখন নিয়মিত ক্লাসে অংশ নেয়া হচ্ছে না। এছাড়া অনেক সময় বিদ্যুৎ থাকে না। ক্লাস রুটিনের বিষয়টা না জানার কারণে অনেক সময় ক্লাস না করে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েই দিনের অধিকাংশ সময় কাটছে।
বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জরিপে ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের নবম শ্রেণীর ২ হাজার ১৮১ জন শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্র ও ছাত্রীর অনুপাত ছিল ৩৬ ও ৬৪ শতাংশ। এছাড়া প্রাথমিকভাবে জরিপে সরকারি বৃত্তির অধিভুক্ত করা ৬ হাজার ১২৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫২ শতাংশেরই কোনো ধরনের টেলিভিশন দেখার সুযোগ নেই। এসব শিক্ষার্থীর ৬১ শতাংশই আবার সরকারিভাবে পরিচালিত সংসদ টেলিভিশন দেখতে পায় না।
তবে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত জানিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনটি আমাদের জরিপের সঙ্গে মিলছে না। তারা হয়তো সব শিক্ষার্থীর জরিপ করতে পারে। আমরা দেখেছি সংসদ টিভির মাধ্যমে ৯৩-৯৪ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। বাকি ৬-৭ শতাংশ শিক্ষার্থী যাতে ক্লাসে অংশ নিতে পারে, এ বিষয়ে এরই মধ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, শিক্ষার্থীদের টেলিভিশন সেবার আওতাভুক্ত হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে তাদের পারিবারিক সক্ষমতার ওপর। তবে এসব শিক্ষার্থীর ৮৬ শতাংশই সংসদ টিভির ব্যাপারে অবগত এবং অভিভাবকদেরও ৭৪ শতাংশ জানেন এ টিভির ব্যাপারে। এদিকে জরিপকালে সর্বশেষ সপ্তাহে ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থী সংসদ টেলিভিশনের দূরশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ফসিউল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে টিভিতে কেবল সংযোগ নেই। এ কারণে অনেকেই হয়তো ক্লাসের বাইরে থাকছে। এরই মধ্যে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে, কেবল নেটওয়ার্কে সংসদ টিভি দেখতে যাতে কারো সমস্যা না হয়। আমাদের লক্ষ্য সব শিক্ষার্থী যাতে ঘরে বসে ক্লাস করতে পারে। করোনা এদেশে কতদিন থাকবে তা সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। তাই শিক্ষার্থীরা যাতে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, এ বিষয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। যারা বিভিন্ন কারণে ক্লাস করতে পারেনি, তাদের কথা মাথায় রেখে উত্তরণ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, টেলিভিশনের বাইরে এসব শিক্ষার্থীর ৭৯ শতাংশেরই ইন্টারনেটভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করার কোনো সুযোগ নেই। আর মাত্র ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন উপকরণের ব্যাপারে অবগত। তবে শেষ সপ্তাহের হিসাবে অনলাইন উপকরণ সেবা গ্রহণ করেছে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ। অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশের বাড়িতে স্মার্টফোন আছে। তবে কম্পিউটার আছে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা একেবারে নগণ্য। মাত্র ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী কম্পিউটারের মধ্যে দূরশিক্ষণে অংশগ্রহণ সম্ভব বলে জানায়। ছাত্র ও ছাত্রীদের মধ্যে ইন্টারনেট সেবা প্রাপ্তির অনুপাত যথাক্রমে ২৫ ও ১৯ শতাংশ। বাড়িতে থেকে পাঠদানের এ সময়ে নতুন কোনো আলোচ্য বিষয়ের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের ৫০ শতাংশই তাদের ছেলে-মেয়েদের সহায়তা করতে পারছে না। তবে সন্তানের পড়াশোনায় বাবাদের চেয়ে মায়েরা ৩৩ শতাংশ ক্ষেত্রে বেশি দেখভাল করছে।
অভিভাবকদের ভূমিকা নিয়ে কুড়িগ্রামের তাসলিমা আক্তার বলেন, গ্রামে অধিকাংশ সময় বিদ্যুৎ থাকে না। এমন অনেক দিন হয়েছে ক্লাসের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে গেছে। এছাড়া বাড়িতে বিভিন্ন ঘরোয়া কাজে শিক্ষার্থীরা মাকে সহযোগিতা করে। বিদ্যালয়ের মতো ক্লাসের জন্য বিশেষ কোনো চাপ ও ক্লাস পরীক্ষা ব্যবস্থা না থাকার কারণে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনলাইন ক্লাসে আগ্রহ নেই। আবার অনেক শিক্ষার্থীর ক্লাস করার আগ্রহ থাকলেও বাড়িতে টেলিভিশন না থাকার কারণে ক্লাস করতে পারছে না বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, সরকার নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে মার্চের ১৭ তারিখ বন্ধ করে দেয়। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে মার্চের ২৯ তারিখ থেকে শুরু হয় দূরশিক্ষণ কার্যক্রম। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ৬ আগস্ট পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে দেশব্যাপী এ কার্যক্রম চালু রয়েছে।