নিজস্ব প্রতিবেদক :
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, আমরা আইএমএফের ওপর নির্ভরশীল নই, তারা ঋণ দিতে কোনো শর্ত দেয়নি। তবে কিছু রিকুইয়ারমেন্ট দেয়, যেমন- ঋণে সুদ কত, কত বছরে পরিশোধ করবো- এসব।
সোমবার (১৫ মে) নগরীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘আইএমএফ’র সময়কালে অসুবিধাগ্রস্ত মানুষের কথা জাতীয় বাজেটে কীভাবে প্রতিফলিত হতে পারে?’ শীর্ষক সিপিডির নাগরিক প্ল্যাটফর্মে তিনি এ কথা বলেন।
মন্ত্রী বলেন, আইএমএফের সঙ্গে বাজেটের সম্পর্ক কী? তারা সাইড অ্যাক্টর, বাজেট আমাদের নিজস্ব ব্যাপার। তবে আইএমএফের কিছু শর্ত থাকে। প্রয়োজনে হাত পাতি, দেওয়ার দায়িত্ব আইএমএফের। অনেকে বলে দাতাগোষ্ঠী, এ শব্দের আমি ঘোরবিরোধী। কারণ তারা উন্নয়ন সহযোগী, আমরা ঋণ নিয়ে থাকি এবং সুদ আসলে পরিশোধ করি। বাজেটে উন্নয়ন সহযোগীদের অবদান মাত্র ২ শতাংশ।
দারিদ্র্য প্রসঙ্গে এম এ মান্নান বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি আমাদের দরিদ্ররা বঞ্চিত। পদ্ধতিগতভাবে তারা বছরের পর বছর বঞ্চিত হচ্ছে। আমি গ্রামে যাই সরকারি মালামাল নিয়ে, এগুলো কোথায় যায় জানি না। এটা খুঁজে বের করাও কঠিন।
রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, ৩০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স মন্দ নয়। এটার খবর একসময় কেউ রাখত না। ৫০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স একসময় হয়েছিল, তাই এটা নজরে আসছে।
আইএমএফ বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা আইএমএফ এর ওপর নির্ভরশীল না। আইএমএফ আমাদের প্রয়োজনে টাকা দেয়। সংস্থাটি আমাদের দেশে পরিদর্শনে আসে কোনো মিশনে নয়। আইএমএফ ও আমাদের দেশের অনেকে মিশন কথাটা বলে থাকেন। এই মিশন কথাটায় আপত্তি আছে। প্রধানমন্ত্রীও সাম্প্রতিককালে তাদের এরকম শব্দ ব্যবহার না করতে বলেছেন। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আইএমএফ দাতাগোষ্ঠী নয়। আমাদের বাজেটের দুই ভাগও দাতাদের টাকা নেই। আমরা ঋণ করে টাকা আনি এবং সুদে আসলে পরিশোধ করি। স্বাধীন জাতির কাছে দাতা শব্দটা মানায় না। আইএমএফ কোনো শর্ত দেয়নি, যা দিয়েছে তা শর্ত নয়। এগুলোকে শর্ত বলা ঠিক নয়। বলা যেতে পারে রিকয়ারমেন্ট। দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ আছে। গত মাসে সামান্য একটু কমেছে, মন্দের ভালো। মজুরিও একটু বেড়েছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, হুন্ডির সঙ্গে পারি না। হুন্ডি নিয়ন্ত্রণে আমাদের চাপ অব্যাহত থাকবে। এছাড়া আমরা রিজার্ভ নিয়ে বাড়াবাড়ি করি না। কারণ ৫ থেকে ৭ বছর আগে আমি নিজেও রিজার্ভ সম্পর্কে জানতামই না। ইদানিং যেহেতু রিজার্ভের পরিমাণটা বেড়ে গিয়েছিল সেজন্য সবার চোখে পড়েছে। আমরা কোনোভাবেই মানতে চাই না রিজার্ভ কমবে। এটা চলমান প্রথা। রিজার্ভ বাড়বে, কমবে এটাই স্বাভাবিক। আগে তো কেউ খবরও রাখত না। এখন যেই রিজার্ভ আছে সেটা মন্দ নয়। আমাদের বর্তমানে ৪ থেকে পাঁচ মাসের আমদানি-রপ্তানির টাকা রিজার্ভে আছে।
ঋণ খেলাপির বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, এটা নিয়ন্ত্রণে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। এটার সঙ্গে নানাবিধ স্বার্থবাদী বড় বড় লোকেরা জড়িত আছে। তারা এখন পর্যন্ত সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। সরকার তাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে চায়, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকেও তো আসন ঠিক রাখতে হবে। এজন্য তাকেও এ জায়গায় ও জায়গায় কমপ্রোমাইজ করতে হয়।
মন্ত্রী আরও বলেন, আমরা সুশাসন দিচ্ছি, আমরা সংবিধানের শাসন দিচ্ছি, আমরা আইনের শাসন দিচ্ছি। আপনারা বলুন, আমরা কোথায় সংবিধানের বাইরে গিয়ে প্রচলিত আইনের বাইরে গিয়ে কিছু করছি কি না। থাকলে এটা বলতে হবে। আমরা অন্য কারো কাছে জবাবদিহিতা করব না। আমরা জনগণের কাছে জবাবদিহিতা করব।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, দেশে কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী আছে। দীর্ঘদিন থেকে তারা সুবিধাজনক অবস্থানে। তাদের অবস্থানে হাত দেওয়া সরকারের জন্যও অনেক সময় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। প্রধানমন্ত্রীকেও আসন ঠিক রাখতে খেলাপিদের সঙ্গে আপস করতে হয়।
পরিকল্পনামন্ত্রী আরো বলেন, কর ও ঋণখেলাপি নিয়ে আলোচনা আসছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণে সরকার যথেষ্ট কাজ করছে। তিনি বলেন, এখানে কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী আছে। দীর্ঘদিন থেকে তারা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। তাদের সুবিধাজনক অবস্থানে হাত দেওয়া সরকারের জন্যও অনেক সময় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
তিনি বলেন, সরকার এসব বিষয়ে কিছু করতে চায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ (ভেরি মাচ কমিটেড)। কিন্তু তাকেও দিন শেষে (অ্যান্ড অব দা ডে) তার আসন ঠিক রাখতে হবে। আর আসন ঠিক রাখার জন্য অনেক সময় আপস (কম্প্রোমাইজ) করতে হয়। এটি আপনারা বুঝতে পারেন।
মন্ত্রী বলেন, মূল্যস্ফীতির কথা বলা হচ্ছে। হ্যাঁ, মুহূর্তে বড় সমস্যা মূল্যস্ফীতি। গত মাসে সামান্য কমেছে। তবে আরও কমানোর চেষ্টা চলছে। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, আইএমএফের শর্ত নিয়ে কথা আসছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো আইএমএফের কোনো শর্ত নেই। সংস্থাটি এখানে বড় কোনো ফ্যাক্টর নয়। আমরা তাদের ওপর নির্ভরশীল নই। এক্ষেত্রে আইএমএফ মিশন কিংবা দাতাগোষ্ঠী শব্দগুলো ঠিক নয়। কারণ আমরা তাদের সাহায্য নয়, ঋণ নিয়ে থাকি।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ভর্তুকির ব্যাপারে বিভিন্ন কথা আসছে। কিন্তু ভর্তুকির ভালো ও মন্দ দুটিই আছে। খারাপ ভর্তুকি ভালো ভর্তুকিকে দূরে সরিয়ে দেয়। তিনি বলেন, শক্তিশালী গ্র“প ডিনার খাওয়ায়, অভিনন্দন দেয়, সংবর্ধনা দেয়, ফুলের মালা ক্রেস্ট দেয়। এরপর তারা ভর্তুকি আদায় করে নেয়। এটাকে আমরা খারাপ ভর্তুকি বলি। এগুলো থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। এছাড়া প্রণোদনার নামে উন্মাদনা থেকে পর্যায়ক্রমে বেরিয়ে আসা উচিত।
তিনি বলেন, বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা আসছে। বণ্টনে সমস্যা নিয়ে কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আমি বরাদ্দ বাড়ানোর পক্ষে। এখানে যারা জড়িত তাদেরও সমস্যা আছে, সরকারপ্রধানেরও সমস্যা আছে। কারণ আগে থেকে যারা বোতল থেকে দুধ খেয়ে আসছে, তাদের মুখ সরানো যাচ্ছে না। ছোটবেলা আপনারা দেখেছেন, বাচ্চারা বোতল কামড় দিয়ে ধরে। এই কামড় দিয়ে ধরার স্বভাব এখানেও আছে। মা হিসেবে সরকারপ্রধানকে যা করতে হয়, তাদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে অথবা তিতা কিছু দিয়ে ছাড়াতে হয়।
মূল প্রবন্ধের ব্যাখ্যায় মন্ত্রী বলেন, দেশে তথ্যপ্রবাহে ঘাটতি আছে, এটি আমরা সবাই জানি। গ্রামের মানুষের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ খুবই কম। তিনি বলেন, আমার এলাকার মানুষ, যারা আমাকে ভোট দেয়, আমি তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারি না। তারা আমার কাছেই আসে না। আমার ভাষা বোঝে না। এর কারণ হলো অর্থনৈতিকভাবে আমাদের মধ্যে ফারাক সৃষ্টি হয়েছে। আমার গ্রামের ছেলেরা স্কুলে যায় না। বাপ-মা তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানে পাঠায়। এটা আমাকে পীড়া দেয়। তিনি বলেন, সরকারের বেশ সফলতা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বিদ্যুৎ। একটা কাজের জন্য যদি সরকার পরপারে গিয়ে শান্তিতে বসবাস করতে পারে, সেটি হলো ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানো।
নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপের সদস্য অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য রানা মোহাম্মদ সোহেল, বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন এবং সিনিয়র রিসার্স ফেলো ড. তৌফিকুল ইসলাম খান। এছাড়া পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।