Dhaka শুক্রবার, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২০ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দেশে টাকাও নেই ডলারও নেই : আহসান এইচ মনসুর

নিজস্ব প্রতিবেদক : 

আইএমএফের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আর্থিক দুরবস্থার কারণে দিন দিন বাংলাদেশ ঋণনির্ভর হয়ে পড়ছে। এমনকি ধীরে ধীরে ঋণ পাওয়ার সক্ষমতাও কমছে। অন্যদিকে বাজেট বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত রাজস্ব আদায় করতে পারছে না সরকার। এখন বাজেট বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজানীয় টাকাও নেই ডলারও নেই। কিভাবে বাস্তবায়ন হবে। তাই দেশের আর্থিক খাতের সংকট মোকাবেলায় রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোনো বিকল্প নেই।

শনিবার (১৩ জুলাই) রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) উদ্যোগে আয়োজিত ‘বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থার কারণ’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন।

সেমিনারে ব্যাংকিং খাতের বর্তমান পরিস্থিতির ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জ্যেষ্ঠ সদস্য ওবায়দুল্লাহ রনি এবং সানাউল্লাহ সাকিব।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, পর্যাপ্ত ডলার না থাকার কারণে জ্বালানি খাতসহ বিভিন্ন খাতের বিল পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। যদি স্বাস্থ ভালো না থাকে তাহলে ভার বহন করা যায় না। ব্যাংক খাতের দুর্বলাতার কারণে এখন ব্যাংক ব্যক্তি খাতকেও ঋণ দিতে পারছেনা আবার সরকারকেও ঋণ দিতে পারছে না। এখন ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৮ থেকে ৯ শতাংশ। এবছর যদি বাড়ে তাহলে সেটা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ হতে পারে। সেই হিসাবে এবছর আমানত আসবে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো। নতুন অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়ছে তা কিভাবে দিবে ব্যাংক? সরকার এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিলে ব্যক্তি খাত টাকা কোথায় পাবে। কিন্তু বাজেটে ব্যক্তি খাতের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ২৭ শতাংশ। কিন্তু এপর্যন্ত ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ২২ থেকো ২৩ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। যদি ব্যাংক খাতের আমানতের প্রবৃদ্ধি না বাড়ে আবার সরকারকে ঋণ দিতে হয় তাহলে ২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কিভাবে অর্জন হবে।’

তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগে বলা হয়েছিল আর্থিক খাতে ব্যপক সংস্কার আনা হবে। কিন্তু ছয় মাস পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্তু কিছুই হয়নি। এটা খুবই হতাশাজনক। দেশের স্বার্থেই এখন ব্যাংক খাতের সংস্কার খুবই জরুরি। আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে সেটা ভালো। কিন্তু নিজেদের স্বার্থেই আমাদের সংস্কার দরকার। আমরাতো আমানত খেয়ে ফেলেছি। এভাবে ব্যাংক কতদিন চলবে? ব্যাংক খাত নিয়ে স্বেতপত্র প্রকাশ করা দরাকার। সেটা করতে হবে সরকারকেই। বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়ে নয়। ব্যাংক খাতে আজকে যে এই অবস্থা হলো তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে।’

মনসুর বলেন, ‘ঋণ আদয় না করে ঋণের সুদকে আয় দেখিয়ে মুনাফা দেখাচ্ছে ব্যাংক। সেই মুনাফার অর্থ থেকে লভ্যাংশ দিচ্ছে। সরকারকে ট্যাক্সও দিচ্ছে। আসলে কোনো আয়-ই হয়নি। আমানতের অর্থ লুটে খাচ্ছে কয়েকটি গোষ্ঠী। সরকারের সহযোগীতায় তারা পুষ্ট হয়ে উঠেছে। তাদের কারণেই এখন আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে কার্পেটের নিচে ময়লা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। একটা সময় তাতো দুর্গন্ধ ছড়াবেই।’

‘লক্ষ্য করা যাচ্ছে এতো সমস্যার মধ্যেও লভ্যাংশ দিচ্ছে অনেক ব্যাংক। আসলে ঘরের থালাবাসন বেঁচে কোরমা পোলাও খাচ্ছি আমরা। এভাবে আর কতদিন ব্যাংক চলতে পারবে? অমানত শেষ হয়ে যাবে। গ্রাহকের অর্থ আর ফেরত দিতে পারবে না ব্যাংক। এখন আর্থিক খাতের ‘ক্লিনিং’ কার্যক্রম প্রয়োজন বলে মনে করেন ড. আহসান এইচ মনসুর। আমাদের ব্যাংক খাতের সমস্যাগুলো সমাধান না করে জিইয়ে রাখছে।’- যোগ করেন তিনি।

আর্থিক খাতে সবচেয়ে বেশি তথ্য লুকানো হচ্ছে অভিযোগ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘দেশের সবচেয়ে বেশি তথ্য লুকানো হয় আর্থিক খাতে। যেখানে সঠিক তথ্য সবচেয়ে বেশি জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ১১ শতাংশ খেলাপি ঋণ দেখাচ্ছে। আসলে বাস্তবে খেলাপি বা মন্দ ঋণ ২৫ শতাংশ। এভাবে আর বেশিদিন চলতে পারবে না।’

ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধার সভাপতিত্তে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।

প্রবন্ধ উপস্থাপনায় বলা হয়, বর্তমান সরকারের সময়ে পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেলের মতো অনেক বড়-বড় প্রকল্প হয়েছে। এসব প্রকল্পের সুফল হিসেবে যেখানে কর্মসংস্থান বেড়ে মূল্যস্ফীতি নাগালের মধ্যে থাকার কথা। সেখানে ডলার সঙ্কট, ব্যাংক খাতে দূরবস্থার কারণে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষকে চরম অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। সরকারের সব অর্জন যেন এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ব্যাংক খাতের দূরবস্থা ম্লান করে দিচ্ছে। অথচ বিষয়টি দেখভাল করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সংস্থাটির অব্যাহত ব্যর্থতার কারণেই তৈরি হয়েছে বলে অর্থনীতিবিদরা বলছেন।

আর্থিক খাতে শৃংখলা ধরে রাখতে কঠোর নীতির পরিবর্তে একের পর এক নীতি সহায়তার নামে ঋণখেলাপি, অর্থপাচারকারীদের সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ২০১৯ সালে মেয়াদী ঋণ পরিশোধে বিশেষ ছাড় এবং ৯-৬ এর মতো নীতি গ্রহণ করে অর্থনীতিকে বিপর্যয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। দেশের মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রাবাজার পরস্থিতি এবং ব্যাংক খাতে বিশৃংখলার বিষয়টি সবার জানা।

অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, আবার যথাসময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ে সবাই এখন অস্বস্তিতে আছে। সর্বশেষ সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি ঠেকেছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। গত ১৩ বছরের মধ্যে যা সর্বোচ্চ।

দেশে উচ্চ মল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে কৃত্রিমভাবে ডলারের দর ৮৪-৮৬ টাকায় ধরে রেখেছিল। তবে করোনা পরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পর তা আর ধরে রাখা যায়নি। শুরুর দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা উপায়ে ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ করে ডলারের দর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। ২০২২ সালের আগস্টে কয়েকটি ব্যাংকের ট্রেজারি হেডকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এমডিদের ব্যাখ্যা তলব করা হয়। এরপর ব্যাংক খাতে আতঙ্ক ছড়িয়ে ডলার বাজার আরও খারাপ হয়। ডলারের দর উঠে যায় ১১০ টাকায়। একদিকে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, একই সঙ্গে দীর্ঘদিন কৃত্রিমভাবে ডলারের দর ধরে রাখার প্রভাবে টানা দু’বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। আবার ধারাবাহিকভাবে রিজার্ভ কমে ২০২১ সালের আগস্টের ৪৮.০৬ বিলিয়ন থেকে এখন ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। তবে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ১৫ বিলিয়নে নেমেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ ডলার সঙ্কট। অথচ অর্থপাচারকারী, মানি লন্ডারিংয়ের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

বেনামি ঋণসহ বিভিন্ন কারণে কয়েকটি ব্যাংকের ভঙ্গুর অবস্থার তথ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। বর্তমানে শরীয়াহ ভিত্তিক ৫টিসহ ৭টি ব্যাংক বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণ তো দূরে থাক, দীর্ঘদিন ধরে চলতি হিসাবে ঘাটতি নিয়ে চরছে। গত মে পর্যন্ত এসব ব্যাংকের ঘাটতি ছিল প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা। চলতি হিসাব ঋনাত্বক রেখে কোনো ব্যাংক লেনদেন করতে পারার কথা না। অথচ ব্যাংকগুলোকে বিশেষ উপায়ে লেনদেন করতে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমনকি নতুন ঋণ বিতরণও অব্যাহত আছে। একই সঙ্গে এসব ব্যাংকের অর্ধ-বার্ষিক ও বার্ষিক প্রতিবেদন ভালো দেখাতে জুন ও ডিসেম্বর শেষে ঘাটতির চেয়ে বেশি জামানতবিহীন বিশেষ ধার দেওয়া হচ্ছে। এই প্রবণতা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির বিপরীতমুখী অবস্থান হিসেবে দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে না পারার বিষয়টি সবার জানা।

বর্তমান গভর্নর যোগদানের পরই এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেন ১০টি দূর্বল ব্যাংক আলাদাভাবে নিবিড় তদারকি করা হবে। এসব ব্যাংকে নির্বাহী পরিচালক পর্যায়ের একজন করে কর্মকর্তাকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ৩৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা বেড়ে গত মার্চ শেষে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা হয়েছে। মোট ঋণের যা ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। কাগজে-কলমে এটা দেখানো হলেও প্রকৃত খেলাপি ঋণ প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা বলে বিভিন্ন বক্তব্যে উঠে আসছে। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে নানা ছাড় দিয়ে কম দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে।

বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ বেশ আগ থেকেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সুদহার বৃদ্ধি ও সংকোচনমুলক মুদ্রানীতির ভঙ্গি গ্রহণ করে এরই মধ্যে সুফল পেতে শুরু করেছে। বেশ আগে থেকেই অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকারসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে বাংলাদেশের সুদহার বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে বর্তমান গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২২ সালের আগস্টে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘আউট অব বক্স’ সিদ্ধান্ত নিয়ে তিন মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা হবে। ওই বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে ডলার পরিস্থিতি ঠিক হয়ে আসবে। তবে প্রায় দুই বছর পরও উন্নতি তো দূরে থাক, আরও অবনতি হয়েছে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশে বাড়ছে। যখন বৈশ্বিক রেটিং সংস্থা বাংলাদেশের মান অবনমন করে দিয়েছে, তখন গর্ভনর বলেছেন, এটা রাজনৈতিক কারণে কমানো হয়েছে।

অন্য দেশ যেখানে কঠোর নীতি থেকে সরে আসার অপেক্ষায় আছে, বাংলাদেশ সেখানে কঠোর নীতি গ্রহণ করে চলেছে। গত ৮ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একই দিন অর্থনীতির তিনটি কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আইএমএফের চাপে পড়ে ওই দিন সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে, ডলারের দর ৭ টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা মধ্যবর্তী দর ঠিক করেছে এবং নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে।

জনপ্রিয় খবর

আবহাওয়া

বার্ড স্ট্রাইক, বেঙ্গালুরুতে ফ্লাইট বাতিল করল এয়ার ইন্ডিয়া

দেশে টাকাও নেই ডলারও নেই : আহসান এইচ মনসুর

প্রকাশের সময় : ০৮:২১:০৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৩ জুলাই ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক : 

আইএমএফের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আর্থিক দুরবস্থার কারণে দিন দিন বাংলাদেশ ঋণনির্ভর হয়ে পড়ছে। এমনকি ধীরে ধীরে ঋণ পাওয়ার সক্ষমতাও কমছে। অন্যদিকে বাজেট বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত রাজস্ব আদায় করতে পারছে না সরকার। এখন বাজেট বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজানীয় টাকাও নেই ডলারও নেই। কিভাবে বাস্তবায়ন হবে। তাই দেশের আর্থিক খাতের সংকট মোকাবেলায় রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোনো বিকল্প নেই।

শনিবার (১৩ জুলাই) রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) উদ্যোগে আয়োজিত ‘বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থার কারণ’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন।

সেমিনারে ব্যাংকিং খাতের বর্তমান পরিস্থিতির ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জ্যেষ্ঠ সদস্য ওবায়দুল্লাহ রনি এবং সানাউল্লাহ সাকিব।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, পর্যাপ্ত ডলার না থাকার কারণে জ্বালানি খাতসহ বিভিন্ন খাতের বিল পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। যদি স্বাস্থ ভালো না থাকে তাহলে ভার বহন করা যায় না। ব্যাংক খাতের দুর্বলাতার কারণে এখন ব্যাংক ব্যক্তি খাতকেও ঋণ দিতে পারছেনা আবার সরকারকেও ঋণ দিতে পারছে না। এখন ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৮ থেকে ৯ শতাংশ। এবছর যদি বাড়ে তাহলে সেটা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ হতে পারে। সেই হিসাবে এবছর আমানত আসবে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো। নতুন অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়ছে তা কিভাবে দিবে ব্যাংক? সরকার এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিলে ব্যক্তি খাত টাকা কোথায় পাবে। কিন্তু বাজেটে ব্যক্তি খাতের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ২৭ শতাংশ। কিন্তু এপর্যন্ত ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ২২ থেকো ২৩ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। যদি ব্যাংক খাতের আমানতের প্রবৃদ্ধি না বাড়ে আবার সরকারকে ঋণ দিতে হয় তাহলে ২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কিভাবে অর্জন হবে।’

তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগে বলা হয়েছিল আর্থিক খাতে ব্যপক সংস্কার আনা হবে। কিন্তু ছয় মাস পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্তু কিছুই হয়নি। এটা খুবই হতাশাজনক। দেশের স্বার্থেই এখন ব্যাংক খাতের সংস্কার খুবই জরুরি। আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে সেটা ভালো। কিন্তু নিজেদের স্বার্থেই আমাদের সংস্কার দরকার। আমরাতো আমানত খেয়ে ফেলেছি। এভাবে ব্যাংক কতদিন চলবে? ব্যাংক খাত নিয়ে স্বেতপত্র প্রকাশ করা দরাকার। সেটা করতে হবে সরকারকেই। বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়ে নয়। ব্যাংক খাতে আজকে যে এই অবস্থা হলো তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে।’

মনসুর বলেন, ‘ঋণ আদয় না করে ঋণের সুদকে আয় দেখিয়ে মুনাফা দেখাচ্ছে ব্যাংক। সেই মুনাফার অর্থ থেকে লভ্যাংশ দিচ্ছে। সরকারকে ট্যাক্সও দিচ্ছে। আসলে কোনো আয়-ই হয়নি। আমানতের অর্থ লুটে খাচ্ছে কয়েকটি গোষ্ঠী। সরকারের সহযোগীতায় তারা পুষ্ট হয়ে উঠেছে। তাদের কারণেই এখন আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে কার্পেটের নিচে ময়লা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। একটা সময় তাতো দুর্গন্ধ ছড়াবেই।’

‘লক্ষ্য করা যাচ্ছে এতো সমস্যার মধ্যেও লভ্যাংশ দিচ্ছে অনেক ব্যাংক। আসলে ঘরের থালাবাসন বেঁচে কোরমা পোলাও খাচ্ছি আমরা। এভাবে আর কতদিন ব্যাংক চলতে পারবে? অমানত শেষ হয়ে যাবে। গ্রাহকের অর্থ আর ফেরত দিতে পারবে না ব্যাংক। এখন আর্থিক খাতের ‘ক্লিনিং’ কার্যক্রম প্রয়োজন বলে মনে করেন ড. আহসান এইচ মনসুর। আমাদের ব্যাংক খাতের সমস্যাগুলো সমাধান না করে জিইয়ে রাখছে।’- যোগ করেন তিনি।

আর্থিক খাতে সবচেয়ে বেশি তথ্য লুকানো হচ্ছে অভিযোগ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘দেশের সবচেয়ে বেশি তথ্য লুকানো হয় আর্থিক খাতে। যেখানে সঠিক তথ্য সবচেয়ে বেশি জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ১১ শতাংশ খেলাপি ঋণ দেখাচ্ছে। আসলে বাস্তবে খেলাপি বা মন্দ ঋণ ২৫ শতাংশ। এভাবে আর বেশিদিন চলতে পারবে না।’

ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধার সভাপতিত্তে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।

প্রবন্ধ উপস্থাপনায় বলা হয়, বর্তমান সরকারের সময়ে পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেলের মতো অনেক বড়-বড় প্রকল্প হয়েছে। এসব প্রকল্পের সুফল হিসেবে যেখানে কর্মসংস্থান বেড়ে মূল্যস্ফীতি নাগালের মধ্যে থাকার কথা। সেখানে ডলার সঙ্কট, ব্যাংক খাতে দূরবস্থার কারণে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষকে চরম অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। সরকারের সব অর্জন যেন এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ব্যাংক খাতের দূরবস্থা ম্লান করে দিচ্ছে। অথচ বিষয়টি দেখভাল করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সংস্থাটির অব্যাহত ব্যর্থতার কারণেই তৈরি হয়েছে বলে অর্থনীতিবিদরা বলছেন।

আর্থিক খাতে শৃংখলা ধরে রাখতে কঠোর নীতির পরিবর্তে একের পর এক নীতি সহায়তার নামে ঋণখেলাপি, অর্থপাচারকারীদের সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ২০১৯ সালে মেয়াদী ঋণ পরিশোধে বিশেষ ছাড় এবং ৯-৬ এর মতো নীতি গ্রহণ করে অর্থনীতিকে বিপর্যয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। দেশের মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রাবাজার পরস্থিতি এবং ব্যাংক খাতে বিশৃংখলার বিষয়টি সবার জানা।

অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, আবার যথাসময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ে সবাই এখন অস্বস্তিতে আছে। সর্বশেষ সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি ঠেকেছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। গত ১৩ বছরের মধ্যে যা সর্বোচ্চ।

দেশে উচ্চ মল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে কৃত্রিমভাবে ডলারের দর ৮৪-৮৬ টাকায় ধরে রেখেছিল। তবে করোনা পরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পর তা আর ধরে রাখা যায়নি। শুরুর দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা উপায়ে ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ করে ডলারের দর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। ২০২২ সালের আগস্টে কয়েকটি ব্যাংকের ট্রেজারি হেডকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এমডিদের ব্যাখ্যা তলব করা হয়। এরপর ব্যাংক খাতে আতঙ্ক ছড়িয়ে ডলার বাজার আরও খারাপ হয়। ডলারের দর উঠে যায় ১১০ টাকায়। একদিকে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, একই সঙ্গে দীর্ঘদিন কৃত্রিমভাবে ডলারের দর ধরে রাখার প্রভাবে টানা দু’বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। আবার ধারাবাহিকভাবে রিজার্ভ কমে ২০২১ সালের আগস্টের ৪৮.০৬ বিলিয়ন থেকে এখন ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। তবে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ১৫ বিলিয়নে নেমেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ ডলার সঙ্কট। অথচ অর্থপাচারকারী, মানি লন্ডারিংয়ের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

বেনামি ঋণসহ বিভিন্ন কারণে কয়েকটি ব্যাংকের ভঙ্গুর অবস্থার তথ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। বর্তমানে শরীয়াহ ভিত্তিক ৫টিসহ ৭টি ব্যাংক বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণ তো দূরে থাক, দীর্ঘদিন ধরে চলতি হিসাবে ঘাটতি নিয়ে চরছে। গত মে পর্যন্ত এসব ব্যাংকের ঘাটতি ছিল প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা। চলতি হিসাব ঋনাত্বক রেখে কোনো ব্যাংক লেনদেন করতে পারার কথা না। অথচ ব্যাংকগুলোকে বিশেষ উপায়ে লেনদেন করতে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমনকি নতুন ঋণ বিতরণও অব্যাহত আছে। একই সঙ্গে এসব ব্যাংকের অর্ধ-বার্ষিক ও বার্ষিক প্রতিবেদন ভালো দেখাতে জুন ও ডিসেম্বর শেষে ঘাটতির চেয়ে বেশি জামানতবিহীন বিশেষ ধার দেওয়া হচ্ছে। এই প্রবণতা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির বিপরীতমুখী অবস্থান হিসেবে দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে না পারার বিষয়টি সবার জানা।

বর্তমান গভর্নর যোগদানের পরই এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেন ১০টি দূর্বল ব্যাংক আলাদাভাবে নিবিড় তদারকি করা হবে। এসব ব্যাংকে নির্বাহী পরিচালক পর্যায়ের একজন করে কর্মকর্তাকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ৩৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা বেড়ে গত মার্চ শেষে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা হয়েছে। মোট ঋণের যা ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। কাগজে-কলমে এটা দেখানো হলেও প্রকৃত খেলাপি ঋণ প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা বলে বিভিন্ন বক্তব্যে উঠে আসছে। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে নানা ছাড় দিয়ে কম দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে।

বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ বেশ আগ থেকেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সুদহার বৃদ্ধি ও সংকোচনমুলক মুদ্রানীতির ভঙ্গি গ্রহণ করে এরই মধ্যে সুফল পেতে শুরু করেছে। বেশ আগে থেকেই অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকারসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে বাংলাদেশের সুদহার বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে বর্তমান গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২২ সালের আগস্টে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘আউট অব বক্স’ সিদ্ধান্ত নিয়ে তিন মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা হবে। ওই বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে ডলার পরিস্থিতি ঠিক হয়ে আসবে। তবে প্রায় দুই বছর পরও উন্নতি তো দূরে থাক, আরও অবনতি হয়েছে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশে বাড়ছে। যখন বৈশ্বিক রেটিং সংস্থা বাংলাদেশের মান অবনমন করে দিয়েছে, তখন গর্ভনর বলেছেন, এটা রাজনৈতিক কারণে কমানো হয়েছে।

অন্য দেশ যেখানে কঠোর নীতি থেকে সরে আসার অপেক্ষায় আছে, বাংলাদেশ সেখানে কঠোর নীতি গ্রহণ করে চলেছে। গত ৮ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একই দিন অর্থনীতির তিনটি কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আইএমএফের চাপে পড়ে ওই দিন সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে, ডলারের দর ৭ টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা মধ্যবর্তী দর ঠিক করেছে এবং নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে।