নিজস্ব প্রতিবেদক :
আগামী ডিসেম্বরে মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বুধবার (২৮ মে) রাজধানী পল্টনে বিএনপির তিন অঙ্গ সংগঠনের আয়োজনে তারুণ্যের সমাবেশে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন।
তারেক রহমান বলেন, গত দেড় দশকে নতুন ভোটাররা ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করার সুযোগ পায়নি। সুতরাং সংস্কার ইস্যুর পাশাপাশি নির্বাচন আয়োজন গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা বিশ্বাস করি। এই বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাসে সফলভাবে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করেছে। আজ আমরা দেখছি, ১০ মাস পেরোলেও অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করছে না। আমরা দ্রুত নির্বাচন চাই। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে।’
জনগণের রায়কে বাস্তবায়ন করতে হলে নির্বাচিত সরকার দরকার বলে জানিয়ে তিনি বলেন, যেকোনো দলের তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হলে দরকার একটি জবাবদিহিমূলক সরকার, দরকার একটি নির্বাচিত সরকার। তবে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে মনে হয় এরই মধ্যে টাল বাহানা শুরু হয়েছে বা চলছে। কথিত অল্প সংস্কার আর বেশি সংস্কারের অভিনব আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের ভবিষ্যৎ।
গত দেড় দশকে ভোটার তালিকায় প্রায় সাড়ে তিন কোটি নতুন ভোটার সংযুক্ত হয়েছে উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, এই নতুন ভোটাররা আজ পর্যন্ত একটা জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার সুযোগ পায়নি। পতিত পরাজিত পলাতক স্বৈরাচারের কাছে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা কিংবা নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না। সুতরাং সংস্কার ইস্যুর পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের দৃশ্যমান প্রস্তুতি নেওয়া উচিত বলে মনে করি।
অতীতে তত্ত্ববাধয়ক সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা তুলে ধরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে দেখেছি তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাসের মধ্যেই সফলভাবে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছে। সুতরাং অতীতে এই বাংলাদেশে রেকর্ড রয়েছে, তিন মাসের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা সম্ভব। কিন্তু আজ আমরা দেখছি, ১০ মাস পার হয়ে গেলেও অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করছে না। আমরা ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে জনগণের ভোটে জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক জনগণের কাছে দায়বদ্ধ একটি সরকার দ্রুত দেখতে চাই।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবেই। আবারও আমরা বলতে চাই, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’ নতুন প্রজন্মসহ দেশবাসীর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন যাতে অনুষ্ঠিত হয় তার প্রস্তুতি নিতে শুরু করুন। কারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে, কারা আপনাদের প্রতিনিধি হবে, জাতীয় নির্বাচনে আপনারা ভোট দিয়ে আপনাদের সেই প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করবেন।
সমাবেশে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেনকে দায়িত্ব বুঝিয়ে না দেওয়া নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারেক রহমান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পলাতক স্বৈরাচারের সময়ে আমরা দেখেছি তারা কীভাবে আদালতকে অবজ্ঞা করেছে। আদালতের রায়কে অবজ্ঞা করেছে। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, পলাতক স্বৈরাচারের পরে যেই সরকারের কাছে দেশের মানুষ আশা করেছিল যে আইনের প্রতি সম্মান থাকবে, আমরা দেখেছি আদালতের রায়ের প্রতি সম্মান না দেখিয়ে যারা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করেছে। স্বৈরাচারের সেই একই যে ঘটনা সেটির পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে পাচ্ছি।
যারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখায় না, যারা আদালতের নির্দেশকে অবজ্ঞা করে, তাদের কাছ থেকে কতটুকু সংস্কার আশা করতে পারি—এমন প্রশ্ন তোলেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, পুথিগত সংস্কারের চেয়ে ব্যক্তি মানসিকতার সংস্কার অনেক বেশি জরুরি।
তারেক রহমান বলেন, ইশরাকের ক্ষমতা গ্রহণ বা শপথে বাধা সৃষ্টি করে আজ আমরা আবারও স্বৈরাচারি মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাচ্ছি। নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতাই কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান পুঁজি। তাই তাদের প্রতি আমাদের আহ্বান থাকবে, পরামর্শ থাকবে— জনগণের বিশ্বাস ভালোবাসা নষ্ট হয় অন্তর্বর্তী সরকারের এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক হবে না।
একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, গণতন্ত্রকামী জনগণ এবং গণতন্ত্রের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোকে দয়া করে প্রতিপক্ষ বানাবেন না। যদি আপনাদের কেউ রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকতে চায় তাহলে সরকার থেকে পদত্যাগ করে জনগণের কাতারে আসুন। নির্বাচন করুন। যদি ভবিষ্যতে নির্বাচনে জনগণের রায় পান তাহলে আবার সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করুন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত বলেন, তরুণ জনগোষ্ঠীকে প্রাধান্য দিয়ে দলের কর্ম পরিকল্পনা ঢেলে সাজানো হচ্ছে।
তারেক রহমান বলেন, জনগণের বিশ্বাস ও ভালোবাসা নষ্ট হয় এমন কোন পদক্ষেপ অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া ঠিক হবে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিপক্ষ বানাবেন না।
দেশকে এগিয়ে নিয়ে বিএনপির একাধিক উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে দাবি করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, যেকোনো দলের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হলে দরকার নির্বাচিত সরকার। তবে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা চলছে। অল্প ও বেশি সংস্কারের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে এই আলোচনা। মনে হচ্ছে সরকারের কোনো ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের কেউ যদি রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকতে চায় তাহলে সরকার থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচন করুন। যদি জনগণের রায় পান তাহলে আবার সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়েছিলাম। আমরা তার পদত্যাগ চাইনি। কিন্তু তিনি পদত্যাগের নাটক করেছেন। আমরা ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চেয়েছি। নিরপেক্ষ সরকার, গণতন্ত্র ও নির্বাচনের দাবিতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। আমাদের সবার লক্ষ্য হোক সবার আগে বাংলাদেশ। তারেক রহমানের নেতৃত্বে আগামীর বাংলাদেশ হবে নতুন বাংলাদেশ।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা এমন রাষ্ট্র নির্মাণ করতে চাই যেখানে তারুণ্যের অংশগ্রহণ থাকবে। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছি। অত্যন্ত সুকৌশলে ঐক্যে ফাটল ধরার চেষ্টা চলছে। আমরা ফ্যাসিস্ট সরকারের নির্যাতন-নিপীড়ন ও তাদের লুটপাটের কথা ভুলতে বসেছি। আমরা গণতন্ত্রের জন্য রক্ত দিয়েছি। আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
তিনি বলেন, ব্রিটিশ শাসন আমলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ২০০ বছরে যা লুটপাট করেছে তারচেয়ে বেশি সম্পদ লুট করেছে আওয়ামী লীগ। তারা ৩০ লাখ কোটি টাকা পাচার করেছে। ৪ লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ। বিদ্যুৎ ও ব্যাংক খাতে লুটপাট চালিয়েছে। ব্যাংক থেকে যত টাকা লুট করেছে তা দিয়ে ৩৬টা পদ্মা সেতু বানানো যেত। আমাদের একমাত্র শত্রু আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ কখনো গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেনি। তারা গণতন্ত্র হত্যাকারী।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, তারেক রহমানের নেতৃত্বে যারা গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করেছি তারা নাকি বিভিন্ন দেশের এজেন্ট হয়ে গেছি। আসলে যারা আমাদের অন্তরায় মনে করে তারা এসব বলে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, আমাদের একমাত্র শত্রু আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা। তারা গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে। আমরা চাই আর কোনও স্বৈরাচারের উৎপত্তি যেন না হয়। সে জন্য সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। তিনি আদালতের রায় অনুযায়ী ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে শপথ দেয়ার দাবি জানান।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনা বিগত দিনে ব্যাপক দুর্নীতি করেছেন। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, দুর্নীতির টাকা দিয়ে ২৪টি পদ্মা সেতু করা যেতো।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ যারা নির্ধারণ করবে তারাই আজকের তরুণ প্রজন্ম। আর এই বিষয়টি জানান দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন তারেক রহমান।
তিনি বলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছাত্রদল-যুবদল প্রতিষ্ঠা করেছেন। একইভাবে তার সুযোগ্য পুত্র বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তরুণ সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। আজকের এই দিনে আমরা তরুণ সমাজের কাছে আবেদন জানাবো জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে ভূমিকা রাখার জন্য।
ড. খন্দকার মোশাররফ বলেন, দীর্ঘদিন আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে আমাদের কী ধরনের নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে আপনারা তা জানেন। মিথ্যা মামলায় খালেদা জিয়াকে কারা ভোগ করতে হয়েছে, তারেক রহমানকেও বানোয়াট মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছিল। আমাদের একজন কর্মীও বাদ যায় নাই যারা জেল খাটে নাই, মামলার শিকার হয় নাই। আর এই নির্যাতনের শেষ হয়েছে ছাত্র যুবকদের আন্দোলনের মাধ্যমে। আমরা এই সরকারকে সমর্থন ও সাহস দিয়ে প্রত্যাশা করেছি অতি দ্রুত মানুষের নির্বাচনের অধিকার ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু দশ মাস অতিক্রম করছে আমরা দেখছি জনগণের অধিকারের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ভোটের অধিকার। আর ভোট এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার মতো এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার।
তিনি আরও বলেন, আমরা বারবার তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি কেন অতি দ্রুত নির্বাচন দরকার। কারণ পতিত সরকার দেশে-বিদেশে নির্বাচনকে বিলম্বিত করার জন্য নানা ষড়যন্ত্র করছে। তা না হলে সংস্কার ও মামলার বিষয়টিকে নির্বাচনের সঙ্গে কেন যুক্ত করা হবে।
খালেদা জিয়া টোয়েন্টি থার্টি (২০৩০) ভিশন ঘোষণা করেছেন এবং তারেক রহমান ১৯ দফা কর্মসূচি নিয়ে জনগণের কাছে তুলে ধরছেন। অর্থাৎ আমরা সংস্কার নিয়ে সব সময় চিন্তা করেছি। কিন্তু সকল সংস্কার এক কথায় করা যাবে না, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। নির্বাচনের সংস্কার অতি দ্রুত শেষ করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে। না হলে এই ষড়যন্ত্র জনগণকে নিয়ে মোকাবিলা করা হবে বলেও উল্লেখ করেন এই নেতা।
জাতীয়তাবাদী যুবদলের সভাপতি মোনায়েম মুন্নার সভাপতিত্বে ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান এবং ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছিরের সঞ্চালনায় তারুণ্যের সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ।