নিজস্ব প্রতিবেদক :
বিগত সরকারের সময়ে আর্থিক খাতে নজিরবিহীন অপশাসনের মাধ্যমে এ খাতকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
সোমবার (০২ জুন) বিকেলে রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম বিটিভিসহ অন্যান্য বেসরকারি গণমাধ্যমে একযোগে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন তিনি। এটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম বাজেট। এর আগে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম ২০০৭-০৮ ও ২০০৮-০৯ অর্থবছরের বাজেট টেলিভিশন ও বেতারের মাধ্যমে ঘোষণা করেছিলেন।
বাজেট প্রস্তাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আর্থিক খাতে ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে। অনেক ঋণ খেলাপি হয়ে গেলেও সেগুলো বারবার পুনঃতফসিলিকরণের মাধ্যমে আসল অবস্থা গোপন রাখা হয়েছে। তবে বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ঋণ শ্রেণিকরণ ও প্রভিশনিং পদ্ধতি চালু করেছে। এর ফলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র সামনে আসতে শুরু করেছে। ২০২৩ সালের জুন মাসে খেলাপি ঋণের হার ছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ২০ শতাংশে। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
তিনি বলেন, বিগত ১৫ বছরে আর্থিক খাতে নজিরবিহীন অপশাসনের মাধ্যমে এ খাতকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ৫ আগস্ট ২০২৪ এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে, ব্যাংকিং খাতের দীর্ঘদিনের কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও আমানতকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে সরকার গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি, তারল্য সংকট, দেউলিয়াত্ব বা অস্তিত্বের জন্য হুমকি এমন সব ঝুঁকির সময়োপযোগী সমাধান এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণে ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫ প্রণয়ন করা হয়েছে।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের এবারের বাজেট কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত আমরা বিগত বাজেটের চেয়ে ছোট আকারের বাজেট আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করছি।
তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধি-কেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে আমরা চেষ্টা করেছি সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণায় জোর দিতে। তাই প্রথাগত ভৌত অবকাঠামো তৈরির খতিয়ান তুলে ধরার পরিবর্তে আমরা এবারের বাজেটে প্রাধান্য দিয়েছি মানুষকে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, জীবিকার নিরাপত্তা এবং বৈষম্যহীন পরিবেশ—এ অত্যাবশ্যক উপাদানগুলো ছাড়া যে কোন রাষ্ট্র অকার্যকর হয়ে পড়ে, দুর্বল হয় সমাজের ভিত।
তিনি বলেন, এবারের বাজেটে তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুশাসন, নাগরিক সুবিধা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয়ের উপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমাগত যে সকল সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে তার সুবিধা ভোগ এবং যে সকল চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে তা মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার দিকেও মনোযোগ দেয়া হয়েছে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, সংস্কারের অংশ হিসেবে তিনটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে, যার প্রধান উদ্দেশ্য হলো— (ক) ব্যাংকিং খাত সংস্কার কর্মসূচির ভিত্তি তৈরি করতে ব্যাংকগুলোর সম্পদের ব্যাপক গুণগত পর্যালোচনা করা, (খ) নীতি ও প্রবিধানসমূহের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিতকরণে এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সুশাসন বজায় রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা এবং (গ) দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চুরি/পাচার হওয়া সম্পদ উদ্ধারে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা।
তিনি বলেন, নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনীতিকে সচল রাখতে জ্বালানির পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং একইসাথে তা যথাসম্ভব সাশ্রয়ী রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে নীতিগতভাবে আমরা বিদ্যুতের মূল্য আপাতত: না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
তিনি আরো বলেন, বিদ্যুৎ খাতে প্রদত্ত ভর্তুকির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস করার লক্ষ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সার্বিক ব্যয় ১০ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিগুলোও পর্যালোচনা করছি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমাতে এনার্জি অডিট করার উদ্যোগ নিয়েছি। এ বছরের মধ্যেই অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৬৪৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করার এবং ২০২৮ সালের মধ্যে স্থানীয় কূপ থেকে অতিরিক্ত ১৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।