লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ভয়াবহ দুটি বিস্ফোরণের ঘটনায় বহু হতাহত হয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানী বৈরুতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে কমপক্ষে ৭৮ জন নিহত ও ৪ হাজার মানুষ আহত হওয়ার পর সেখানে আজ বুধবার থেকে তিন দিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে।
আজ মন্ত্রীপরিষদের জরুরি বৈঠক আহ্বান করেছেন প্রেসিডেন্ট মিশেল আওন।
শহরের চারদিকে লাশ আর লাশ। রক্তাক্ত মানুষ দিশেহারা। হাসপাতালে হৃদয় বিদারক দৃশ্য। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে বিলাসবহুল হোটেল, আবাসিক ভবন। আহতদের চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারি হচ্ছে। এমন এক ধ্বংসলীলাকে সামনে রেখে কাঁদছে লেবানন।
লেবাননের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, যে গুদাম থেকে বিস্ফোরণ হয়েছে, সেখানে ৬ বছর ধরে অনিরাপদ অবস্থায় মজুদ রাখা হয়েছিল ২৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট। এ ছাড়া জরুরি তহবিল থেকে ১০ হাজার কোটি লিরা বা প্রায় ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার অবমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
আরও পড়ুন : আদালতে দোষী সাব্যস্ত নাজিব রাজাক
লেবাননে রেডক্রসের প্রধান জর্জ কেত্তানি স্থানীয় মিডিয়াকে বলেছেন, আমরা যা প্রত্যক্ষ করছি, এটি একটি ‘হিউজ ক্যাটাস্ট্রোফ’ বা ভয়াবহ বিপর্যয়। সব স্থানেই মানুষ মারা গেছেন। সর্বত্রই হতাহত হয়েছেন সাধারণ মানুষ। উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তূপের নিচে অব্যাহতভাবে উদ্ধার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। আশঙ্কা করা হচ্ছে মৃতের সংখ্যা আরো অনেক বৃদ্ধি পেতে পারে।
মঙ্গলবার কর্মকর্তারা বলেছেন, ওই বিস্ফোরণের ঘটনায় এরই মধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে। এর জন্য দায়ীদের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ শাস্তির মুখোমুখি করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে লেবাননের সুপ্রিম ডিফেন্স কাউন্সিল।
রিপোর্টে বলা হচ্ছে, যে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট থেকে বিস্ফোরণ হয়েছে বলে অনুমান, তা ২০১৩ সাল পর্যন্ত বন্দরে একটি জাহাজে আনলোডের অপেক্ষায় ছিল। সেখান থেকে তা সরিয়ে নিয়ে একটি গুদামে রাখা হয়। সেখানেই ওই বিস্ফোরণ ঘটে মঙ্গলবার।
এতে এক অবর্ণনীয় অবস্থার সৃষ্টি হয় রাজধানী বৈরুতে। বিস্ফোরণের ভয়াবহতা এতটাই বেশি ছিল যে ২৪০ কিলোমিটার দূরে প্রতিবেশী দেশ সাইপ্রাস থেকে তা অনুভূত হয়েছে। রাতের আকাশে আগুন, ধোয়া আর ধ্বংসাবশেষ উঠে যেতে থাকে উপর থেকে আরো উপরে।
চারদিকে তখন মৃত্যু আতঙ্ক। মানুষ ছুটছে দিশেহারা। রক্তাক্ত মানুষ। আহত মানুষ। আহত সন্তান কোলে নিয়ে দিকভ্রান্তের মতো ছুটছেন কোনো এক পিতা। হলিউডের একশন সিনেমার মতো একের পর এক ভবন বিস্ফোরণে গগণ বিদারী আওয়াজ করছে। রাস্তার পাশে ছিটকে পড়ে আছে পুড়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কোনো গাড়ি।
কংকালের মতো দাঁড়িয়ে আছে কোনো সুদৃশ্য অট্রালিকা। এ দৃশ্য বর্ণনা করার মতো নয়। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, আমার চারপাশে সব ভবন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। আমি হেঁটে যাচ্ছি মৃত্যু উপত্যকার ভিতর দিয়ে। পায়ের নিচে শুধু কাচের গুঁড়ো। যতদূর চোখ যায় শুধু ধ্বংসস্তূপ। হাসপাতাল উপচে পড়ছে আহতদের ভিড়ে। স্থান সংকুলান হচ্ছে না সেখানে। স্যালাইন পুশ করা রোগীকে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে স্বজনদের।
এদিকে বিবিসি, রয়টার্স ও আল-জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, বৈরুতের বাসিন্দারা দূর থেকেও ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখতে পান। রাজধানীর বেশ কিছু এলাকা বিস্ফোরণের পর কেঁপে ওঠে। শহরে প্রাণকেন্দ্র থেকে ঘন ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠতে দেখা গেছে।
বিস্ফোরণের শব্দে বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী সাদ হরিরির সদর দপ্তরসহ বিস্ফোরণে অনেক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নেভাতে ঘটনাস্থলে ছুটে গেছেন।
লেবাননের একটি হাসপাতালের নার্স বলেছেন, এখানে আহত ৪০০ জনের চিকিৎসা চলছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ঘটনাস্থলের ১০ কিলোমিটার দূরের বাড়িগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এলাকায় স্থানীয়ভাবে তোলা ছবি ও ভিডিওতে ভাঙা কাচ ও দরজা-জানালার ভগ্নাংশ রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। লেবাননের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, বেশ কিছু মানুষ হতাহত হয়েছেন এবং বড় ধরনের সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। টুইটারে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, গোলাপি রঙের ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশে উঠছে।
বুধবার বিবিসির খবরে বলা হয়, শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অন্তত ৭৩ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তারা জানিয়েছেন, আরও তিন হাজারের বেশি লোক আহত হয়েছে। বহু ঘরবাড়ি ও গাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে।
লেবাননের অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা বিষয়ক প্রধান বলেছেন অত্যন্ত বিস্ফোরক রাসায়নিক পদার্থের গুদামে এই বিস্ফোরণ ঘটেছে। কর্মকর্তারা বলছেন, এই বিস্ফোরণ দুর্ঘটনা। পরিকল্পিতভাবে এই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়নি। তারা বলছেন, গুদামে ছয় বছর ধরে মজুত রাখা অত্যন্ত বিপদজনক বিস্ফোরক থেকে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।
প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব এই ঘটনাকে বিপর্যয় বলে বর্ণনা করেছেন এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছেন। প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন এক ট্ইুট বার্তায় বলেছেন, কোন গুদামে ২,৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের মত বিস্ফোরক অনিরাপদভাবে মজুত রাখার বিষয়টি ‘অগ্রহণযোগ্য’।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ধ্বংসস্তুপের নিচে মানুষকে আটকা পড়ে থাকতে দেখা গেছে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, বিস্ফোরণের আওয়াজ ছিল তীব্র ও কান ফাটানো। ভিডিও ফুটেজে অনেক গাড়ি এবং ভবন বিধ্বস্ত হয়েছে বলে দেখা গেছে।
বন্দর এলাকা থেকে পাওয়া ভিডিওতে প্রথম বিস্ফোরণ স্থল থেকে ধোঁয়ার কুন্ডলি উঠতে দেখা যায়। টুইটারে অনেকে মোবাইল ফোনে তোলা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের ভিডিও শেয়ার করেন।
টুইটারে পোস্ট করা এই ভিডিওর সাথে বলা হয় তারা বিস্ফোরণ স্থল থেকে ১০ কিমি দূরে থাকেন এবং বিস্ফোরণে তাদের ভবনের কাঁচ ভেঙে গেছে।বিস্ফোরণের পর কুণ্ডলি পাকিয়ে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। প্রথম বিস্ফোরণের পর আরেকটি আরও বড় বিস্ফোরণের ধোঁয়ায় আশপাশের ভবনগুলো ঢেকে যেতে দেখা যায়।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী বিবিসিকে বলেন, বিস্ফোরণ এত শক্তিশালী ছিল যে তার মনে হয়েছিল তিনি মারা যাবেন। হাসপাতাল আহতদের ভিড়ে উপচে পড়েছে বলে বলা হচ্ছে।বিবিসির একজন সংবাদদাতা জানিয়েছেন নিকটবর্তী হাসপাতালে এত আহত মানুষকে আনা হয়েছে যে সেখানে স্থান সঙ্কুলান হচ্ছে না।
দমকল কর্মীরা অনেকগুলো আগুন নেভাতে হিমশিম খেয়েছে। প্রেসিডেন্ট মিশেল আউনের সভাপতিত্বে সুপ্রিম ডিফেন্স কাউন্সিলের জরুরি বৈঠক হয়েছে এবং সরকারকে রাজধানী বৈরুতে দু সপ্তাহের জন্য জরুরি অবস্থা জারির সুপারিশ করা হয়েছে।
এই বিস্ফোরণ ঘটেছে একটা স্পর্শকাতর সময়ে। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাফিক হারিরিকে ২০০৫ সালে হত্যা মামলার রায় ঘোষণার কথা রয়েছে এ সপ্তাহেই। গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে মি. হারিরির হত্যায় চারজন সন্দেহভাজনের মামলার রায় জাতিসংঘের একটি ট্রাইব্যুনালের দেবার কথা শুক্রবার।