বুধবার, ২২ জানুয়ারী ২০২৫, ১২:৩২ পূর্বাহ্ন

করোনাকালে ছাঁটাই ও বেতন সঙ্কোচনের চাপ

ড. মাহফুজ পারভেজ
আপডেট : শনিবার, ১৮ জুলাই, ২০২০
ফাইল ছবি

ছয়মাস অতিক্রমকালে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস লক্ষ লক্ষ মানুষকে আক্রান্ত করার এবং বহুজনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার পাশাপাশি সামগ্রিক আর্থিক বিপর্যয়ের সঙ্কেত দিচ্ছে। করোনার কারণে সার্বিক স্থবিরতা, ঘরবন্দী ও লকডাউনে জন্য যে অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা এখন ক্রমেই প্রকট হচ্ছে এবং চাকরিজীবীদের ছাঁটাই ও বেতন সঙ্কোচনের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

বিশ্বের বিভিন্ন স্থানেই কর্মী ছাটাইয়ের ঘটনা ঘটছে করোনার সঙ্কুল পরিস্থিতির কারণে। বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে এবং আংশিক বেতন দিয়ে কাজ সামলাতে বাধ্য হচ্ছে বহু সংস্থা।

ভারতে একটি সংস্থার ক্ষেত্রে চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণের খবর এসেছে। খরচ কমিয়ে লোকসান ঠেকিয়ে প্রতিষ্ঠান বাঁচাতে কর্মী-অফিসারদের বেতনহীন ছুটিতে পাঠাচ্ছে এয়ার ইন্ডিয়া (এআই)। বিভিন্ন আঞ্চলিক দফতরের কাছে নির্দেশ গিয়েছে, যে কর্মীরা অসুস্থ, যাঁদের কর্মদক্ষতা কম বা সময় মতো যাঁদের পরিষেবা চেয়েও পাওয়া যায়নি, তাঁদের তালিকা পাঠাতে হবে। ঠিক হয়েছে, ৬ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত এই সব বাছাই করা কর্মীদের বেতনহীন ছুটিতে পাঠানো হবে। সেই ছুটি ৫ বছর পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে।

বাংলাদেশের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান ছাটাইয়ের পাশাপাশি বেতন সঙ্কোচনের পথে চলতে বাধ্য হয়েছে। ব্যাংক, পোশাক রফতানি, সেবা ও সার্ভিস ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো এক্ষেত্রে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত। অনলাইন, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতেও করোনাকালের আর্থিক চাপ প্রবলভাবে পড়েছে।

এর বাইরে বিভিন্ন মার্কেটের দোকান, আবাসিক ও খাবার হোটেল, প্রিন্টিং প্রেস, কম্পিউটার সেন্টার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে মন্দার আঘাত লেগেছে। অনেকগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। বাকিগুলো চলছে সংক্ষিপ্ত পরিসরে অল্প কর্মচারী নিয়ে।

একটি বিরাট আর্থিক আঘাতের ক্ষত দেখা যাচ্ছে প্রাথমিক পর্যায়ের বাংলা ও ইংরেজি মিডিয়ামের বেসরকারি স্কুলগুলোতে। করোনার কারণে বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে পারছে না। অভিভাবকেরাও নানা সমস্যায় জর্জরিত। ফলে তাদের পক্ষে বেতন দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। এমতাবস্থায় স্কুলের শিক্ষকদেরও বেতন পরিশোধ করা যাচ্ছে না। এমনকি, এ বিষয়ে বেশ কিছু নামীদামি স্কুলেও বিতণ্ডা চলছে মালিক, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে।

ছাঁটাই ও বেতন সঙ্কোচনের চাপ—হাট, বাজার, স্কুলের বেতন ছাড়াও গভীর প্রভাব ফেলেছে বাড়িভাড়ার ক্ষেত্রে। নিম্ন ও মাঝারি চাকরিজীবীদের অনেকেই এই সঙ্কোচনের ফলে পরিবার-পরিজনকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। অসংখ্য বাসা-বাড়ি ভাড়াটে পাচ্ছে না।

সন্দেহ নেই, সঙ্কট দিনে দিনে ঘনীভূত হয়ে আরো ব্যাপক হবে এবং মানুষের আর্থিক বিপদ আরো বাড়বে, যার তীব্র প্রভাব পড়বে পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে এবং সারা বিশ্বে। চোখের সামনে দিয়ে এভাবেই চলবে মানুষের নিঃস্বকরণ ধারা।

উন্নত দেশগুলো করোনার কারণে উদ্ভূত স্বাস্থ্য সমস্যার পাশাপাশি আর্থিক সঙ্কট মোকাবেলার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের সক্ষমতা বেশি হওয়ায় সঙ্কট মোকাবেলার সামর্থ্যও অধিক।

কিন্তু এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলো এই সঙ্কট মোকাবেলায় যথেষ্ট শক্তিশালী অবস্থানে নেই। আর্থিক সুশাসনের অভাব ও বহু অনিয়মে দেশগুলোর অর্থনীতি জর্জরিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেশগুলোর অর্থনীতি পরনির্ভরশীল এবং ঋণের মাধ্যমে প্রাপ্ত টাকার দ্বারা পরিচালিত। এসব ভঙ্গুর ও দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোর পক্ষে ধাবমান আর্থিক বিপদ সামাল দেওয়া কতটুকু সম্ভব হবে, সেটাই এক বিরাট চ্যালেঞ্জ।

বস্তুত, করোনার আক্রমণের ফলে বিশ্ব ও বিশ্ববাসী কেবল স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েনি, ভয়ঙ্কর আর্থিক বিপদেও পড়েছে। কোটি মানুষের চাকরিচ্যুতি ও বেকারত্বের সঙ্গে সঙ্গে মারাত্মক খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষের বিপদ কড়া নাড়ছে দরজায়। শোনা যাচ্ছে অশনি সঙ্কেত।

চারিদিকে যখন করোনার প্রকোপে স্বাস্থ্য, অর্থ, খাদ্য নিরাপত্তাসহ বহুবিধ বিপদ অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরছে, তখন আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু? শুধু আজকের প্রস্তুতিই নয়, সামনের দিনের সম্ভাব্য সঙ্কটের বিষয়েও প্রস্তুতি রাখা জরুরি। আশা করি সংশ্লিষ্টরা এসব বিষয় নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন।

লেখক : প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ বিভাগের আরো সংবাদ

আবহাওয়া