Dhaka সোমবার, ২১ জুলাই ২০২৫, ৫ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সিসিটিভিতে এএসপিকে হত্যার ভয়ঙ্কর ভিডিও

সংগৃহীত ছবি

হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিমকে পিটিয়ে হত্যার দৃশ্য। কি নির্মম সেই দৃশ্য। মানুষ এতটা বর্বর হতে পারে তা ভিডিওটি দেখেও বিশ^াস হতে চায় না। গত সোমবারের ওই নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং ভাইরাল হয়।

সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম সর্বশেষ বরিশাল মহানগর পুলিশের (বিএমপি) ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত ছিলেন। পুলিশের এই কর্মকর্তাকে পিটিয়ে হত্যার বর্ণনা দিয়েছেন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী এবং কর্মচারীরা।

রাজধানীর আদাবরে অবস্থিত মাইন্ড এইড হাসপাতাল যেন একটি টর্চার সেল। আদাবরের বাইতুল আমান হাউজিং সোসাইটির মূল সড়কের সঙ্গে ২৮১ নম্বর বাড়ি। তিনতলা বিশিষ্ট বাড়িতে গড়ে তোলা হয়েছে ‘মাইন্ড এইড মাইন্ড কেয়ার ইনস্টিটিউট’।

ভবনের দোতলার কর্নারের একটি সাউন্ডপ্রুফ রুমে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে পুলিশের সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিমকে। আনিসুলের পরিবারের সদস্যদের একটিই দাবি নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের বিচার, জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।

সরজমিন দেখা গেছে, ভবনের দ্বিতীয় তলার পূর্ব পাশের ছোট্ট কক্ষটি ‘সাউন্ড প্রুফ’। অনেকটা ভয়েস রেকর্ডিং বা স্টুডিও রুমের আদলে। দেয়ালের ভেতরের অংশ ফোম দিয়ে মোড়ানো। রয়েছে দু’টি মাত্র বিছানা। রুমের দৈর্ঘ্য- প্রস্থ সর্বোচ্চ চার ফিট বাই সাত ফিট। রুমটিতে একটি মাত্র দরজা। নেই কোনো জানালা। বাতাস চলাচলেরও কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। এসি, লাইট আর সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো। এই রুমেই চিকিৎসার নামে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে আনিসুলকে।

বাবার এই আদর আর পাবে না ছোট্ট শিশুটি
ছবিতে এএসপি আনসিুল করিম, তার ছেলে ও স্ত্রী

হাসপাতাল থেকে উদ্ধার করা সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, সাত থেকে আটজন লোক আনিসুল করিমকে জোর করে টেনে একটি কক্ষে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে সবাই মিলে তাকে উপুড় করে ফেলে চেপে ধরে রেখেছে। দুই ব্যক্তিকে দেখা যায় তারা আনিসুলের পিঠে ও ঘাড়ে কনুই দিয়ে আঘাত করছে।

বাকিরা তাকে চেপে ধরে রাখছে। এ সময় তার হাত পেছনের দিকে মুড়িয়ে একটি নীল রঙের কাপড় দিয়ে বাঁধা হয়। পরে তাকে সোজা করে শুইয়ে দেয়া হয়। এ সময় আনিসুলকে নড়াচড়া করতে দেখা যায়নি। তখন হাসপাতালের দুই কর্মীকে দেখা যায় তারা আনিসুলের মুখে পানি ছিটাচ্ছে। এর কয়েক মিনিট পরে সাদা অ্যাপ্রোন পরা এক নারী কক্ষে প্রবেশ করেন।

তিনি আনিসুলের মাথায় হাত দিয়ে পরীক্ষা করেন। আনিসুলের বুক চেপে সিপিআর দিতে দেখা যায়। অ্যাপ্রোন পরা আরেক নারী তার রক্তচাপও মেপে দেখেন। কিন্তু তাতেও সাড়া দেননি তিনি। এর কিছু পরে তার হাতের বাঁধন খুলে দেয়া হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আনিসুলকে নির্ধারিত কক্ষটির দিকে নেয়া হয়। তখন তিনি হঠাৎ করে রেগে যান। তিনি কোনোভাবেই সেই রুমে যেতে চাননি।

এ সময় সকলে তাকে জোর করে ঠেলে এবং ধাক্কা দিয়ে রুমের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। কেউ পেছন থেকে তার পিঠে সজোরে ধাক্কা মারছিল তখন। এ সময় আনিসুল চিৎকার করে সবাইকে বলেছেন, ‘আমার গায়ে টাচ করছেন কেন। জানেন, আমি একজন পুলিশ অফিসার।’

গত দু’মাস যাবৎ হাসপাতালে রান্না করেন রুমা বেগম। ঘটনার সময় তিনি রান্নাঘরে ছিলেন জানিয়ে রুমা বলেন, হট্টগোল শুনে আর সকলের সঙ্গে আমিও সিসি ক্যামেরায় ভিডিও ফুটেজ দেখতে যাই। ভিডিও ফুটেজে নির্যাতনের চিত্র দেখে আঁতকে উঠি।

আরও পড়ুন : হাসপাতালের কর্মচারিদের মারধরে সিনিয়র এএসপির মৃত্যু (ভিডিও)

রুমার সহকারী আরেক নারী শারমিন আক্তার লিমা বলেন, ওই পুলিশ সদস্য জানতেন তাকে বাথরুমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাকে যে দোতলায় নির্যাতন করা কক্ষটিতে নেয়া হচ্ছে- এটা জানতেন না। এ সময় সে কক্ষটিতে প্রবেশ করতে না চাইলে পেছন থেকে ওয়ার্ডবয়রা মিলে তাকে ধাক্কা মারে।

এ বিষয়ে তখন তার পরিবারের সদস্যরা কিছুই জানতেন না। তারা নিচে বসে ভর্তির যাবতীয় তথ্য যাচাই-বাছাই করছিলেন। পুলিশ কর্মকর্তা আনিসুল মারা যাওয়ার অনেক পরে তারা জানতে পারেন।

আনিসুলের ভাই রেজাউল করিম সবুজ বলেন, পারিবারিক এবং চাকরির একটি ট্রেনিং সংক্রান্ত বিষয়ে আমার ছোট ভাই আনিসুল মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। তার রক্তচাপজনিত সমস্যা ছিল। হৃদরোগও ছিল। কিন্তু এ দু’টির কোনোটিই প্রকট ছিল না। হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পিটুনিতে তার মৃত্যু হয়েছে।

সম্প্রতি মানসিকভাবে অস্থিরতা, হঠাৎ রেগে যাওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যা বোধ করলে গত সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তাকে মাইন্ড এইড হাসপাতালে নিয়ে যান পরিবারের সদস্যরা। তারা ভর্তির ফরম পূরণ করছিলেন। ওই সময়ে হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারী আনিসুলকে দোতলায় নিয়ে যায়। তাকে দোতলায় নিয়ে তখনই পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে কিন্তু তখন পর্যন্ত তা জানতেন না স্বজনরা।

হত্যাকাণ্ডের সময় হাসপাতালের ব্যবস্থাপক আরিফ মাহমুদও সেখানে উপস্থিত ছিলেন বলে জানান আনিসুলের ভাই রেজাউল করিম সবুজ। এরপর আনিসুলকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানকার চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

মাইন্ড এইড হাসপাতালে আনিসুলকে হত্যার অভিযোগে গত সোমবার রাতে তার বাবা বাদী হয়ে আদাবর থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। ইতিমধ্যে আনিসুলকে হত্যার অভিযোগে মাইন্ড এইড হাসপাতালের ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয় ১০ জনকে। পরে হাসপাতালের এক পরিচালককে আটক করা হয়। পুলিশ গ্রেপ্তার ১০ জনের প্রত্যেকের ১০ দিন করে রিমান্ড চায়। সাতদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ মঙ্গলবার দুপুরে এ বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন- হাসপাতালের মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ, কো-অর্ডিনেটর রেদোয়ান সাব্বির, কথিত ফার্মাসিস্ট তানভীর হাসান, ওয়ার্ডবয় জোবায়ের হোসেন, তানিফ মোল্লা, সজীব চৌধুরী, অসীম চন্দ্র পাল, লিটন আহাম্মদ, সাইফুল ইসলাম ও শেফ মো. মাসুদ।

পুলিশের এই উপ-কমিশনার বলেন, আমরা মনে করি এটি হত্যাকাণ্ড। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা পুলিশের কাছে হত্যার দায় স্বীকার করেছে। হত্যার ঘটনায় কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। যারাই জড়িত থাক, সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। আদাবর থানার উপ-পরিদর্শক (এস আই) মো. শাহজাহান জানান, মঙ্গলবার বেলা আড়াইটার দিকে হাসপাতালটি সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। ঘটনাস্থলে দুপুরে আসেন ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন ডা. মঈনুল আহসান।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, হাসপাতালটি অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছিল। কিন্তু অনুমোদন দেয়া হয়নি। তাই এটা কোনো হাসপাতালই না। সরকারি কোনো অনুমোদন না থাকলেও হাসপাতালটি দুই বছর ধরে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এ বছরের শুরুতে তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করা হয়। তবে প্রতিষ্ঠানটি চিকিৎসা দেয়ার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল না। তাই অনুমতি পায়নি।

ওদিকে সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিমকে হত্যার প্রতিবাদে মাইন্ড এইড হাসপাতালের সামনে মানববন্ধন করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশকিছু প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থী। তাদের অভিযোগ, এই হাসপাতালে আনিসুল করিমকে হত্যা করা হয়েছে। তারা এই ঘটনার দ্রুত বিচার দাবি করেছেন।

নিহত আনিসুলের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, চার ভাই- বোনের মধ্যে আনিসুল সবার ছোট। গাজীপুরের জয়দেবপুরের রাজবাড়ী সদরে তাদের বাসা। বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাইফুদ্দিন আহমেদ। আনিসুল ছোট বয়স থেকেই মেধাবী ছিলেন। আনিসুল ৩১তম বিসিএসের পুলিশ ক্যাডারে প্রথম স্থান অধিকার করেন।

তিনি সর্বশেষ বরিশাল মহানগর পুলিশে কর্মরত ছিলেন। তিনি এক সন্তানের জনক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের ৩৩ ব্যাচে দ্বিতীয় হন।
আনিসুলের স্ত্রী শারমিন সুলতানা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। এই দম্পতির চার বছর বয়সী সাফরান নামে একটি ছেলে রয়েছে।

এদিকে গাজীপুর থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানান: সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. আনিসুল করিমের দাফন হয়েছে গাজীপুরের কেন্দ্রীয় গোরস্থানে। নিহতের গাজীপুরের বাসায় চলছে শোকের মাতম। আত্মীয়স্বজনসহ এলাকার কেউই মেনে নিতে পারছে না হাসপাতাল কর্মীদের বর্বর আচরণে নিহতের ঘটনা।

দ্রুততম সময়ের মধ্যে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাচ্ছেন তারা। আনিসুল করিমের গ্রামের বাড়ি কাপাসিয়া উপজেলায় হলেও ছোটবেলা থেকেই থেকেছেন গাজীপুর জেলা শহরের বরুদা এলাকায়। শহরের ঐতিহ্যবাহী স্কুল রানী বিলাসমণি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। এক সন্তানের জনক এই পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যু কোনোভাবে মেনে নিতে পারছেন না পরিবারের লোকজন।

 

ভিডিওটি দেখতে ক্লিক করুন:

জনপ্রিয় খবর

আবহাওয়া

বিমানের ফ্লাইটে ফের ত্রুটি, শারজাহ না গিয়ে ফিরে এলো ঢাকায়

সিসিটিভিতে এএসপিকে হত্যার ভয়ঙ্কর ভিডিও

প্রকাশের সময় : ০৭:০৫:০৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর ২০২০

হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিমকে পিটিয়ে হত্যার দৃশ্য। কি নির্মম সেই দৃশ্য। মানুষ এতটা বর্বর হতে পারে তা ভিডিওটি দেখেও বিশ^াস হতে চায় না। গত সোমবারের ওই নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং ভাইরাল হয়।

সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম সর্বশেষ বরিশাল মহানগর পুলিশের (বিএমপি) ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত ছিলেন। পুলিশের এই কর্মকর্তাকে পিটিয়ে হত্যার বর্ণনা দিয়েছেন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী এবং কর্মচারীরা।

রাজধানীর আদাবরে অবস্থিত মাইন্ড এইড হাসপাতাল যেন একটি টর্চার সেল। আদাবরের বাইতুল আমান হাউজিং সোসাইটির মূল সড়কের সঙ্গে ২৮১ নম্বর বাড়ি। তিনতলা বিশিষ্ট বাড়িতে গড়ে তোলা হয়েছে ‘মাইন্ড এইড মাইন্ড কেয়ার ইনস্টিটিউট’।

ভবনের দোতলার কর্নারের একটি সাউন্ডপ্রুফ রুমে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে পুলিশের সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিমকে। আনিসুলের পরিবারের সদস্যদের একটিই দাবি নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের বিচার, জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।

সরজমিন দেখা গেছে, ভবনের দ্বিতীয় তলার পূর্ব পাশের ছোট্ট কক্ষটি ‘সাউন্ড প্রুফ’। অনেকটা ভয়েস রেকর্ডিং বা স্টুডিও রুমের আদলে। দেয়ালের ভেতরের অংশ ফোম দিয়ে মোড়ানো। রয়েছে দু’টি মাত্র বিছানা। রুমের দৈর্ঘ্য- প্রস্থ সর্বোচ্চ চার ফিট বাই সাত ফিট। রুমটিতে একটি মাত্র দরজা। নেই কোনো জানালা। বাতাস চলাচলেরও কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। এসি, লাইট আর সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো। এই রুমেই চিকিৎসার নামে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে আনিসুলকে।

বাবার এই আদর আর পাবে না ছোট্ট শিশুটি
ছবিতে এএসপি আনসিুল করিম, তার ছেলে ও স্ত্রী

হাসপাতাল থেকে উদ্ধার করা সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, সাত থেকে আটজন লোক আনিসুল করিমকে জোর করে টেনে একটি কক্ষে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে সবাই মিলে তাকে উপুড় করে ফেলে চেপে ধরে রেখেছে। দুই ব্যক্তিকে দেখা যায় তারা আনিসুলের পিঠে ও ঘাড়ে কনুই দিয়ে আঘাত করছে।

বাকিরা তাকে চেপে ধরে রাখছে। এ সময় তার হাত পেছনের দিকে মুড়িয়ে একটি নীল রঙের কাপড় দিয়ে বাঁধা হয়। পরে তাকে সোজা করে শুইয়ে দেয়া হয়। এ সময় আনিসুলকে নড়াচড়া করতে দেখা যায়নি। তখন হাসপাতালের দুই কর্মীকে দেখা যায় তারা আনিসুলের মুখে পানি ছিটাচ্ছে। এর কয়েক মিনিট পরে সাদা অ্যাপ্রোন পরা এক নারী কক্ষে প্রবেশ করেন।

তিনি আনিসুলের মাথায় হাত দিয়ে পরীক্ষা করেন। আনিসুলের বুক চেপে সিপিআর দিতে দেখা যায়। অ্যাপ্রোন পরা আরেক নারী তার রক্তচাপও মেপে দেখেন। কিন্তু তাতেও সাড়া দেননি তিনি। এর কিছু পরে তার হাতের বাঁধন খুলে দেয়া হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আনিসুলকে নির্ধারিত কক্ষটির দিকে নেয়া হয়। তখন তিনি হঠাৎ করে রেগে যান। তিনি কোনোভাবেই সেই রুমে যেতে চাননি।

এ সময় সকলে তাকে জোর করে ঠেলে এবং ধাক্কা দিয়ে রুমের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। কেউ পেছন থেকে তার পিঠে সজোরে ধাক্কা মারছিল তখন। এ সময় আনিসুল চিৎকার করে সবাইকে বলেছেন, ‘আমার গায়ে টাচ করছেন কেন। জানেন, আমি একজন পুলিশ অফিসার।’

গত দু’মাস যাবৎ হাসপাতালে রান্না করেন রুমা বেগম। ঘটনার সময় তিনি রান্নাঘরে ছিলেন জানিয়ে রুমা বলেন, হট্টগোল শুনে আর সকলের সঙ্গে আমিও সিসি ক্যামেরায় ভিডিও ফুটেজ দেখতে যাই। ভিডিও ফুটেজে নির্যাতনের চিত্র দেখে আঁতকে উঠি।

আরও পড়ুন : হাসপাতালের কর্মচারিদের মারধরে সিনিয়র এএসপির মৃত্যু (ভিডিও)

রুমার সহকারী আরেক নারী শারমিন আক্তার লিমা বলেন, ওই পুলিশ সদস্য জানতেন তাকে বাথরুমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাকে যে দোতলায় নির্যাতন করা কক্ষটিতে নেয়া হচ্ছে- এটা জানতেন না। এ সময় সে কক্ষটিতে প্রবেশ করতে না চাইলে পেছন থেকে ওয়ার্ডবয়রা মিলে তাকে ধাক্কা মারে।

এ বিষয়ে তখন তার পরিবারের সদস্যরা কিছুই জানতেন না। তারা নিচে বসে ভর্তির যাবতীয় তথ্য যাচাই-বাছাই করছিলেন। পুলিশ কর্মকর্তা আনিসুল মারা যাওয়ার অনেক পরে তারা জানতে পারেন।

আনিসুলের ভাই রেজাউল করিম সবুজ বলেন, পারিবারিক এবং চাকরির একটি ট্রেনিং সংক্রান্ত বিষয়ে আমার ছোট ভাই আনিসুল মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। তার রক্তচাপজনিত সমস্যা ছিল। হৃদরোগও ছিল। কিন্তু এ দু’টির কোনোটিই প্রকট ছিল না। হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পিটুনিতে তার মৃত্যু হয়েছে।

সম্প্রতি মানসিকভাবে অস্থিরতা, হঠাৎ রেগে যাওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যা বোধ করলে গত সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তাকে মাইন্ড এইড হাসপাতালে নিয়ে যান পরিবারের সদস্যরা। তারা ভর্তির ফরম পূরণ করছিলেন। ওই সময়ে হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারী আনিসুলকে দোতলায় নিয়ে যায়। তাকে দোতলায় নিয়ে তখনই পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে কিন্তু তখন পর্যন্ত তা জানতেন না স্বজনরা।

হত্যাকাণ্ডের সময় হাসপাতালের ব্যবস্থাপক আরিফ মাহমুদও সেখানে উপস্থিত ছিলেন বলে জানান আনিসুলের ভাই রেজাউল করিম সবুজ। এরপর আনিসুলকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানকার চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

মাইন্ড এইড হাসপাতালে আনিসুলকে হত্যার অভিযোগে গত সোমবার রাতে তার বাবা বাদী হয়ে আদাবর থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। ইতিমধ্যে আনিসুলকে হত্যার অভিযোগে মাইন্ড এইড হাসপাতালের ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয় ১০ জনকে। পরে হাসপাতালের এক পরিচালককে আটক করা হয়। পুলিশ গ্রেপ্তার ১০ জনের প্রত্যেকের ১০ দিন করে রিমান্ড চায়। সাতদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ মঙ্গলবার দুপুরে এ বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন- হাসপাতালের মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ, কো-অর্ডিনেটর রেদোয়ান সাব্বির, কথিত ফার্মাসিস্ট তানভীর হাসান, ওয়ার্ডবয় জোবায়ের হোসেন, তানিফ মোল্লা, সজীব চৌধুরী, অসীম চন্দ্র পাল, লিটন আহাম্মদ, সাইফুল ইসলাম ও শেফ মো. মাসুদ।

পুলিশের এই উপ-কমিশনার বলেন, আমরা মনে করি এটি হত্যাকাণ্ড। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা পুলিশের কাছে হত্যার দায় স্বীকার করেছে। হত্যার ঘটনায় কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। যারাই জড়িত থাক, সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। আদাবর থানার উপ-পরিদর্শক (এস আই) মো. শাহজাহান জানান, মঙ্গলবার বেলা আড়াইটার দিকে হাসপাতালটি সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। ঘটনাস্থলে দুপুরে আসেন ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন ডা. মঈনুল আহসান।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, হাসপাতালটি অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছিল। কিন্তু অনুমোদন দেয়া হয়নি। তাই এটা কোনো হাসপাতালই না। সরকারি কোনো অনুমোদন না থাকলেও হাসপাতালটি দুই বছর ধরে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এ বছরের শুরুতে তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করা হয়। তবে প্রতিষ্ঠানটি চিকিৎসা দেয়ার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল না। তাই অনুমতি পায়নি।

ওদিকে সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিমকে হত্যার প্রতিবাদে মাইন্ড এইড হাসপাতালের সামনে মানববন্ধন করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশকিছু প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থী। তাদের অভিযোগ, এই হাসপাতালে আনিসুল করিমকে হত্যা করা হয়েছে। তারা এই ঘটনার দ্রুত বিচার দাবি করেছেন।

নিহত আনিসুলের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, চার ভাই- বোনের মধ্যে আনিসুল সবার ছোট। গাজীপুরের জয়দেবপুরের রাজবাড়ী সদরে তাদের বাসা। বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাইফুদ্দিন আহমেদ। আনিসুল ছোট বয়স থেকেই মেধাবী ছিলেন। আনিসুল ৩১তম বিসিএসের পুলিশ ক্যাডারে প্রথম স্থান অধিকার করেন।

তিনি সর্বশেষ বরিশাল মহানগর পুলিশে কর্মরত ছিলেন। তিনি এক সন্তানের জনক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের ৩৩ ব্যাচে দ্বিতীয় হন।
আনিসুলের স্ত্রী শারমিন সুলতানা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। এই দম্পতির চার বছর বয়সী সাফরান নামে একটি ছেলে রয়েছে।

এদিকে গাজীপুর থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানান: সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. আনিসুল করিমের দাফন হয়েছে গাজীপুরের কেন্দ্রীয় গোরস্থানে। নিহতের গাজীপুরের বাসায় চলছে শোকের মাতম। আত্মীয়স্বজনসহ এলাকার কেউই মেনে নিতে পারছে না হাসপাতাল কর্মীদের বর্বর আচরণে নিহতের ঘটনা।

দ্রুততম সময়ের মধ্যে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাচ্ছেন তারা। আনিসুল করিমের গ্রামের বাড়ি কাপাসিয়া উপজেলায় হলেও ছোটবেলা থেকেই থেকেছেন গাজীপুর জেলা শহরের বরুদা এলাকায়। শহরের ঐতিহ্যবাহী স্কুল রানী বিলাসমণি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। এক সন্তানের জনক এই পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যু কোনোভাবে মেনে নিতে পারছেন না পরিবারের লোকজন।

 

ভিডিওটি দেখতে ক্লিক করুন: