Dhaka সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫, ৩০ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রায়হানের মৃত্যুর পর কীভাবে পালালেন আকবর

  • সিলেট প্রতিনিধি
  • প্রকাশের সময় : ০৬:২৫:২২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২১ অক্টোবর ২০২০
  • ১৯৭ জন দেখেছেন

ফাইল ছবি

সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে রায়হানের মৃত্যুর ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর ৪ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তখনই এসআই আকবর কৌশলে পালিয়ে যায়। অথচ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে পুলিশ ফাঁড়িতে থাকতে বলেছিলেন। প্রশ্ন হলো-কীভাবে পালালেন? বিষয়টি অনুসন্ধানে নেমেছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী।

নির্যাতনে রায়হানের মৃত্যুর ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে আকবর মুখ বন্ধ রেখেছিল সবার। বন্দরবাজার ফাঁড়িতে থাকা পুলিশ সদস্যরা ঘটনা সম্পর্কে ঊর্ধ্বতনদের কাছে আকবরের শেখানো বুলি আওড়ান। তারা জানিয়েছিলেন, ‘রায়হানকে ফাঁড়িতে নিয়ে আসা হয়নি।’ কিন্তু ঘটনার দিন বিকালে যখন সিসিটিভি ফুটেজে সত্যতা মিলে তখনই ধরা পড়ে আকবরের কুকীর্তি। ঊর্ধ্বতনদের চাপের মুখে অবশেষে আকবরের সহযোগী পুলিশ সদস্যরা নির্যাতনের বিষয়টি স্বীকার করে।

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রায়হানকে ফাঁড়িতে এনে নির্যাতন চালানো হয়েছিলো। কিন্তু এস আই আকবর বলেছিলো- গণপিটুনির পর রায়হানকে কাস্টঘর থেকেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে তার এই বক্তব্য যখন মিথ্যা প্রমাণিত হয় তখনই গ্রেপ্তার এড়াতে পালায় আকবর। তিনি জানান, যখন আকবরসহ ৪ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয় তখনই আকবর পালিয়ে যায়। তাকে বলা হয়েছিলো পুলিশ লাইনে থাকতে। কিন্তু সে ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশ মানেনি।

বন্দরবাজার ফাঁড়ির অঘোষিত সম্রাট ছিল এস আই আকবর। তার কথাই ছিল শেষ কথা। এ কারণে সব পুলিশ সদস্যই আকবরের কথা মতো চলতেন। আকবর নিজেও সবাইকে মনিটরিং করতো। নানাবিধ দাপট দেখিয়ে ফাঁড়ি শাসন করে সে। এ কারণে তার মতের বিরুদ্ধে কোনো পুলিশ কর্মকর্তা ‘টুঁ শব্দ’ করতেন না। বন্দরবাজার ফাঁড়িতে থাকাকালে আকবর সিলেটের ব্যবসায়ী সমাজকে টক্কর দিয়েছে। মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর হকার উচ্ছেদ কর্মকাণ্ডকে কৌশলে বিরোধিতা করেছে। ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের অভিযান কর্মকাণ্ডকে সে তোয়াক্কা করতো না।

বন্দর এলাকাকে তার নিজের মতো করে পরিচালনা করতো। সিলেটের বন্দরবাজারের ব্যবসায়ীরা নানা সময় হকার উচ্ছেদ সহ বিভিন্ন বিষয়ে পুলিশের ওপর ক্ষুব্ধ হতেন। তারা প্রকাশ্যে আন্দোলনে নামতেন। আকবর কৌশলে ব্যবসায়ীদের টক্কর দিতেন। নগরীর লালবাজারের আবাসিক হোটেলে অসামাজিক কাজের অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। রয়েছে ইয়াবা বিকিকিনির অভিযোগও।



এসব হোটেল ও মাদক বিক্রেতারা ছিল আকবরের টাকার অন্যতম উৎস। লালবাজারের এই অসামাজিক কার্যকলাপে ক্ষুব্ধ ছিলেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। সুরমা পয়েন্টসহ বিভিন্ন পয়েন্টে মাছ বিক্রি নিয়ে তারা পুলিশকে দোষারূপ করেছিলেন। এ কারণে লালবাজারের ব্যবসায়ীদের নিবৃত্ত করতে আকবর নানা নাটকের অবতারণা করেন।

কয়েক মাস আগে চার ব্যবসায়ীকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন ফাঁড়িতে। পরে আকবর তাদের ছাড়তে বাধ্য হয়। পরে এক দোকান কর্মচারীকে ধরে নিয়ে গিয়ে ব্যবসায়ীদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। নগরীর সুরমা মার্কেটে দু’টি আবাসিক হোটেল রয়েছে। এ দু’টি হোটেলের বিরুদ্ধে অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগ দীর্ঘ দিনের।

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি আজবাহার আলী শেখ গোয়েন্দা পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে গোপনে ওই দু’টি হোটেলে বেশ কয়েক বার অভিযান চালান। অভিযানকালে অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগে নারী-পুরুষকে আটকও করেন। কিন্তু অভিযান শেষ হলেই ফের দু’টি হোটেলে তাদের কার্যকলাপ শুরু হয়। এস আই আকবরের কাছে এ দু’টি হোটেল টাকা আয়ের অন্যতম উৎস। ফলে পুলিশের ডিসি অভিযান চালালেও আকবর গোপনে শেল্টার দিয়ে অসামাজিক কর্মকাণ্ড চালাতো।

কোতোয়ালি থানার ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে আকবরের সম্পর্ক ভালো ছিল। থানার তদারকি না থাকার কারণেই আকবর ফাঁড়িতে তার রাজত্ব গড়ে তুলেছিলেন। রায়হানের পরিবারসহ বৃহত্তর আখালিয়াবাসী ইতিমধ্যে রায়হান হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন- ঊর্ধ্বতনদের সহযোগিতা ছাড়া আকবর পালিয়ে যেতে পারে না। আর ঘটনার চার দিনের মধ্যেও পুলিশের কেউ রায়হানের বাড়িতে যাননি।

তাদের এই প্রশ্ন তোলার পর পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া রায়হানের বাড়িতে যান। এবং পরিবারকে সান্ত্বনা জানান।

আকবর পালিয়ে যেতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কারো সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখছে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের তদন্ত কমিটি। তবে এটি স্পষ্ট হয়েছে রায়হান হত্যাকাণ্ডের পর আকবরকে হেফাজতে না রাখা ছিল ভুল। বিষয়টি নিয়ে পুলিশের ভেতরে সবচেয়ে বেশি তোলপাড় হয়েছে।

কারণ কোনো পুলিশ সদস্য ঊর্ধ্বতনদের অনুমতি ছাড়া হঠাৎ উধাও হতে পারে না। এজন্য দায় এড়াতে পারেন না ঊর্ধ্বতনরাও। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, রায়হান হত্যাকাণ্ডের দিন সন্ধ্যায় সিলেটের পুলিশ লাইনে গিয়েছিল রায়হান। সে পুলিশ লাইনের ক্যান্টিনে বসে নাস্তা করেছে। ওই সময় মোবাইলফোনে বিভিন্ন জনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়।

কিছু সময় পর আকবর পুলিশ লাইন এলাকা থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে চলে যায়। রায়হানের সঙ্গে কোম্পানীগঞ্জের এক ব্যক্তির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। ঘটনার দিন ১১ই অক্টোবর ওই ব্যক্তি সিলেটে ছিলেন। আকবর পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে ওই ব্যক্তিরও মোবাইলফোন বন্ধ রয়েছে। পুলিশের ধারণা- আকবর ঘটনার দিন রাতেই কোম্পানীগঞ্জ এলাকা দিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যে পুলিশও এ নিয়ে তদন্ত করেছে। জিজ্ঞাসাবাদ করেছে কয়েকজনকে।

নতুন কর্মসূচি: সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশি নির্যাতনে নিহত রায়হান হত্যায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তারে এলাকাবাসী ও পরিবারের পক্ষ থেকে ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম গতকাল বুধবার দুপুরে শেষ হয়েছে। আল্টিমেটামের সময় শেষ হওয়ার আগেই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে এলাকাবাসী ও রায়হানের পরিবার।

মঙ্গলবার রাত ১০টায় এক সম্মিলিত বৈঠকে নতুন কর্মসূচির সিদ্ধান্ত হয়। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- আজ বৃহস্পতিবার পরিবার ও এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, আগামীকাল শুক্রবার বাদ জুমা মসজিদে মসজিদে রায়হানের জন্য দোয়া মাহফিল ও শনিবার বিকাল ৪টায় এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে মদিনা মার্কেট পয়েন্টে মানববন্ধন।

রায়হানের স্বজন মো. শওকত হোসেন জানিয়েছেন, আল্টিমেটামের শেষের পর কঠোর কর্মসূচির কথা ছিল। কিন্তু মানুষের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে তারা আপাতত কর্মসূচি থেকে সরে এসেছেন। তবে এরপর যদি প্রশাসন জড়িতদের গ্রেপ্তারে ব্যর্থ হয় তাহলে কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা আসবে। নতুন কর্মসূচির বিষয়ে এলাকাবাসীর পক্ষে এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ জানান, এই আন্দোলন একটি অরাজনৈতিক আন্দোলন।

বিচার প্রাপ্তির আন্দোলন। সরকারও এই আন্দোলনের সঙ্গে রয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তারে সরকারের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন ৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মখলিসুর রহমান কামরান, ৮ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইলিয়াসুর রহমান ইলিয়াস, সাবেক কাউন্সিলর জগদীশ দাসসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।

আরও পড়ুন : রায়হানের নখ উপড়ানো শরীরে আঘাতের চিহ্ন

পুলিশ হেডকোয়ার্টারের তদন্ত কমিটি: নিহত রায়হানের বাড়ি পরিদর্শন করেছেন পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্ত কমিটির সদস্যরা। মঙ্গলবার রাতে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (এআইজি- ক্রাইম অ্যানালাইসিস বিভাগ) মুহাম্মদ আয়ুবের নেতৃত্বে রায়হানের বাড়িতে যান পুলিশ সদর দপ্তর গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা।

এ সময় তারা রায়হানের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে তদন্ত কমিটির প্রধান এআইজি মুহাম্মদ আয়ুব সাংবাদিকদের বলেন- এস আই আকবরের পালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে আর কেউ সংশ্লিষ্ট আছেন কিনা সে বিষয়টি তদন্ত করার জন্যই আমাদের সিলেট আসা। এই তদন্তের অংশ হিসেবেই আমরা রায়হানের বাড়িতে এসে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছি।

ফাঁড়ির সামনে বিক্ষোভ: বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশি নির্যাতনে নিহত রায়হান হত্যায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে ফাঁড়ি ঘেরাও ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছে বাংলাদেশ ছাত্র, যুব ও শ্রমিক অধিকার পরিষদ সিলেট। এ সময় রাস্তা অবরোধ করে ফাঁড়িতে অবস্থান করেন আন্দোলনকারীরা। বুধবার সকাল সাড়ে ১১টা থেকে নগরীর বন্দরবাজার ফাঁড়ির সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন তারা।

এ সময় আন্দোলনকারীরা বলেন, ঘটনার এতোদিন পরও কেন কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না সেটা আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। যতক্ষণ পর্যন্ত ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস না দেবে প্রশাসন ততক্ষণ পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে জানান তারা।

জনপ্রিয় খবর

আবহাওয়া

সংস্কার না হওয়ায় খানাখন্দে চলাচলে অনুপযোগী, দুর্ভোগ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের

রায়হানের মৃত্যুর পর কীভাবে পালালেন আকবর

প্রকাশের সময় : ০৬:২৫:২২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২১ অক্টোবর ২০২০

সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে রায়হানের মৃত্যুর ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর ৪ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তখনই এসআই আকবর কৌশলে পালিয়ে যায়। অথচ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে পুলিশ ফাঁড়িতে থাকতে বলেছিলেন। প্রশ্ন হলো-কীভাবে পালালেন? বিষয়টি অনুসন্ধানে নেমেছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী।

নির্যাতনে রায়হানের মৃত্যুর ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে আকবর মুখ বন্ধ রেখেছিল সবার। বন্দরবাজার ফাঁড়িতে থাকা পুলিশ সদস্যরা ঘটনা সম্পর্কে ঊর্ধ্বতনদের কাছে আকবরের শেখানো বুলি আওড়ান। তারা জানিয়েছিলেন, ‘রায়হানকে ফাঁড়িতে নিয়ে আসা হয়নি।’ কিন্তু ঘটনার দিন বিকালে যখন সিসিটিভি ফুটেজে সত্যতা মিলে তখনই ধরা পড়ে আকবরের কুকীর্তি। ঊর্ধ্বতনদের চাপের মুখে অবশেষে আকবরের সহযোগী পুলিশ সদস্যরা নির্যাতনের বিষয়টি স্বীকার করে।

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রায়হানকে ফাঁড়িতে এনে নির্যাতন চালানো হয়েছিলো। কিন্তু এস আই আকবর বলেছিলো- গণপিটুনির পর রায়হানকে কাস্টঘর থেকেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে তার এই বক্তব্য যখন মিথ্যা প্রমাণিত হয় তখনই গ্রেপ্তার এড়াতে পালায় আকবর। তিনি জানান, যখন আকবরসহ ৪ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয় তখনই আকবর পালিয়ে যায়। তাকে বলা হয়েছিলো পুলিশ লাইনে থাকতে। কিন্তু সে ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশ মানেনি।

বন্দরবাজার ফাঁড়ির অঘোষিত সম্রাট ছিল এস আই আকবর। তার কথাই ছিল শেষ কথা। এ কারণে সব পুলিশ সদস্যই আকবরের কথা মতো চলতেন। আকবর নিজেও সবাইকে মনিটরিং করতো। নানাবিধ দাপট দেখিয়ে ফাঁড়ি শাসন করে সে। এ কারণে তার মতের বিরুদ্ধে কোনো পুলিশ কর্মকর্তা ‘টুঁ শব্দ’ করতেন না। বন্দরবাজার ফাঁড়িতে থাকাকালে আকবর সিলেটের ব্যবসায়ী সমাজকে টক্কর দিয়েছে। মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর হকার উচ্ছেদ কর্মকাণ্ডকে কৌশলে বিরোধিতা করেছে। ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের অভিযান কর্মকাণ্ডকে সে তোয়াক্কা করতো না।

বন্দর এলাকাকে তার নিজের মতো করে পরিচালনা করতো। সিলেটের বন্দরবাজারের ব্যবসায়ীরা নানা সময় হকার উচ্ছেদ সহ বিভিন্ন বিষয়ে পুলিশের ওপর ক্ষুব্ধ হতেন। তারা প্রকাশ্যে আন্দোলনে নামতেন। আকবর কৌশলে ব্যবসায়ীদের টক্কর দিতেন। নগরীর লালবাজারের আবাসিক হোটেলে অসামাজিক কাজের অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। রয়েছে ইয়াবা বিকিকিনির অভিযোগও।



এসব হোটেল ও মাদক বিক্রেতারা ছিল আকবরের টাকার অন্যতম উৎস। লালবাজারের এই অসামাজিক কার্যকলাপে ক্ষুব্ধ ছিলেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। সুরমা পয়েন্টসহ বিভিন্ন পয়েন্টে মাছ বিক্রি নিয়ে তারা পুলিশকে দোষারূপ করেছিলেন। এ কারণে লালবাজারের ব্যবসায়ীদের নিবৃত্ত করতে আকবর নানা নাটকের অবতারণা করেন।

কয়েক মাস আগে চার ব্যবসায়ীকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন ফাঁড়িতে। পরে আকবর তাদের ছাড়তে বাধ্য হয়। পরে এক দোকান কর্মচারীকে ধরে নিয়ে গিয়ে ব্যবসায়ীদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। নগরীর সুরমা মার্কেটে দু’টি আবাসিক হোটেল রয়েছে। এ দু’টি হোটেলের বিরুদ্ধে অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগ দীর্ঘ দিনের।

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি আজবাহার আলী শেখ গোয়েন্দা পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে গোপনে ওই দু’টি হোটেলে বেশ কয়েক বার অভিযান চালান। অভিযানকালে অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগে নারী-পুরুষকে আটকও করেন। কিন্তু অভিযান শেষ হলেই ফের দু’টি হোটেলে তাদের কার্যকলাপ শুরু হয়। এস আই আকবরের কাছে এ দু’টি হোটেল টাকা আয়ের অন্যতম উৎস। ফলে পুলিশের ডিসি অভিযান চালালেও আকবর গোপনে শেল্টার দিয়ে অসামাজিক কর্মকাণ্ড চালাতো।

কোতোয়ালি থানার ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে আকবরের সম্পর্ক ভালো ছিল। থানার তদারকি না থাকার কারণেই আকবর ফাঁড়িতে তার রাজত্ব গড়ে তুলেছিলেন। রায়হানের পরিবারসহ বৃহত্তর আখালিয়াবাসী ইতিমধ্যে রায়হান হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন- ঊর্ধ্বতনদের সহযোগিতা ছাড়া আকবর পালিয়ে যেতে পারে না। আর ঘটনার চার দিনের মধ্যেও পুলিশের কেউ রায়হানের বাড়িতে যাননি।

তাদের এই প্রশ্ন তোলার পর পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া রায়হানের বাড়িতে যান। এবং পরিবারকে সান্ত্বনা জানান।

আকবর পালিয়ে যেতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কারো সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখছে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের তদন্ত কমিটি। তবে এটি স্পষ্ট হয়েছে রায়হান হত্যাকাণ্ডের পর আকবরকে হেফাজতে না রাখা ছিল ভুল। বিষয়টি নিয়ে পুলিশের ভেতরে সবচেয়ে বেশি তোলপাড় হয়েছে।

কারণ কোনো পুলিশ সদস্য ঊর্ধ্বতনদের অনুমতি ছাড়া হঠাৎ উধাও হতে পারে না। এজন্য দায় এড়াতে পারেন না ঊর্ধ্বতনরাও। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, রায়হান হত্যাকাণ্ডের দিন সন্ধ্যায় সিলেটের পুলিশ লাইনে গিয়েছিল রায়হান। সে পুলিশ লাইনের ক্যান্টিনে বসে নাস্তা করেছে। ওই সময় মোবাইলফোনে বিভিন্ন জনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়।

কিছু সময় পর আকবর পুলিশ লাইন এলাকা থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে চলে যায়। রায়হানের সঙ্গে কোম্পানীগঞ্জের এক ব্যক্তির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। ঘটনার দিন ১১ই অক্টোবর ওই ব্যক্তি সিলেটে ছিলেন। আকবর পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে ওই ব্যক্তিরও মোবাইলফোন বন্ধ রয়েছে। পুলিশের ধারণা- আকবর ঘটনার দিন রাতেই কোম্পানীগঞ্জ এলাকা দিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যে পুলিশও এ নিয়ে তদন্ত করেছে। জিজ্ঞাসাবাদ করেছে কয়েকজনকে।

নতুন কর্মসূচি: সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশি নির্যাতনে নিহত রায়হান হত্যায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তারে এলাকাবাসী ও পরিবারের পক্ষ থেকে ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম গতকাল বুধবার দুপুরে শেষ হয়েছে। আল্টিমেটামের সময় শেষ হওয়ার আগেই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে এলাকাবাসী ও রায়হানের পরিবার।

মঙ্গলবার রাত ১০টায় এক সম্মিলিত বৈঠকে নতুন কর্মসূচির সিদ্ধান্ত হয়। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- আজ বৃহস্পতিবার পরিবার ও এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, আগামীকাল শুক্রবার বাদ জুমা মসজিদে মসজিদে রায়হানের জন্য দোয়া মাহফিল ও শনিবার বিকাল ৪টায় এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে মদিনা মার্কেট পয়েন্টে মানববন্ধন।

রায়হানের স্বজন মো. শওকত হোসেন জানিয়েছেন, আল্টিমেটামের শেষের পর কঠোর কর্মসূচির কথা ছিল। কিন্তু মানুষের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে তারা আপাতত কর্মসূচি থেকে সরে এসেছেন। তবে এরপর যদি প্রশাসন জড়িতদের গ্রেপ্তারে ব্যর্থ হয় তাহলে কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা আসবে। নতুন কর্মসূচির বিষয়ে এলাকাবাসীর পক্ষে এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ জানান, এই আন্দোলন একটি অরাজনৈতিক আন্দোলন।

বিচার প্রাপ্তির আন্দোলন। সরকারও এই আন্দোলনের সঙ্গে রয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তারে সরকারের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন ৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মখলিসুর রহমান কামরান, ৮ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইলিয়াসুর রহমান ইলিয়াস, সাবেক কাউন্সিলর জগদীশ দাসসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।

আরও পড়ুন : রায়হানের নখ উপড়ানো শরীরে আঘাতের চিহ্ন

পুলিশ হেডকোয়ার্টারের তদন্ত কমিটি: নিহত রায়হানের বাড়ি পরিদর্শন করেছেন পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্ত কমিটির সদস্যরা। মঙ্গলবার রাতে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (এআইজি- ক্রাইম অ্যানালাইসিস বিভাগ) মুহাম্মদ আয়ুবের নেতৃত্বে রায়হানের বাড়িতে যান পুলিশ সদর দপ্তর গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা।

এ সময় তারা রায়হানের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে তদন্ত কমিটির প্রধান এআইজি মুহাম্মদ আয়ুব সাংবাদিকদের বলেন- এস আই আকবরের পালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে আর কেউ সংশ্লিষ্ট আছেন কিনা সে বিষয়টি তদন্ত করার জন্যই আমাদের সিলেট আসা। এই তদন্তের অংশ হিসেবেই আমরা রায়হানের বাড়িতে এসে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছি।

ফাঁড়ির সামনে বিক্ষোভ: বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশি নির্যাতনে নিহত রায়হান হত্যায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে ফাঁড়ি ঘেরাও ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছে বাংলাদেশ ছাত্র, যুব ও শ্রমিক অধিকার পরিষদ সিলেট। এ সময় রাস্তা অবরোধ করে ফাঁড়িতে অবস্থান করেন আন্দোলনকারীরা। বুধবার সকাল সাড়ে ১১টা থেকে নগরীর বন্দরবাজার ফাঁড়ির সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন তারা।

এ সময় আন্দোলনকারীরা বলেন, ঘটনার এতোদিন পরও কেন কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না সেটা আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। যতক্ষণ পর্যন্ত ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস না দেবে প্রশাসন ততক্ষণ পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে জানান তারা।