Dhaka বৃহস্পতিবার, ১৪ অগাস্ট ২০২৫, ২৯ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নির্বাচন কখন হবে সেটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের নয় : প্রধান উপদেষ্টা

নিজস্ব প্রতিবেদক : 

অন্তর্বরর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, দেশের সংকটকালে ছাত্রদের আহ্বানে আমরা সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। কখন নির্বাচন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়।

রোববার (২৫ আগস্ট) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এ কথা বলেন তিনি।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, একটা বিষয়ে সবাই জানতে আগ্রহী, কখন আমাদের সরকার বিদায় নেবে। এটার জবাব আপনাদের হাতে, কখন আপনারা আমাদেরকে বিদায় দেবেন। আমরা কেউ দেশ শাসনের মানুষ নই। আমাদের নিজ নিজ পেশায় আমরা আনন্দ পাই। আমাদের উপদেষ্ঠামণ্ডলীও এই লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে সবাই মিলে একটা টিম হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমরা ছাত্রদের আহ্বানে এসেছি। তারা আমাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। দেশের আপামর জনসাধারণ আমাদের নিয়োগ সমর্থন করেছে।

তিনি বলেন, কখন নির্বাচন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন। আমরা ছাত্রদের আহ্বানে এসেছি। তারা আমাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। দেশের আপামর জনসাধারণ আমাদের নিয়োগ সমর্থন করেছে। আমরা ক্রমাগতভাবে সবাইকে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে যাবো যাতে হঠাৎ করে এই প্রশ্ন উত্থাপিত না হয় আমরা কখন যাব। তারা যখন বলবে আমরা চলে যাব।

নির্বাচন কমিশনকে সংস্কার করা হবে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, আমরা সংস্কারের অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশনকেও সংস্কার করব। কমিশনকে যে কোনো সময় আদর্শ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রাখব।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, লাখ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এবং লাখ লাখ মা-বোনের আত্মদানের বিনিময়ে যে বাংলাদেশ আমরা পেয়েছিলাম, তা ফ্যাসিবাদ এবং স্বৈরাচারের হাতে ধ্বংস হয়ে গেছে। আপনারা দেখেছেন আমাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে তারা কীভাবে শেষ করেছে। দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে দুর্নীতি। এমন এক দেশে আমাদের দেশ রূপান্তরিত হয়েছে যেখানে স্বৈরাচারের পিয়নও দুর্নীতির মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ করার মতো অকল্পনীয় কাজ করে গেছে নির্বিবাদে। শিক্ষা খাতকে পঙ্গু করে দিয়েছে, ব্যাংকিং ও শেয়ার বাজার খাতে লুটপাট, প্রকল্প ব্যয়ে বিশ্ব রেকর্ড, অবাধ সম্পদ পাচার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে নিজ দলের পুতুলে রূপান্তর, বাকস্বাধীনতা হরণ, মানবাধিকার হরণ এসবই হিমশৈলের অগ্রভাগ মাত্র।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে ফ্যাসিবাদী সরকার খর্ব করেছে জনগণের সাংবিধানিক ক্ষমতা ও অধিকার। দুঃশাসন, দুর্নীতি, অন্যায়-অবিচার নিপীড়ন, বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যম জনসুরক্ষা বিপন্ন করেছে। জনগণকে নির্যাতন ও বঞ্চনা ও বৈষম্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নতুন প্রজন্মের মানুষসহ কোটি কোটি মানুষের ভোটাধিকারকে বছরের পর বছর হরণ করেছে। মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পথে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে স্বৈরাচার তার নিজের, পরিবারের ও দলের কিছু মানুষের হাতে দেশের মালিকানা তুলে নিয়েছে। প্রিয় দেশবাসী, কিন্তু এই দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েই আমাদের গড়তে হবে স্বপ্নের বাংলাদেশ। বৈষম্যহীন, শোষণহীন, কল্যাণময় এবং মুক্ত বাতাসের রাষ্ট্রের যে স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র-জনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল, আমি ভাদের সেই স্বপ্নপূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ। আপনাদের সবাইকে এই ফ্রেড লগ্নে তাদের স্বপ্নপূরণে সমস্ত শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।

তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে দোয়া ও সহযোগিতা চাইতে এসেছি। সবাইকে ধৈর্য ধরতে বলব। এখনই সব দাবি পূরণ করার জন্য জোর করা, প্রতিষ্ঠানে ঢুকে ব্যক্তিবিশেষকে হুমকির মধ্যে ফেলা, মামলা গ্রহণে চাপ সৃষ্টি করা, বিচারের জন্য গ্রেফতার ব্যক্তিকে আদালতে হামলা করে আগেই এক ধরনের বিচার করে ফেলার যে প্রবণতা তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

তিনি আরো বলেন, ছাত্র-জনতার বিপ্লবের গৌরব ও সম্ভাবনা এসবের কাছে ম্লান হয়ে যাবে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে। ড. ইউনূস বলেন, রাতারাতি এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ কঠিন। নড়বড়ে একটা কাঠামোতে দাঁড়িয়ে আমাদেরকে দেশ পুনর্গঠনের কাজে হাত দিতে হয়েছে। আমরা এখান থেকেই বাংলাদেশকে এমনভাবে গড়তে চাই যেন এ দেশে জনগণই সত্যিকার অর্থে সকল ক্ষমতার উৎস হয়। বিশ্ব দরবারে একটি মানবিক ও কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে সমাদৃত হয়। তরুণ প্রজন্ম, শিক্ষার্থী ও জনতার আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানাতে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে আমাদের সফল হতেই হবে। এর আর কোনো বিকল্প নেই।

ফ্যাসিবাদী সরকারের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, অপহরণ এবং আয়নাঘরের মতো চরম ঘৃণ্য সব অপকর্মের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। বাংলাদেশকে আর কোনো দিন কেউ যেন কোনো পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত না করতে পারে তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বিচার বিভাগকে দুর্নীতি ও দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকারের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, অপহরণ এবং আয়নাঘরের মতো চরম ঘৃণ্য সব অপকর্মের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত সবার বিচার নিশ্চিত করা হবে। তালিকা প্রস্তুত করে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হবে। দুর্নীতি ও সম্পদ পাচারের বিচার করা হবে।

আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে জনমুখী ও দলীয় প্রভাবমুক্ত ও জবাবদিহিতামূলক কাঠামো সৃষ্টির লক্ষ্যে পুলিশ কমিশন গঠন করা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন, দায়িত্বপ্রাপ্ত সব সংস্থা ও জনগণের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে কমিশনের নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। বাংলাদেশকে আর কোনো দিন কেউ যেন কোনো পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত না করতে পারে তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সবাইকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, এখনই সব দাবি পূরণ করার জন্য জোর করা, প্রতিষ্ঠানে ঢুকে ব্যক্তিবিশেষকে হুমকির মধ্যে ফেলা, মামলা গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি করার প্রবণতা থেকে বের হতে হবে।

তিনি বলেন, এ ধরনের প্রবণতা থেকে বের হতে হবে। আপনাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের গৌরব ও সম্ভাবনা এসব কাজে ম্লান হয়ে যাবে, নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টাও এতে ব্যাহত হবে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বর্তমান সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করার মাত্র দুই সপ্তাহ শেষ হলো। কর্মযাত্রার প্রথম পর্যায়ে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে আপনাদের কাছ থেকে যে সমর্থন পাচ্ছি সেজন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। আমরা অনুধাবন করছি যে আমাদের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা অনেক। এ প্রত্যাশা পূরণে আমরা বদ্ধপরিকর। যদিও দীর্ঘদিনের গণতন্ত্রহীনতা, ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের জন্য পর্বতসম চ্যালেঞ্জ রেখে গেছে। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে আমরা প্রস্তুত। আজ আমি সরকারের পক্ষ থেকে আপনাদের দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করতে আপনাদের সামনে এসেছি।

দেশবাসীকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, একটা বিশেষ ব্যাপারে আমরা আপনাদের সহযোগিতা চাচ্ছি। আমাদের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রতিদিন সচিবালয়ে, আমার অফিসের আশপাশে, শহরের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করা হচ্ছে। গত ১৬ বছরের অনেক দুঃখ- কষ্ট আপনাদের জমা আছে। সেটা আমরা বুঝি। আমাদের যদি কাজ করতে না দেন তাহলে এই দুঃখ ঘোচানোর সব পথ বন্ধ হয়ে থাকবে। আপনাদের কাছে অনুরোধ আমাদের কাজ করতে দিন। আপনাদের যা চাওয়া তা লিখিতভাবে আমাদের দিয়ে যান। আমরা আপনাদের বিপক্ষ দল নই। আইনসঙ্গতভাবে যা কিছু করার আছে আমরা অবশ্যই তা করব।

ড. ইউনূস বলেন, আমাদের ঘেরাও করে আমাদের কাজে বাধা দেবেন না। সবাই মিলে তাদের বোঝান তারা যেন এ সময়ে তাদের অভিযোগের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আমাদের দৈনন্দিন গুরুত্বপূর্ণ কাজে বাধা না দেন।

তিনি বলেন, বিভিন্ন সংস্কারের কাজ শুরু করেছি। দেশবাসীকে অনুরোধ করবো, একটা আলোচনা শুরু করতে আমরা সর্বনিম্ন কী কী কাজ সম্পূর্ণ করে যাবো, কী কী কাজ মোটামুটি করে গেলে হবে। এই আলোচনার মাধ্যমে আমরা একটা দিক নির্দেশনা পেতে পারি। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক আলোচনা থেকেই আসবে। এই দিক নির্দেশনা না-পেলে আমরা দাতা সরকার এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে আলোচনায় দৃঢ়তার সঙ্গে অগ্রসর হতে পারছি না।

তিনি আরও বলেন, আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি আমরা আমাদের পক্ষ থেকে মেয়াদ বৃদ্ধির কোনো প্রশ্ন তুলবো না। আমরা আপনাদের সকলের দোয়া চাই। যে ক’দিন আছি সে সময়টুকু উপদেষ্টামণ্ডলীর প্রত্যেকে নিজ নিজ সাধ্য মতো দেশের এই সংকটকালে, সংকট উত্তরণে যেন নিজ নিজ মেধা সাধ্য মতো কাজে লাগাতে পারি, নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে সুযোগ ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করলাম, আমরা আমাদের মতানৈক্যের কারণে সেটা যেন হাতছাড়া না করে ফেলি এটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই। এ সুযোগ এবার হারিয়ে ফেললে আমরা জাতি হিসেবে পরাজিত হয়ে যাব। শহিদ, আহত এবং জীবিত ছাত্র-জনতার কাছে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে চাই আমরা এই অর্জনকে কিছুতেই হারিয়ে যেতে দেবোনা। যে সুযোগ তারা আমাদের দিয়েছে তার মাধ্যমে আমাদের দেশকে পৃথিবীর একটি শ্রদ্ধেয়, সকল দিকে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী, দেশে পরিণত করতে আমরা শপথ নিয়েছি। সব শেষে আবারো আমাদের দেশের সকল মানুষ, শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী,, বয়স্ক, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ সবার কাছে দোয়া চাইছি যেন আমরা আমাদের সকলের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সফল হই।

নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন বাস্তবায়নে অন্তর্র্বতী সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা হবে এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করা হবে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে সফল পরিণতি দিতে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা খাত এবং তথ্য প্রবাহে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পূর্ণ করে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা হবে। এর লক্ষ্য হবে দুর্নীতি, লুটপাট ও গণহত্যার বিরুদ্ধে একটি জবাবদিহীতামূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সূচনা।

জনপ্রিয় খবর

আবহাওয়া

কারওয়ান বাজার এলাকায় সাঁড়াশি অভিযানে গ্রেফতার ৩০

নির্বাচন কখন হবে সেটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের নয় : প্রধান উপদেষ্টা

প্রকাশের সময় : ০৮:২৮:৩৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৫ অগাস্ট ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক : 

অন্তর্বরর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, দেশের সংকটকালে ছাত্রদের আহ্বানে আমরা সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। কখন নির্বাচন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়।

রোববার (২৫ আগস্ট) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এ কথা বলেন তিনি।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, একটা বিষয়ে সবাই জানতে আগ্রহী, কখন আমাদের সরকার বিদায় নেবে। এটার জবাব আপনাদের হাতে, কখন আপনারা আমাদেরকে বিদায় দেবেন। আমরা কেউ দেশ শাসনের মানুষ নই। আমাদের নিজ নিজ পেশায় আমরা আনন্দ পাই। আমাদের উপদেষ্ঠামণ্ডলীও এই লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে সবাই মিলে একটা টিম হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমরা ছাত্রদের আহ্বানে এসেছি। তারা আমাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। দেশের আপামর জনসাধারণ আমাদের নিয়োগ সমর্থন করেছে।

তিনি বলেন, কখন নির্বাচন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন। আমরা ছাত্রদের আহ্বানে এসেছি। তারা আমাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। দেশের আপামর জনসাধারণ আমাদের নিয়োগ সমর্থন করেছে। আমরা ক্রমাগতভাবে সবাইকে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে যাবো যাতে হঠাৎ করে এই প্রশ্ন উত্থাপিত না হয় আমরা কখন যাব। তারা যখন বলবে আমরা চলে যাব।

নির্বাচন কমিশনকে সংস্কার করা হবে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, আমরা সংস্কারের অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশনকেও সংস্কার করব। কমিশনকে যে কোনো সময় আদর্শ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রাখব।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, লাখ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এবং লাখ লাখ মা-বোনের আত্মদানের বিনিময়ে যে বাংলাদেশ আমরা পেয়েছিলাম, তা ফ্যাসিবাদ এবং স্বৈরাচারের হাতে ধ্বংস হয়ে গেছে। আপনারা দেখেছেন আমাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে তারা কীভাবে শেষ করেছে। দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে দুর্নীতি। এমন এক দেশে আমাদের দেশ রূপান্তরিত হয়েছে যেখানে স্বৈরাচারের পিয়নও দুর্নীতির মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ করার মতো অকল্পনীয় কাজ করে গেছে নির্বিবাদে। শিক্ষা খাতকে পঙ্গু করে দিয়েছে, ব্যাংকিং ও শেয়ার বাজার খাতে লুটপাট, প্রকল্প ব্যয়ে বিশ্ব রেকর্ড, অবাধ সম্পদ পাচার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে নিজ দলের পুতুলে রূপান্তর, বাকস্বাধীনতা হরণ, মানবাধিকার হরণ এসবই হিমশৈলের অগ্রভাগ মাত্র।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে ফ্যাসিবাদী সরকার খর্ব করেছে জনগণের সাংবিধানিক ক্ষমতা ও অধিকার। দুঃশাসন, দুর্নীতি, অন্যায়-অবিচার নিপীড়ন, বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যম জনসুরক্ষা বিপন্ন করেছে। জনগণকে নির্যাতন ও বঞ্চনা ও বৈষম্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নতুন প্রজন্মের মানুষসহ কোটি কোটি মানুষের ভোটাধিকারকে বছরের পর বছর হরণ করেছে। মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পথে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে স্বৈরাচার তার নিজের, পরিবারের ও দলের কিছু মানুষের হাতে দেশের মালিকানা তুলে নিয়েছে। প্রিয় দেশবাসী, কিন্তু এই দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েই আমাদের গড়তে হবে স্বপ্নের বাংলাদেশ। বৈষম্যহীন, শোষণহীন, কল্যাণময় এবং মুক্ত বাতাসের রাষ্ট্রের যে স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র-জনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল, আমি ভাদের সেই স্বপ্নপূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ। আপনাদের সবাইকে এই ফ্রেড লগ্নে তাদের স্বপ্নপূরণে সমস্ত শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।

তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে দোয়া ও সহযোগিতা চাইতে এসেছি। সবাইকে ধৈর্য ধরতে বলব। এখনই সব দাবি পূরণ করার জন্য জোর করা, প্রতিষ্ঠানে ঢুকে ব্যক্তিবিশেষকে হুমকির মধ্যে ফেলা, মামলা গ্রহণে চাপ সৃষ্টি করা, বিচারের জন্য গ্রেফতার ব্যক্তিকে আদালতে হামলা করে আগেই এক ধরনের বিচার করে ফেলার যে প্রবণতা তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

তিনি আরো বলেন, ছাত্র-জনতার বিপ্লবের গৌরব ও সম্ভাবনা এসবের কাছে ম্লান হয়ে যাবে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে। ড. ইউনূস বলেন, রাতারাতি এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ কঠিন। নড়বড়ে একটা কাঠামোতে দাঁড়িয়ে আমাদেরকে দেশ পুনর্গঠনের কাজে হাত দিতে হয়েছে। আমরা এখান থেকেই বাংলাদেশকে এমনভাবে গড়তে চাই যেন এ দেশে জনগণই সত্যিকার অর্থে সকল ক্ষমতার উৎস হয়। বিশ্ব দরবারে একটি মানবিক ও কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে সমাদৃত হয়। তরুণ প্রজন্ম, শিক্ষার্থী ও জনতার আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানাতে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে আমাদের সফল হতেই হবে। এর আর কোনো বিকল্প নেই।

ফ্যাসিবাদী সরকারের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, অপহরণ এবং আয়নাঘরের মতো চরম ঘৃণ্য সব অপকর্মের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। বাংলাদেশকে আর কোনো দিন কেউ যেন কোনো পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত না করতে পারে তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বিচার বিভাগকে দুর্নীতি ও দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকারের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, অপহরণ এবং আয়নাঘরের মতো চরম ঘৃণ্য সব অপকর্মের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত সবার বিচার নিশ্চিত করা হবে। তালিকা প্রস্তুত করে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হবে। দুর্নীতি ও সম্পদ পাচারের বিচার করা হবে।

আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে জনমুখী ও দলীয় প্রভাবমুক্ত ও জবাবদিহিতামূলক কাঠামো সৃষ্টির লক্ষ্যে পুলিশ কমিশন গঠন করা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন, দায়িত্বপ্রাপ্ত সব সংস্থা ও জনগণের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে কমিশনের নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। বাংলাদেশকে আর কোনো দিন কেউ যেন কোনো পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত না করতে পারে তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সবাইকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, এখনই সব দাবি পূরণ করার জন্য জোর করা, প্রতিষ্ঠানে ঢুকে ব্যক্তিবিশেষকে হুমকির মধ্যে ফেলা, মামলা গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি করার প্রবণতা থেকে বের হতে হবে।

তিনি বলেন, এ ধরনের প্রবণতা থেকে বের হতে হবে। আপনাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের গৌরব ও সম্ভাবনা এসব কাজে ম্লান হয়ে যাবে, নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টাও এতে ব্যাহত হবে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বর্তমান সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করার মাত্র দুই সপ্তাহ শেষ হলো। কর্মযাত্রার প্রথম পর্যায়ে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে আপনাদের কাছ থেকে যে সমর্থন পাচ্ছি সেজন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। আমরা অনুধাবন করছি যে আমাদের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা অনেক। এ প্রত্যাশা পূরণে আমরা বদ্ধপরিকর। যদিও দীর্ঘদিনের গণতন্ত্রহীনতা, ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের জন্য পর্বতসম চ্যালেঞ্জ রেখে গেছে। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে আমরা প্রস্তুত। আজ আমি সরকারের পক্ষ থেকে আপনাদের দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করতে আপনাদের সামনে এসেছি।

দেশবাসীকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, একটা বিশেষ ব্যাপারে আমরা আপনাদের সহযোগিতা চাচ্ছি। আমাদের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রতিদিন সচিবালয়ে, আমার অফিসের আশপাশে, শহরের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করা হচ্ছে। গত ১৬ বছরের অনেক দুঃখ- কষ্ট আপনাদের জমা আছে। সেটা আমরা বুঝি। আমাদের যদি কাজ করতে না দেন তাহলে এই দুঃখ ঘোচানোর সব পথ বন্ধ হয়ে থাকবে। আপনাদের কাছে অনুরোধ আমাদের কাজ করতে দিন। আপনাদের যা চাওয়া তা লিখিতভাবে আমাদের দিয়ে যান। আমরা আপনাদের বিপক্ষ দল নই। আইনসঙ্গতভাবে যা কিছু করার আছে আমরা অবশ্যই তা করব।

ড. ইউনূস বলেন, আমাদের ঘেরাও করে আমাদের কাজে বাধা দেবেন না। সবাই মিলে তাদের বোঝান তারা যেন এ সময়ে তাদের অভিযোগের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আমাদের দৈনন্দিন গুরুত্বপূর্ণ কাজে বাধা না দেন।

তিনি বলেন, বিভিন্ন সংস্কারের কাজ শুরু করেছি। দেশবাসীকে অনুরোধ করবো, একটা আলোচনা শুরু করতে আমরা সর্বনিম্ন কী কী কাজ সম্পূর্ণ করে যাবো, কী কী কাজ মোটামুটি করে গেলে হবে। এই আলোচনার মাধ্যমে আমরা একটা দিক নির্দেশনা পেতে পারি। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক আলোচনা থেকেই আসবে। এই দিক নির্দেশনা না-পেলে আমরা দাতা সরকার এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে আলোচনায় দৃঢ়তার সঙ্গে অগ্রসর হতে পারছি না।

তিনি আরও বলেন, আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি আমরা আমাদের পক্ষ থেকে মেয়াদ বৃদ্ধির কোনো প্রশ্ন তুলবো না। আমরা আপনাদের সকলের দোয়া চাই। যে ক’দিন আছি সে সময়টুকু উপদেষ্টামণ্ডলীর প্রত্যেকে নিজ নিজ সাধ্য মতো দেশের এই সংকটকালে, সংকট উত্তরণে যেন নিজ নিজ মেধা সাধ্য মতো কাজে লাগাতে পারি, নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে সুযোগ ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করলাম, আমরা আমাদের মতানৈক্যের কারণে সেটা যেন হাতছাড়া না করে ফেলি এটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই। এ সুযোগ এবার হারিয়ে ফেললে আমরা জাতি হিসেবে পরাজিত হয়ে যাব। শহিদ, আহত এবং জীবিত ছাত্র-জনতার কাছে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে চাই আমরা এই অর্জনকে কিছুতেই হারিয়ে যেতে দেবোনা। যে সুযোগ তারা আমাদের দিয়েছে তার মাধ্যমে আমাদের দেশকে পৃথিবীর একটি শ্রদ্ধেয়, সকল দিকে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী, দেশে পরিণত করতে আমরা শপথ নিয়েছি। সব শেষে আবারো আমাদের দেশের সকল মানুষ, শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী,, বয়স্ক, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ সবার কাছে দোয়া চাইছি যেন আমরা আমাদের সকলের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সফল হই।

নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন বাস্তবায়নে অন্তর্র্বতী সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা হবে এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করা হবে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে সফল পরিণতি দিতে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা খাত এবং তথ্য প্রবাহে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পূর্ণ করে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা হবে। এর লক্ষ্য হবে দুর্নীতি, লুটপাট ও গণহত্যার বিরুদ্ধে একটি জবাবদিহীতামূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সূচনা।