নাটোর জেলা প্রতিনিধি :
নাটোর সদর উপজেলার মাঝদিঘা এলাকা থেকে এক মাদরাসার শিক্ষককে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে পিটিয়ে আহত করার অভিযোগ উঠেছে। পরে দুর্বৃত্তরা তাঁকে রাস্তায় ফেলে চলে যায়। এসময় তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
শুক্রবার (১৭ নভেম্বর) রাত ৮টার দিকে নাটোর সদর উপজেলার নাটোর-নলডাঙ্গা আঞ্চলিক সড়কের চিকুর মোড় এলাকায় তাকে ফেলে যায় দুবৃত্তরা। এর আগে রাত ৭টার দিকে মাঝদিঘা এলাকা থেকে তাকে তুলে নেওয়া হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে মাগরিবের নামাজ শেষ হওয়ার কিছু সময় পর পাঁচ ছয় জন অপরিচিত মানুষ তাকে মাদ্রাসার বাইরে ডেকে নিয়ে জোরপূর্বক মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে চলে যায়। তারপর তাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে বারঘরিয়া গ্রামের পূর্ব দিকে চিকুর মোড় এলাকায় ফেলে রেখে যায়। পরে স্থানীয়রা সেখান থেকে উদ্ধার করে তাকে নাটোর সদর হাসপাতালে ভর্তি করান।
ভুক্তভোগী সাইদুল ইসলাম বলেন, আমি মাগরিব নামাজ পড়া শেষ করে মাদ্রাসার অফিসে বসে কোরআন তেলাওয়াত করেছি। তারপর বই পড়ছিলাম, হঠাৎ ৫-৬জন মানুষ অফিস রুমের সামনে এসে জিজ্ঞেস করে আপনি কি সাইদুল ইসলাম? আমি হ্যাঁ বলতেই বলে, একটু আসেন। বাহিরে যেতেই মুহূর্তের ভেতর রাস্তায় নিয়ে মাইক্রোতে তুলে ফেলে। তারপর চোখ মুখ বেধে ফেলে। পরে নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়ে পাইপ ও হাতুড়ি দিয়ে পেটানো শুরু করে।
নাটোর সদর হাসপাতালের ১ নম্বর সার্জারি ওয়ার্ডে বসে এই বর্ণনা দিচ্ছিলেন মাদ্রাসাশিক্ষক হাফেজ মাওলানা সাইদুল ইসলাম (৩৮)। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় তাঁকে হাতুড়িপেটা করে পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে সড়কের পাশে ফেলে যায় মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা। এ নিয়ে গত এক মাসে নাটোরের চার উপজেলায় ১০ জনকে তুলে নিয়ে পিটিয়ে, কুপিয়ে, হাত-পায়ের রগ কেটে ও গুলি করে গুরুতর জখম করা হয়েছে।
সাইদুল ইসলাম নাটোর সদর উপজেলার মাঝদিঘা নুরানি হাফেজিয়া মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট। তিনি নাটোর সদর উপজেলার মাঝদিঘা পূর্বপাড়ার বাসিন্দা। আজ শনিবার সকালে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বেডে শুয়ে স্বজন ও সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করছেন সাইদুল ইসলাম। তাঁর শরীরের কাপড়চোপড়ে এখনো রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। একে একে হাসপাতালে আসতে শুরু করেছেন মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। দায়িত্বরত নার্স বারবার বলেও ভিড় কমাতে পারছেন না।
কাছে যাওয়ার পর সাইদুল ইসলামকে কথাবার্তা বন্ধ করতে দেখা যায়। পাশে দাঁড়ানো তাঁর ভাই মাওলানা আবদুল মাজেদ জানান, মাদ্রাসা থেকে তুলে নিয়ে পেটানোর পর থেকে অপরিচিত কারও সঙ্গে কথা বলতে সাহস পাচ্ছেন না সাইদুল। পরে পরিচয় পেয়ে ঘটনার বিস্তারিত জানান তিনি।
মাওলানা সাইদুল ইসলাম বলেন, মাদ্রাসা থেকে মাইক্রোবাসে তোলার পর তাঁকে পেছনের সিটে বসিয়ে দুজন হাত ধরে রাখেন। তাঁরা পরস্পরের মধ্যে নলডাঙ্গার স্থানীয় ভাষায় কথা বলছিলেন। তবে কেউ ফোনে কথা বলছিলেন না। তাঁর ফোনটি বেজে উঠলে তাঁরা সেটি কেড়ে নেন। পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে চিকুর মোড়ে নিয়ে তাঁকে মাইক্রোবাস থেকে নামিয়ে পার্শ্বরাস্তায় দাঁড় করান। সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘তখনই তারা লোহার রড, চাবুক ও হাতুড়ি দিয়ে আমার হাত-পায়ে এলোপাতাড়ি মারতে থাকে। আমি চিৎকার করলেও কেউ এগিয়ে আসে না। পরে আমি শুয়ে পড়ি এবং অচেতন হয়ে যাই। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে দেখি তারা নাই। তখন আমি পথচারীদের সাহায্য চাই।’
খবর পেয়ে মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও ছাতনী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেনসহ তাঁর সহকর্মীরা ঘটনাস্থলে আসেন এবং থানা-পুলিশকে খবর দেন। ইউপি চেয়ারম্যান প্রথম আলোকে বলেন, সন্ধ্যার পরে এলাকায় একটি সভা করার সময় তিনি সাইদুল ইসলামকে তুলে নিয়ে যাওয়ার খবর পান। পরে খোঁজখবর নিয়ে চিকুর মোড় থেকে তাঁকে উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন। তাঁর হাত-পায়ে হাতুড়ি দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়েছে। তিনি গুরুতর আহত।
এই হামলার কারণের বিষয়ে জানতে চাইলে সাইদুল ইসলাম বলেন, মাদ্রাসার জালসার পোস্টারে নাম দেওয়া নিয়ে দুই বছর ধরে স্থানীয় ইউপি সদস্যের সঙ্গে তাঁর বিরোধ চলছিল। সম্প্রতি তাঁকে শাসিয়েছেনও। এ ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে গোলমাল নেই। তাই কারা কেন তাঁকে এভাবে নির্যাতন করল, তা বলতে পারছেন না। তিনি বলেন, অপহরণকারীদের দেখতে ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছিল। সবার পায়ে কেডস ও পরনে শার্ট-প্যান্ট ছিল।
ভুক্তভোগীর ভাই আবদুল মাজেদ বলেন, তাঁরা মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষ ও পরিবারের লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে থানায় যাবেন অভিযোগ দেওয়ার জন্য। তাঁরা চান, পুলিশ অন্য ৯টি ঘটনার মতো তাঁদের অভিযোগও ফেলে রাখবে না। দ্রুত তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করবে।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাছিম আহমেদ বলেন, ভুক্তভোগীর পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করলে পুলিশ মামলা নেবে। এ ঘটনায় তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনা হবে।