Dhaka শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দেশ থেকে আড়াই-তিন লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে : গভর্নর

চট্টগ্রাম জেলা প্রতিনিধি : 

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশ থেকে আড়াই থেকে তিন লাখ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের বড় শিল্প গ্রুপ আছে। বেক্সিমকোর পাচার করা অর্থ ৫০ হাজার কোটি টাকার মতো। এগুলো শুধু বড় গ্রুপ। ছোটগুলোকে আপাতত দেখছি না।

শুক্রবার (১১ এপ্রিল) বিকেলে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ কার্যক্রম এবং সমসাময়িক ব্যাংকিং বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই আউট অব কোর্ট স্যাটেলমেন্ট বলে একটা কথা আছে। সব জিনিসে সবসময় মামলায় দীর্ঘসূত্রীতায় যাওয়ার মানে হয় না। কতটা শক্তভাবে ধরতে পারি তাদের। ভালোভাবে ধরতে পারলে আপসটাও ভালোভাবে হয়। তার সম্পদ শনাক্ত না করলে আমরা ঠকে যাবে। আপসে যেতে হলে সঠিক তথ্য বের করতে হবে। তথ্যে গরমিল হওয়া যাবে না। যত ভালো তথ্য পাবো তত ভালো করবো আপস বা আদালতে।

‘বাংলাদেশ একটা বড় ভিকটিম মানিলন্ডারিংয়ে। আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে কতিপয় পরিবার বা গোষ্ঠী মানি লন্ডারিং করে সম্পদ চুরি করে বাইরে নিয়ে গেছে। আমরা সেই সম্পদ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর, রোগের উৎপত্তি রোধ করা প্রধান দায়িত্ব। রোগ সারানো হচ্ছে পরে। চুরি হওয়ার পরে বুদ্ধি বাড়িয়ে লাভ নেই। চুরি হওয়ার আগেই ঠেকানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ভবিষ্যতে যেন আর কোনোভাবে না হয়।’

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে গভর্নর বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার যে উদ্যোগ এটা একেবারেই বাংলাদেশের জন্য নতুন। সিস্টেমেটিকেলি এ ধরনের প্রবলেম আগে ফেইস করিনি, করে থাকলেও এ ধরনের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়নি। এই প্রথম আমরা এটা করছি। সেজন্য আমাদের অনেক শিখতে হচ্ছে। এটা তো দেশের আইনে হবে না। বিদেশিদের সঙ্গে আমাকে সংযোগ স্থাপন করতে হবে। তাদের আইনের সঙ্গে সংগতি রেখে কাজ করতে হবে। প্রথম ধাপে চেষ্টা করতে হবে সম্পদগুলো চিহ্নিত করা। সেই ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ করছি। আইনি সহায়তার জন্য আমরা চিঠি পাঠাচ্ছি। বিভিন্ন ল’ ফার্মের সঙ্গে কথা বলছি, তাদের হয়ত খুব শিগগির হায়ার করবো।

তিনি বলেন, আমরা কিছু ফার্মের সঙ্গে কথা বলছি যারা কার সম্পদ কোথায় আছে তা বের করবে। আমরা ভাসা ভাসা জানি সিঙ্গাপুরে আছে, অমুক দেশে আছে। সঠিক তথ্য না পেলে আদালতে টিকবে না। কাজেই আমাকে সেইভাবে তথ্য নিয়ে আসতে হবে। সেই জন্য বিদেশি অ্যাসেট ট্রেসিং ফার্মের মাধ্যমে তাদের ব্যাংক হিসাব, কোম্পানি ও সম্পদ শনাক্ত করতে হবে। আমরা যথেষ্ট সহযোগিতা পাচ্ছি বিদেশিদের কাছ থেকে। তারপরেও জিনিসটা এত সহজ নয়, সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আমাদের লক্ষ্য ছয় মাসের মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশে সম্পদ শনাক্ত করা। এরপর আদালতে যেতে হয়। কয়েক বছর লেগে যায়।

চট্টগ্রামের কিছু বড় গ্রুপ অন্ততপক্ষে সোয়া লাখ কোটি টাকা থেকে দেড় লাখ কোটি টাকা নিয়েছে ব্যাংকিং খাত থেকে। আরও কিছু গ্রুপ আছে। ২০, ৪০, ৫০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। আমার ধারণা বড় গ্রুপগুলোর আড়াই-তিন লাখ কোটি টাকা হতে পারে। ছোটগুলো বাদে। সেগুলোও আদায় করতে হবে অর্থঋণ আদালতসহ অন্যান্য আইনি প্রক্রিয়ায়।

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আমাদের মূল দায়িত্ব হচ্ছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা। আমরা মনে করি, আমরা সেখানে বেশ কিছু সাফল্য অর্জন করেছি, পুরোপুরিভাবে হয়নি। আরও হবে আশা করি। আমরা সঠিক পথে আছি। আমাদের রিজার্ভ স্থিতিশীল আছে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে। আমাদের রপ্তানি বাড়ছে। বিভিন্ন রকমের গোলযোগ আন্দোলন সত্ত্বেও রপ্তানি মুখ থুবড়ে পড়েনি, বাড়ছে। ডাবল ডিজিট গ্রোথ দেখতে পাচ্ছি। রেমিট্যান্সের প্রবাহ উৎসাহব্যঞ্জক। এর ধারাবাহিকতা থাকবে বলে আশা করছি। সব মিলিয়ে ম্যাক্রো ইকোনমিক এক্সটারনাল সেক্টরে একটা স্বস্তির জায়গায় আমরা চলে এসেছি। কোনো ধরনের ক্রাইসিস আছে বলে আমি মনে করি না এবং হবে বলে আমি মনে করি না। আমরা একটা সুদৃঢ় অবস্থানে এসেছি।

বিগত সময়ে মূল্যস্ফীতির তথ্য কমিয়ে দেখানো হতো উল্লেখ করে গভর্নর বলেন, মূল্যস্ফীতির বিষয়ে আমরা বলবো- আমাদের প্রচেষ্টা আংশিক সফল হয়েছে। আগে তথ্যটাকে কমিয়ে দেখানো হতো। ফলে মূল্যস্ফীতি ৯, সাড়ে ৯ এর উপরে উঠতো না। গত আগস্ট মাসে যখন নতুন তথ্য আসলো, খাদ্যে মূল্যস্ফীতি তখন সাড়ে ১৪ শতাংশ। গত মাসে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল সাড়ে ৮ শতাংশের মতো। খাদ্যের মূল্যস্ফীতি আমরা ৫-৬ শতাংশ কমিয়ে ফেলেছি, যা সন্তোষজনক।

তিনি বলেন, খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ততটা কমেনি, তবে কিছুটা কমেছে। যেটা আগে সাড়ে ১২ শতাংশ ছিল, সেটা এখন ৯ শতাংশের কিছুটা উপরে আছে। এতে ৩ শতাংশ কমেছে। আমি আশাবাদী, সামনে এটা আরও কমবে। কারণ আমাদের মতো দেশে খাদ্যমূল্যটা যখন বাড়ে, তখন খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি দুই-তিন শতাংশ বাড়ে। কমার ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যায়। সামগ্রিকভাগে আমরা একটি স্বস্তির জায়গায় যেতে চাই।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, আশা করছি মূল্যস্ফীতি ৭ থেকে ৮ শতাংশের মতো পাবো জুনের শেষে। জুলাই মাসে যে ডেটা পাবো, তখন হয়তো সে চিত্রটা আমরা পাবো। ইনশাল্লাহ আগামী বছরের দিকে ৫ শতাংশ কিংবা তারও নিচে নামিয়ে আনার চেষ্টা করবো। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা গেলে ইন্টারেস্ট রেটও আমরা কমিয়ে আনতে পারবো। ইন্টারেস্ট রেট আমরা ১০ শতাংশ রেখেছি।

মূল্যস্ফীতি কমাতে গেলে পলিসি রেট পজিটিভ রাখতে হবে জানিয়ে গভর্নর বলেন, পৃথিবীর সবদেশেই মূল্যস্ফীতির পলিসি রেট বেশি, অর্থাৎ পজিটিভ। কিন্তু আমাদের দেশে এটা ছিল না। আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪, পলিসি রেট ছিল সাড়ে ৮। বিশাল একটা গ্যাপ ছিল। আমি আসার পরে এটাকে বাড়িয়ে ১০ করা হয়েছে। ইনশাআল্লাহ ১০ থেকে কমবে। যখন মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে আসবে, তখন আমরা ইন্টারেস্ট রেট কমিয়ে আনবো। আমাদের পলিসি এখন সঠিকভাবে কাজ করছে।

অর্থপাচারে বাংলাদেশ একটি বড় ভিকটিম দাবি করে তিনি বলেন, কতিপয় পরিবার বা গোষ্ঠী ব্যাংকিং খাতের বড় একটি অংশ অর্থপাচারের মাধ্যমে দেশের সম্পদ বাইরে নিয়ে গেছে। সেই সম্পদ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সঙ্গে কাজ করছি।

রোগ সারানোর চেয়ে রোগ প্রতিরোধকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন উল্লেখ করে আহসান এইচ মনসুর বলেন, চুরি (অর্থপাচার) হওয়ার পরেই বুদ্ধি বাড়িয়ে লাভ নেই, চুরি হওয়ার আগেই ঠেকানোর ব্যবস্থা করতে হবে। যা গেছে তা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা আমরা নেবো। ভবিষ্যতে যাতে অর্থপাচার না হয়, অর্থপাচার রোধ করা যায়, সে ব্যবস্থাও আমরা নেবো।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আমার মূল দায়িত্ব হলো দেশের অর্থনীতিতে সামগ্রিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা। এরই মধ্যে আমরা বেশ কিছু সাফল্য অর্জন করেছি, পুরোপুরিভাবে হয়নি, আরও হবে আশা করি। আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতি এখন আর নেই, একসময়ে বিশাল অংকের ঘাটতি ছিল, সেটা আমরা মিটিয়ে ফেলেছি। এখন স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। আমাদের রিজার্ভটাও স্থিতিশীল অবস্থায় আছে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে।

গভর্নর আরও বলেন, আমাদের রপ্তানি বাড়ছে। বিগত সময়ে বিভিন্ন রকমের আন্দোলন সত্ত্বেও রপ্তানি কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়েনি। গত ৮-৯ মাসের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখতে পেয়েছি ডাবল ডিজিট গ্রোফ আমরা এখন দেখতে পারছি না। তবে রেমিট্যান্সের অবস্থা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক, ২৬-২৭ শতাংশে রয়েছে। সবমিলিয়ে ম্যাক্রো ইকোনোমিক্সে আমরা একটি স্বস্তির জায়গা চলে আসছি। কোনো ধরনের ক্রাইসিস আছে এবং হবে বলে আমরা মনে করি না। আমরা একটি সুদৃঢ় অবস্থানে আছি।

সাধারণত খাদ্যমূল্য বাড়লেই নন ফুড মূল্যস্ফীতিও বাড়ে। খাদ্যমূল্য বাড়লে রিকশাভাড়া, বাড়ি ভাড়া, চুল কাটার খরচ ক্রমে বাড়ে। খাদ্যমূল্য কমলে তখন আবার নন ফুড আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে। সামগ্রিকভাবে আমরা একটা স্বস্তির জায়গার দিকে যাচ্ছি। জুনের শেষে, জুলাই মাসে রেজাল্ট পাবো মূল্যস্ফীতি হয়ত ৭-৮ এর মধ্যে। ইনশাআল্লাহ আগামী বছর এটাকে ৫ বা তার নিচে নামিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে।

পলিসি রেসপন্সে সময় লাগে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওষুধ দিলেই সব রোগী ভালো হয়ে যায় না, সময় লাগে। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি সব সার যেন সময়মতো আসে। বোরো ধার বুনতে যেন কোনো অসুবিধা না হয় কৃষকের। বিদ্যুতের সরবরাহ যেন বিঘ্নিত না হয়। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট থাকা সত্ত্বেও আমরা তা করতে পেরেছি। আমাদের নিজের টাকাতেই করেছি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. জোবাইর হোসেনের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. জামাল উদ্দিন, বাংলাদেশ ফাইন্যান্স ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের পরিচালক মো. আনিসুর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংক চট্টগ্রাম কার্যালয়ের পরিচালক মো. সালাহ উদ্দীন, মো. আরিফুজ্জামন, মো. আশিকুর রহমান ও স্বরুপ কুমার চৌধুরী।

জনপ্রিয় খবর

আবহাওয়া

চলতি বর্ষা যশোরের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়ক চলাচলের অযোগ্য, দুর্ভোগে পথচারীরা

দেশ থেকে আড়াই-তিন লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে : গভর্নর

প্রকাশের সময় : ০৯:৩১:০২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫

চট্টগ্রাম জেলা প্রতিনিধি : 

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশ থেকে আড়াই থেকে তিন লাখ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের বড় শিল্প গ্রুপ আছে। বেক্সিমকোর পাচার করা অর্থ ৫০ হাজার কোটি টাকার মতো। এগুলো শুধু বড় গ্রুপ। ছোটগুলোকে আপাতত দেখছি না।

শুক্রবার (১১ এপ্রিল) বিকেলে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ কার্যক্রম এবং সমসাময়িক ব্যাংকিং বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই আউট অব কোর্ট স্যাটেলমেন্ট বলে একটা কথা আছে। সব জিনিসে সবসময় মামলায় দীর্ঘসূত্রীতায় যাওয়ার মানে হয় না। কতটা শক্তভাবে ধরতে পারি তাদের। ভালোভাবে ধরতে পারলে আপসটাও ভালোভাবে হয়। তার সম্পদ শনাক্ত না করলে আমরা ঠকে যাবে। আপসে যেতে হলে সঠিক তথ্য বের করতে হবে। তথ্যে গরমিল হওয়া যাবে না। যত ভালো তথ্য পাবো তত ভালো করবো আপস বা আদালতে।

‘বাংলাদেশ একটা বড় ভিকটিম মানিলন্ডারিংয়ে। আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে কতিপয় পরিবার বা গোষ্ঠী মানি লন্ডারিং করে সম্পদ চুরি করে বাইরে নিয়ে গেছে। আমরা সেই সম্পদ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর, রোগের উৎপত্তি রোধ করা প্রধান দায়িত্ব। রোগ সারানো হচ্ছে পরে। চুরি হওয়ার পরে বুদ্ধি বাড়িয়ে লাভ নেই। চুরি হওয়ার আগেই ঠেকানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ভবিষ্যতে যেন আর কোনোভাবে না হয়।’

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে গভর্নর বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার যে উদ্যোগ এটা একেবারেই বাংলাদেশের জন্য নতুন। সিস্টেমেটিকেলি এ ধরনের প্রবলেম আগে ফেইস করিনি, করে থাকলেও এ ধরনের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়নি। এই প্রথম আমরা এটা করছি। সেজন্য আমাদের অনেক শিখতে হচ্ছে। এটা তো দেশের আইনে হবে না। বিদেশিদের সঙ্গে আমাকে সংযোগ স্থাপন করতে হবে। তাদের আইনের সঙ্গে সংগতি রেখে কাজ করতে হবে। প্রথম ধাপে চেষ্টা করতে হবে সম্পদগুলো চিহ্নিত করা। সেই ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ করছি। আইনি সহায়তার জন্য আমরা চিঠি পাঠাচ্ছি। বিভিন্ন ল’ ফার্মের সঙ্গে কথা বলছি, তাদের হয়ত খুব শিগগির হায়ার করবো।

তিনি বলেন, আমরা কিছু ফার্মের সঙ্গে কথা বলছি যারা কার সম্পদ কোথায় আছে তা বের করবে। আমরা ভাসা ভাসা জানি সিঙ্গাপুরে আছে, অমুক দেশে আছে। সঠিক তথ্য না পেলে আদালতে টিকবে না। কাজেই আমাকে সেইভাবে তথ্য নিয়ে আসতে হবে। সেই জন্য বিদেশি অ্যাসেট ট্রেসিং ফার্মের মাধ্যমে তাদের ব্যাংক হিসাব, কোম্পানি ও সম্পদ শনাক্ত করতে হবে। আমরা যথেষ্ট সহযোগিতা পাচ্ছি বিদেশিদের কাছ থেকে। তারপরেও জিনিসটা এত সহজ নয়, সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আমাদের লক্ষ্য ছয় মাসের মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশে সম্পদ শনাক্ত করা। এরপর আদালতে যেতে হয়। কয়েক বছর লেগে যায়।

চট্টগ্রামের কিছু বড় গ্রুপ অন্ততপক্ষে সোয়া লাখ কোটি টাকা থেকে দেড় লাখ কোটি টাকা নিয়েছে ব্যাংকিং খাত থেকে। আরও কিছু গ্রুপ আছে। ২০, ৪০, ৫০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। আমার ধারণা বড় গ্রুপগুলোর আড়াই-তিন লাখ কোটি টাকা হতে পারে। ছোটগুলো বাদে। সেগুলোও আদায় করতে হবে অর্থঋণ আদালতসহ অন্যান্য আইনি প্রক্রিয়ায়।

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আমাদের মূল দায়িত্ব হচ্ছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা। আমরা মনে করি, আমরা সেখানে বেশ কিছু সাফল্য অর্জন করেছি, পুরোপুরিভাবে হয়নি। আরও হবে আশা করি। আমরা সঠিক পথে আছি। আমাদের রিজার্ভ স্থিতিশীল আছে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে। আমাদের রপ্তানি বাড়ছে। বিভিন্ন রকমের গোলযোগ আন্দোলন সত্ত্বেও রপ্তানি মুখ থুবড়ে পড়েনি, বাড়ছে। ডাবল ডিজিট গ্রোথ দেখতে পাচ্ছি। রেমিট্যান্সের প্রবাহ উৎসাহব্যঞ্জক। এর ধারাবাহিকতা থাকবে বলে আশা করছি। সব মিলিয়ে ম্যাক্রো ইকোনমিক এক্সটারনাল সেক্টরে একটা স্বস্তির জায়গায় আমরা চলে এসেছি। কোনো ধরনের ক্রাইসিস আছে বলে আমি মনে করি না এবং হবে বলে আমি মনে করি না। আমরা একটা সুদৃঢ় অবস্থানে এসেছি।

বিগত সময়ে মূল্যস্ফীতির তথ্য কমিয়ে দেখানো হতো উল্লেখ করে গভর্নর বলেন, মূল্যস্ফীতির বিষয়ে আমরা বলবো- আমাদের প্রচেষ্টা আংশিক সফল হয়েছে। আগে তথ্যটাকে কমিয়ে দেখানো হতো। ফলে মূল্যস্ফীতি ৯, সাড়ে ৯ এর উপরে উঠতো না। গত আগস্ট মাসে যখন নতুন তথ্য আসলো, খাদ্যে মূল্যস্ফীতি তখন সাড়ে ১৪ শতাংশ। গত মাসে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল সাড়ে ৮ শতাংশের মতো। খাদ্যের মূল্যস্ফীতি আমরা ৫-৬ শতাংশ কমিয়ে ফেলেছি, যা সন্তোষজনক।

তিনি বলেন, খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ততটা কমেনি, তবে কিছুটা কমেছে। যেটা আগে সাড়ে ১২ শতাংশ ছিল, সেটা এখন ৯ শতাংশের কিছুটা উপরে আছে। এতে ৩ শতাংশ কমেছে। আমি আশাবাদী, সামনে এটা আরও কমবে। কারণ আমাদের মতো দেশে খাদ্যমূল্যটা যখন বাড়ে, তখন খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি দুই-তিন শতাংশ বাড়ে। কমার ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যায়। সামগ্রিকভাগে আমরা একটি স্বস্তির জায়গায় যেতে চাই।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, আশা করছি মূল্যস্ফীতি ৭ থেকে ৮ শতাংশের মতো পাবো জুনের শেষে। জুলাই মাসে যে ডেটা পাবো, তখন হয়তো সে চিত্রটা আমরা পাবো। ইনশাল্লাহ আগামী বছরের দিকে ৫ শতাংশ কিংবা তারও নিচে নামিয়ে আনার চেষ্টা করবো। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা গেলে ইন্টারেস্ট রেটও আমরা কমিয়ে আনতে পারবো। ইন্টারেস্ট রেট আমরা ১০ শতাংশ রেখেছি।

মূল্যস্ফীতি কমাতে গেলে পলিসি রেট পজিটিভ রাখতে হবে জানিয়ে গভর্নর বলেন, পৃথিবীর সবদেশেই মূল্যস্ফীতির পলিসি রেট বেশি, অর্থাৎ পজিটিভ। কিন্তু আমাদের দেশে এটা ছিল না। আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪, পলিসি রেট ছিল সাড়ে ৮। বিশাল একটা গ্যাপ ছিল। আমি আসার পরে এটাকে বাড়িয়ে ১০ করা হয়েছে। ইনশাআল্লাহ ১০ থেকে কমবে। যখন মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে আসবে, তখন আমরা ইন্টারেস্ট রেট কমিয়ে আনবো। আমাদের পলিসি এখন সঠিকভাবে কাজ করছে।

অর্থপাচারে বাংলাদেশ একটি বড় ভিকটিম দাবি করে তিনি বলেন, কতিপয় পরিবার বা গোষ্ঠী ব্যাংকিং খাতের বড় একটি অংশ অর্থপাচারের মাধ্যমে দেশের সম্পদ বাইরে নিয়ে গেছে। সেই সম্পদ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সঙ্গে কাজ করছি।

রোগ সারানোর চেয়ে রোগ প্রতিরোধকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন উল্লেখ করে আহসান এইচ মনসুর বলেন, চুরি (অর্থপাচার) হওয়ার পরেই বুদ্ধি বাড়িয়ে লাভ নেই, চুরি হওয়ার আগেই ঠেকানোর ব্যবস্থা করতে হবে। যা গেছে তা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা আমরা নেবো। ভবিষ্যতে যাতে অর্থপাচার না হয়, অর্থপাচার রোধ করা যায়, সে ব্যবস্থাও আমরা নেবো।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আমার মূল দায়িত্ব হলো দেশের অর্থনীতিতে সামগ্রিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা। এরই মধ্যে আমরা বেশ কিছু সাফল্য অর্জন করেছি, পুরোপুরিভাবে হয়নি, আরও হবে আশা করি। আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতি এখন আর নেই, একসময়ে বিশাল অংকের ঘাটতি ছিল, সেটা আমরা মিটিয়ে ফেলেছি। এখন স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। আমাদের রিজার্ভটাও স্থিতিশীল অবস্থায় আছে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে।

গভর্নর আরও বলেন, আমাদের রপ্তানি বাড়ছে। বিগত সময়ে বিভিন্ন রকমের আন্দোলন সত্ত্বেও রপ্তানি কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়েনি। গত ৮-৯ মাসের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখতে পেয়েছি ডাবল ডিজিট গ্রোফ আমরা এখন দেখতে পারছি না। তবে রেমিট্যান্সের অবস্থা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক, ২৬-২৭ শতাংশে রয়েছে। সবমিলিয়ে ম্যাক্রো ইকোনোমিক্সে আমরা একটি স্বস্তির জায়গা চলে আসছি। কোনো ধরনের ক্রাইসিস আছে এবং হবে বলে আমরা মনে করি না। আমরা একটি সুদৃঢ় অবস্থানে আছি।

সাধারণত খাদ্যমূল্য বাড়লেই নন ফুড মূল্যস্ফীতিও বাড়ে। খাদ্যমূল্য বাড়লে রিকশাভাড়া, বাড়ি ভাড়া, চুল কাটার খরচ ক্রমে বাড়ে। খাদ্যমূল্য কমলে তখন আবার নন ফুড আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে। সামগ্রিকভাবে আমরা একটা স্বস্তির জায়গার দিকে যাচ্ছি। জুনের শেষে, জুলাই মাসে রেজাল্ট পাবো মূল্যস্ফীতি হয়ত ৭-৮ এর মধ্যে। ইনশাআল্লাহ আগামী বছর এটাকে ৫ বা তার নিচে নামিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে।

পলিসি রেসপন্সে সময় লাগে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওষুধ দিলেই সব রোগী ভালো হয়ে যায় না, সময় লাগে। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি সব সার যেন সময়মতো আসে। বোরো ধার বুনতে যেন কোনো অসুবিধা না হয় কৃষকের। বিদ্যুতের সরবরাহ যেন বিঘ্নিত না হয়। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট থাকা সত্ত্বেও আমরা তা করতে পেরেছি। আমাদের নিজের টাকাতেই করেছি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. জোবাইর হোসেনের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. জামাল উদ্দিন, বাংলাদেশ ফাইন্যান্স ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের পরিচালক মো. আনিসুর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংক চট্টগ্রাম কার্যালয়ের পরিচালক মো. সালাহ উদ্দীন, মো. আরিফুজ্জামন, মো. আশিকুর রহমান ও স্বরুপ কুমার চৌধুরী।