Dhaka রবিবার, ১৭ অগাস্ট ২০২৫, ২ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জ্বালানির দাম নিয়ে সরকার চ্যালেঞ্জের মুখে: বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক : 

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার অভাব এবং জ্বালানির দাম বৃদ্ধিতে সরকার চ্যালঞ্জের মুখে রয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নত অবকাঠামো তৈরিতে ২০৫০ সালের মধ্যে ১৮০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ও বৈদেশিক উৎস থেকে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করা হবে। স্মার্ট গ্রিড, আধুনিক প্রযুক্তি, উন্নত সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থা, সাশ্রয়ী উৎপাদন সিস্টেমে এই বিনিযোগ করা হবে।

সোমবার (২৯ মে) বিকালে জ্বালানি বিটের সাংবাদিকদের সংগঠন ফোরাম ফর এনার্জি রিপোটার্স এবং বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের সংগঠন বিপ্পা আয়োজিত প্রাক বাজেট আলোচনায় তিনি এ কথা বলেন। আসন্ন বাজেটে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা যথা সময়ে ভর্তুকির অর্থ ছাড় করা, আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার এবং ডলার ঘাটতি কমানোর সুপারিশ করেন।

নসরুল হামিদ বলেন, কয়লা ও তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার ধাক্কা এখন আমরা টের পাচ্ছি। আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌছে দেওয়া। সেই কাজ আমরা সফলভাবে করতে পেরেছি। আমাদের কেন্দ্র ও সঞ্চালন লাইনের কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু বড় সমস্যা হয়ে গেছে জ্বালানি ঘাটতি।

তিনি বলেন, নিজস্ব জ্বালানি অনুসন্ধানের ওপর আমরা জোর দিচ্ছি। কিন্তু করোনার মধ্যে কাজ হয়নি। এটি একটি বড় সমস্যা। এর বাইরে আর্থিক যোগানের কথা তুলে ধরে বলেন, একটি কূপ খনন করতে ৯ থেকে ২১ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়। আমাদের নিজস্ব অনুসন্ধান উন্নয়ন দলের ঘাটতি রয়েছে। এজন্য ঠিকাদার দিয়ে কাজ করাতে হয়। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি আগামী তিন থেকে চার বছরের মধ্যে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ করতে।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের সব চাইতে বড় চ্যালেঞ্জ জমির সংস্থান করা। আমরা এখন দুই হাজার মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করছি। এজন্য ছয় হাজার একর জমি প্রয়োজন। এত জমির সংস্থান করা যাচ্ছে না। এরপরও সরকার সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে সব চাইতে বেশি জোর দিচ্ছে।

নসরুল হামিদ বলেন, বিদ্যুতের ট্রান্সমিশন ব্যবস্থাকে বেসরকারি খাতে নিয়ে আসার জন্য ইতোমধ্যে আমরা পলিসি তৈরি করছি। আমরা স্মার্ট গ্রিডের দিকে এগোচ্ছি। ডিস্ট্রিবিউশনে স্ক্যাডা সিস্টেম নিয়ে আসছি এবং এটাকে স্মার্ট করার জন্য গ্রাহক পর্যায় থেকে উচ্চতর পর্যায় পর্যন্ত কাজ করছি।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, যখনই আমাদের কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো এল, তখনই মারাত্মকভাবে কয়লার দাম বেড়ে গেল। যে কয়লার দাম আমরা ঠিক করেছিলাম ৬০ ডলার, তা হয়ে গেল সাড়ে ৪০০ ডলার। গ্যাসের দাম ও তেলের দাম বাড়ল। এই ধাক্কাটি গত এক বছরে মারাত্মক গ্যাপ তৈরি করেছে। বিশেষ করে আর্থিক খাতে। এই ইফেক্টটা কিন্তু আমরা এখন বুঝছি।

তিনি বলেন, করোনার সময় জ্বালানির দাম পড়ে গেছে, কিন্তু চাহিদা ছিল না। যখন চাহিদা বাড়ল, তখন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে দামও বাড়ল। কিন্তু প্রাইস তো আমরা মার্কেট বেইজড করিনি। এখন আমরা এটাও করি না, মেরিট ওর্ডার অনুযায়ী সাপ্লাই দেব। সেই সিস্টেমেও আমরা যাইনি। কারণ আমরা বড় ধরনের একটি ভর্তুকি দিয়ে আসছি। আমাদের সিস্টেম ছিল কানেক্টিভিটি। যারা লাইফ লাইনে বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন, তারা যেন মোটামুটিভাবে ব্যবহারটি বাড়ান। সে কারণে টার্গেট বেইজড ভর্তুকি আমাদের চলছে।

তিনি আরও বলেন, এখন সারা বিশ্বের মধ্যে অর্থনৈতিক সমস্যা। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এর প্রভাব খারাপভাবে পড়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। আমাদের হাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে, সব ব্যবস্থা করা আছে। ট্রান্সমিশনও আমাদের খুব খারাপ যে তা নয়। যে পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রয়োজন, সে পরিমাণ ট্রান্সমিশন লাইনও আমাদের আছে। পরবর্তী নতুন প্রজেক্টও আমাদের আছে। কিন্তু জ্বালানির ঘাটতি আছে।

‘আমাদের বক্তারা বললেন, আগে নিজের দেশের জ্বালানি নিশ্চিত করতে হবে। এটা ঠিক। কিন্তু নিজের দেশের জ্বালানি আমরা কতটা নিশ্চিত করব? বিশেষজ্ঞরা তিন রকম কথা বলছেন, যারা পরিকল্পনা নিচ্ছেন তারা আরেক রকম কথা বলছেন, যারা কাজ করছেন, তারা আবার আরেক রকমভাবে কাজ করছেন। আমি মনে করি, সম্ভাবনা অবশ্যই আছে। নতুন নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার হচ্ছে। গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে আমি মনে করি, আরও বড় আকারে পাওয়া যাবে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজও চলছে। কিন্তু সেটাও অর্থের ব্যাপার। একটি গ্যাস ক্ষেত্র ড্রিলিং করতে গেলে ৯-২১ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হয়। ১০টি গ্যাস ক্ষেত্র ড্রিলিং করতে গেলে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলারের মতো লেগে যায় যায়। তাই ডলার যোগান দিতে হবে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে কন্ট্রাক্টররা আসতে চায় না। সব মিলিয়ে সবকিছু বড় চ্যালেঞ্জর মুখে আছে। পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশ হলো সবচেয়ে ঘনবসতি দেশ। তার ওপর ৬০ শতাংশ পানি। ৭০০টি নদী। ১০০ মেগা ওয়াট সোলার প্রজেক্ট করতে গেলে সাড়ে ৩০০ একর পতিত জমি প্রয়োজন হয়। ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যদি এই মুহূর্তে করতে যাই, তাহলে প্রায় ৬ হাজার একর জমি লাগবে। এটা খুবই চ্যালেঞ্জের। তবে একেবারেই যে কাজ হচ্ছে না তা নয়। ৩০-৪০ মেগাওয়াট হচ্ছে। এজন্য সময় লাগছে। তাই হতাশ হওয়ার কারণ নেই। আমাদের টার্গেট অনুযায়ী জমি দেখতে হবে, জমি পাই কি না।

নসরুল হামিদ বলেন, রুপটপ সোলার অনেকে করছে, অনেকে করে না। যারা করবে, তাদেরও তো অর্থ থাকতে হবে। আমাদের যে ডিস্ট্রিবিউশন লাইন সেটা নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে, সেটার জন্য প্রস্তত কি না? আমি ঢাকা শহরে ২ হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে ফেললাম, রুপটপ সোলার করলাম। ভেরি অ্যাবিলিটির কারণে হঠাৎ করে সেই বিদ্যুৎ নেই হয়ে গেল। তখন কী অবস্থা হবে ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের? সঙ্গে সঙ্গে ব্ল্যাকআউট হয়ে যাবে। তাই সেই প্রস্তুতি না নিয়ে আমি কীভাবে ২ হাজার মেগাওয়াট করব? অনেক টেকনিক্যাল ব্যাপার আছে। এগুলোর পেছনে রীতিমতো কাজ চলছে।

তিনি বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, সেটি করতে বিদ্যুৎ ও এনার্জি ক্ষেত্রে প্রায় ১৮০ বিলিয়ন ডলারের মতো বিনিয়োগ লাগবে। এটি আসবে কোথায় থেকে? এটা আসবে উন্নয়ন অংশীদর, সরকার ও বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে। এজন্য বেসরকারি খাতকে সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। আমরা বেইজলোড প্ল্যান্ট বেসরকারি খাতকে ২০১০ সালে দিয়েছিলাম। কিন্তু কেউ আসেনি। কারণ তারা প্রস্তুত ছিল না। আমাদের তখন বাধ্য হয়ে তেলের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু রাখতে হয়েছে। এখন যেসব তেলে প্ল্যান্টগুলো চলমান রয়েছে, সেগুলো নো ইলেক্ট্রিসিটি, নো পেমেন্ট নীতিতে চলছে। কোনো ক্যাপাসিটি চার্জ নেই। যদি একটি প্ল্যান্টে ফুয়েল শর্ট হয়, আমরা অন্য প্ল্যান্ট দিয়ে চালাব। আমরা এখন সম্পূর্ণভাবে গ্যাস ব্যবহার করছি। বিদেশ থেকে যদি এখন বেশি গ্যাস আনাও হয়, সেটি সংরক্ষণ করার মতো অবকাঠামো আমাদের নেই। এখন আমরা গ্যাস নিয়ে কাতারের সঙ্গে যে কন্ট্রাক্ট করতে যাচ্ছি, সেটা ২০২৬-২৭ সালের পর থেকে আসা শুরু হবে।’

তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন কারণে এখন গ্যাস ড্রিলিং করা যাচ্ছে না। কিন্তু আমরা যদি ড্রিল করি, তাহলে আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে ৫০০-৬০০ এমএমসিএফ গ্যাস পাওয়া যাবে। ভোলার গ্যাস এখন সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। সেটাকে নিয়ে আসার জন্য পাইপলাইন করতে হবে। খুলনা পর্যন্ত সেই পাইপলাইন আনতেও ৯-১০ হাজার কোটি টাকা লাগবে। কে এই খরচ বহন করবে? সরকার নাকি বেসরকারি খাত? আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ তিনটি। একটি অ্যাফোর্টেবল এনার্জি দেওয়া, দুই রিলাইভাল এনার্জি দেওয়া ও তিন আন ইন্টারেপটেড অ্যাওয়ার দেওয়া। এই তিনটি বিষয়কে মাথায় রেখে আগামীতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প নেওয়া হবে। আমরা আগামী দুই বছরের মধ্যে দুই মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করব। কিন্তু তার জন্য তো আমাদের জায়গা থাকতে হবে। আমাদের কাছে সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াটের অফার আছে। কিন্তু আমরা যখন তাদের দিচ্ছি, তারা ২০০-৩০০ মেগাওয়াটের বেশি পারে না। নেপালের বিদ্যুৎ আসছে। এর জন্য ৮-১০ বছর লাগবে। বিএফসিএ পজিশন হবে, এটিও ৮-১০ বছর লাগবে। অনেকগুলো কাজ চলছে। আমি মনে করি, চ্যালেঞ্জকে আমাদের মতো দেশ মোকাবিলা করে সামনে এগোনো সত্যিই খুব কঠিন। বেসরকারি খাতগুলোর অনেক ডিউ হয়ে গেছে। তারা পেমেন্ট পাচ্ছে না। আমাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করা দরকার। সব দেশের পরিস্থিতিই এখন খারাপ। আমাদের একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে। যাদের গ্যাস তেল আছে, যারা গ্যাস তেল বিক্রি করতে পেরেছে তাদের পরিস্থিত ভালো। কিন্তু যেসব দেশ গ্যাস তেল আমদানি করে তারা এর অভাব অনুভব করেছে। আমরা তো মাত্র ডেভেলপমেন্টের দিকে যাচ্ছি। এই চ্যালেঞ্জটা আমাদের বিরাটভাবে আঘাত করেছে। কিন্তু আমাদের হতাশা। কিছু নেই। পরিস্থিতি আবার ভালো হবে। আমরা এখন কয়লা আনতে পারছি না, কিন্তু সামনে আনব।

বিপ্পার উদ্দেশে তিনি বলেন, সোলারের রেগুলার এনার্জির ক্ষেত্রে ট্যাক্সের ব্যাপারটা দেখা দরকার। ইউনিফাইড ট্যাক্সের ব্যাপারে আমরা ইতোমধ্যে এনবিআরের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা মনে করছি সামনে যেহেতু ট্যাক্স আরও বেশি আসবে, তাই এটিকে কমিয়ে আনা প্রয়োজন। তেল ও কয়লার দামের সমন্বয় করা দরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে এগুলোর দাম কমেছে। এসব বিষয়ে আমরা ইতোমধ্যে অ্যাপ্রোচ করেছি। আগামী বাজেটে যাতে ট্যাক্সের নতুন প্রাইসিংয়ের ব্যাপারে যাতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, সেই আশায় আছি আমরা।

এফইআরবির নির্বাহী পরিচালক রিসান নসরূল্লাহর সঞ্চালনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিপ্পার ভাইস প্রেসিডেন্ট মোজাম্মেল হোসেন। তিনি তার প্রবন্ধে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা, জ্বালানি আমদানিতে আর্থিক সংকট, প্রাথমিক জ্বালানিতে বিভিন্ন কর হার ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেন।

এফইআরবির চেয়ারম্যান শামীম জাহাঙ্গীরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মাঝে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেইন, বুয়েটের অধ্যাপক এজাজ হোসাইন, বিইআরসির সাবেক সদস্য মো. মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী ও বিপ্পার প্রেসিডেন্ট ফয়সাল খান বক্তব্য রাখেন।

 

জনপ্রিয় খবর

আবহাওয়া

ডা. নিতাই হত্যায় ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড, ৪ জনের আমৃত্যু কারাদণ্ড

জ্বালানির দাম নিয়ে সরকার চ্যালেঞ্জের মুখে: বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী

প্রকাশের সময় : ০৯:১১:৪৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ মে ২০২৩

নিজস্ব প্রতিবেদক : 

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার অভাব এবং জ্বালানির দাম বৃদ্ধিতে সরকার চ্যালঞ্জের মুখে রয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নত অবকাঠামো তৈরিতে ২০৫০ সালের মধ্যে ১৮০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ও বৈদেশিক উৎস থেকে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করা হবে। স্মার্ট গ্রিড, আধুনিক প্রযুক্তি, উন্নত সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থা, সাশ্রয়ী উৎপাদন সিস্টেমে এই বিনিযোগ করা হবে।

সোমবার (২৯ মে) বিকালে জ্বালানি বিটের সাংবাদিকদের সংগঠন ফোরাম ফর এনার্জি রিপোটার্স এবং বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের সংগঠন বিপ্পা আয়োজিত প্রাক বাজেট আলোচনায় তিনি এ কথা বলেন। আসন্ন বাজেটে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা যথা সময়ে ভর্তুকির অর্থ ছাড় করা, আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার এবং ডলার ঘাটতি কমানোর সুপারিশ করেন।

নসরুল হামিদ বলেন, কয়লা ও তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার ধাক্কা এখন আমরা টের পাচ্ছি। আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌছে দেওয়া। সেই কাজ আমরা সফলভাবে করতে পেরেছি। আমাদের কেন্দ্র ও সঞ্চালন লাইনের কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু বড় সমস্যা হয়ে গেছে জ্বালানি ঘাটতি।

তিনি বলেন, নিজস্ব জ্বালানি অনুসন্ধানের ওপর আমরা জোর দিচ্ছি। কিন্তু করোনার মধ্যে কাজ হয়নি। এটি একটি বড় সমস্যা। এর বাইরে আর্থিক যোগানের কথা তুলে ধরে বলেন, একটি কূপ খনন করতে ৯ থেকে ২১ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়। আমাদের নিজস্ব অনুসন্ধান উন্নয়ন দলের ঘাটতি রয়েছে। এজন্য ঠিকাদার দিয়ে কাজ করাতে হয়। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি আগামী তিন থেকে চার বছরের মধ্যে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ করতে।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের সব চাইতে বড় চ্যালেঞ্জ জমির সংস্থান করা। আমরা এখন দুই হাজার মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করছি। এজন্য ছয় হাজার একর জমি প্রয়োজন। এত জমির সংস্থান করা যাচ্ছে না। এরপরও সরকার সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে সব চাইতে বেশি জোর দিচ্ছে।

নসরুল হামিদ বলেন, বিদ্যুতের ট্রান্সমিশন ব্যবস্থাকে বেসরকারি খাতে নিয়ে আসার জন্য ইতোমধ্যে আমরা পলিসি তৈরি করছি। আমরা স্মার্ট গ্রিডের দিকে এগোচ্ছি। ডিস্ট্রিবিউশনে স্ক্যাডা সিস্টেম নিয়ে আসছি এবং এটাকে স্মার্ট করার জন্য গ্রাহক পর্যায় থেকে উচ্চতর পর্যায় পর্যন্ত কাজ করছি।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, যখনই আমাদের কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো এল, তখনই মারাত্মকভাবে কয়লার দাম বেড়ে গেল। যে কয়লার দাম আমরা ঠিক করেছিলাম ৬০ ডলার, তা হয়ে গেল সাড়ে ৪০০ ডলার। গ্যাসের দাম ও তেলের দাম বাড়ল। এই ধাক্কাটি গত এক বছরে মারাত্মক গ্যাপ তৈরি করেছে। বিশেষ করে আর্থিক খাতে। এই ইফেক্টটা কিন্তু আমরা এখন বুঝছি।

তিনি বলেন, করোনার সময় জ্বালানির দাম পড়ে গেছে, কিন্তু চাহিদা ছিল না। যখন চাহিদা বাড়ল, তখন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে দামও বাড়ল। কিন্তু প্রাইস তো আমরা মার্কেট বেইজড করিনি। এখন আমরা এটাও করি না, মেরিট ওর্ডার অনুযায়ী সাপ্লাই দেব। সেই সিস্টেমেও আমরা যাইনি। কারণ আমরা বড় ধরনের একটি ভর্তুকি দিয়ে আসছি। আমাদের সিস্টেম ছিল কানেক্টিভিটি। যারা লাইফ লাইনে বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন, তারা যেন মোটামুটিভাবে ব্যবহারটি বাড়ান। সে কারণে টার্গেট বেইজড ভর্তুকি আমাদের চলছে।

তিনি আরও বলেন, এখন সারা বিশ্বের মধ্যে অর্থনৈতিক সমস্যা। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এর প্রভাব খারাপভাবে পড়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। আমাদের হাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে, সব ব্যবস্থা করা আছে। ট্রান্সমিশনও আমাদের খুব খারাপ যে তা নয়। যে পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রয়োজন, সে পরিমাণ ট্রান্সমিশন লাইনও আমাদের আছে। পরবর্তী নতুন প্রজেক্টও আমাদের আছে। কিন্তু জ্বালানির ঘাটতি আছে।

‘আমাদের বক্তারা বললেন, আগে নিজের দেশের জ্বালানি নিশ্চিত করতে হবে। এটা ঠিক। কিন্তু নিজের দেশের জ্বালানি আমরা কতটা নিশ্চিত করব? বিশেষজ্ঞরা তিন রকম কথা বলছেন, যারা পরিকল্পনা নিচ্ছেন তারা আরেক রকম কথা বলছেন, যারা কাজ করছেন, তারা আবার আরেক রকমভাবে কাজ করছেন। আমি মনে করি, সম্ভাবনা অবশ্যই আছে। নতুন নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার হচ্ছে। গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে আমি মনে করি, আরও বড় আকারে পাওয়া যাবে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজও চলছে। কিন্তু সেটাও অর্থের ব্যাপার। একটি গ্যাস ক্ষেত্র ড্রিলিং করতে গেলে ৯-২১ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হয়। ১০টি গ্যাস ক্ষেত্র ড্রিলিং করতে গেলে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলারের মতো লেগে যায় যায়। তাই ডলার যোগান দিতে হবে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে কন্ট্রাক্টররা আসতে চায় না। সব মিলিয়ে সবকিছু বড় চ্যালেঞ্জর মুখে আছে। পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশ হলো সবচেয়ে ঘনবসতি দেশ। তার ওপর ৬০ শতাংশ পানি। ৭০০টি নদী। ১০০ মেগা ওয়াট সোলার প্রজেক্ট করতে গেলে সাড়ে ৩০০ একর পতিত জমি প্রয়োজন হয়। ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যদি এই মুহূর্তে করতে যাই, তাহলে প্রায় ৬ হাজার একর জমি লাগবে। এটা খুবই চ্যালেঞ্জের। তবে একেবারেই যে কাজ হচ্ছে না তা নয়। ৩০-৪০ মেগাওয়াট হচ্ছে। এজন্য সময় লাগছে। তাই হতাশ হওয়ার কারণ নেই। আমাদের টার্গেট অনুযায়ী জমি দেখতে হবে, জমি পাই কি না।

নসরুল হামিদ বলেন, রুপটপ সোলার অনেকে করছে, অনেকে করে না। যারা করবে, তাদেরও তো অর্থ থাকতে হবে। আমাদের যে ডিস্ট্রিবিউশন লাইন সেটা নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে, সেটার জন্য প্রস্তত কি না? আমি ঢাকা শহরে ২ হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে ফেললাম, রুপটপ সোলার করলাম। ভেরি অ্যাবিলিটির কারণে হঠাৎ করে সেই বিদ্যুৎ নেই হয়ে গেল। তখন কী অবস্থা হবে ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের? সঙ্গে সঙ্গে ব্ল্যাকআউট হয়ে যাবে। তাই সেই প্রস্তুতি না নিয়ে আমি কীভাবে ২ হাজার মেগাওয়াট করব? অনেক টেকনিক্যাল ব্যাপার আছে। এগুলোর পেছনে রীতিমতো কাজ চলছে।

তিনি বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, সেটি করতে বিদ্যুৎ ও এনার্জি ক্ষেত্রে প্রায় ১৮০ বিলিয়ন ডলারের মতো বিনিয়োগ লাগবে। এটি আসবে কোথায় থেকে? এটা আসবে উন্নয়ন অংশীদর, সরকার ও বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে। এজন্য বেসরকারি খাতকে সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। আমরা বেইজলোড প্ল্যান্ট বেসরকারি খাতকে ২০১০ সালে দিয়েছিলাম। কিন্তু কেউ আসেনি। কারণ তারা প্রস্তুত ছিল না। আমাদের তখন বাধ্য হয়ে তেলের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু রাখতে হয়েছে। এখন যেসব তেলে প্ল্যান্টগুলো চলমান রয়েছে, সেগুলো নো ইলেক্ট্রিসিটি, নো পেমেন্ট নীতিতে চলছে। কোনো ক্যাপাসিটি চার্জ নেই। যদি একটি প্ল্যান্টে ফুয়েল শর্ট হয়, আমরা অন্য প্ল্যান্ট দিয়ে চালাব। আমরা এখন সম্পূর্ণভাবে গ্যাস ব্যবহার করছি। বিদেশ থেকে যদি এখন বেশি গ্যাস আনাও হয়, সেটি সংরক্ষণ করার মতো অবকাঠামো আমাদের নেই। এখন আমরা গ্যাস নিয়ে কাতারের সঙ্গে যে কন্ট্রাক্ট করতে যাচ্ছি, সেটা ২০২৬-২৭ সালের পর থেকে আসা শুরু হবে।’

তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন কারণে এখন গ্যাস ড্রিলিং করা যাচ্ছে না। কিন্তু আমরা যদি ড্রিল করি, তাহলে আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে ৫০০-৬০০ এমএমসিএফ গ্যাস পাওয়া যাবে। ভোলার গ্যাস এখন সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। সেটাকে নিয়ে আসার জন্য পাইপলাইন করতে হবে। খুলনা পর্যন্ত সেই পাইপলাইন আনতেও ৯-১০ হাজার কোটি টাকা লাগবে। কে এই খরচ বহন করবে? সরকার নাকি বেসরকারি খাত? আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ তিনটি। একটি অ্যাফোর্টেবল এনার্জি দেওয়া, দুই রিলাইভাল এনার্জি দেওয়া ও তিন আন ইন্টারেপটেড অ্যাওয়ার দেওয়া। এই তিনটি বিষয়কে মাথায় রেখে আগামীতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প নেওয়া হবে। আমরা আগামী দুই বছরের মধ্যে দুই মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করব। কিন্তু তার জন্য তো আমাদের জায়গা থাকতে হবে। আমাদের কাছে সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াটের অফার আছে। কিন্তু আমরা যখন তাদের দিচ্ছি, তারা ২০০-৩০০ মেগাওয়াটের বেশি পারে না। নেপালের বিদ্যুৎ আসছে। এর জন্য ৮-১০ বছর লাগবে। বিএফসিএ পজিশন হবে, এটিও ৮-১০ বছর লাগবে। অনেকগুলো কাজ চলছে। আমি মনে করি, চ্যালেঞ্জকে আমাদের মতো দেশ মোকাবিলা করে সামনে এগোনো সত্যিই খুব কঠিন। বেসরকারি খাতগুলোর অনেক ডিউ হয়ে গেছে। তারা পেমেন্ট পাচ্ছে না। আমাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করা দরকার। সব দেশের পরিস্থিতিই এখন খারাপ। আমাদের একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে। যাদের গ্যাস তেল আছে, যারা গ্যাস তেল বিক্রি করতে পেরেছে তাদের পরিস্থিত ভালো। কিন্তু যেসব দেশ গ্যাস তেল আমদানি করে তারা এর অভাব অনুভব করেছে। আমরা তো মাত্র ডেভেলপমেন্টের দিকে যাচ্ছি। এই চ্যালেঞ্জটা আমাদের বিরাটভাবে আঘাত করেছে। কিন্তু আমাদের হতাশা। কিছু নেই। পরিস্থিতি আবার ভালো হবে। আমরা এখন কয়লা আনতে পারছি না, কিন্তু সামনে আনব।

বিপ্পার উদ্দেশে তিনি বলেন, সোলারের রেগুলার এনার্জির ক্ষেত্রে ট্যাক্সের ব্যাপারটা দেখা দরকার। ইউনিফাইড ট্যাক্সের ব্যাপারে আমরা ইতোমধ্যে এনবিআরের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা মনে করছি সামনে যেহেতু ট্যাক্স আরও বেশি আসবে, তাই এটিকে কমিয়ে আনা প্রয়োজন। তেল ও কয়লার দামের সমন্বয় করা দরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে এগুলোর দাম কমেছে। এসব বিষয়ে আমরা ইতোমধ্যে অ্যাপ্রোচ করেছি। আগামী বাজেটে যাতে ট্যাক্সের নতুন প্রাইসিংয়ের ব্যাপারে যাতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, সেই আশায় আছি আমরা।

এফইআরবির নির্বাহী পরিচালক রিসান নসরূল্লাহর সঞ্চালনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিপ্পার ভাইস প্রেসিডেন্ট মোজাম্মেল হোসেন। তিনি তার প্রবন্ধে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা, জ্বালানি আমদানিতে আর্থিক সংকট, প্রাথমিক জ্বালানিতে বিভিন্ন কর হার ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেন।

এফইআরবির চেয়ারম্যান শামীম জাহাঙ্গীরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মাঝে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেইন, বুয়েটের অধ্যাপক এজাজ হোসাইন, বিইআরসির সাবেক সদস্য মো. মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী ও বিপ্পার প্রেসিডেন্ট ফয়সাল খান বক্তব্য রাখেন।