নিজস্ব প্রতিবেদক :
গণহারে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করবে না বলে জানিয়েছেন নবনিযুক্ত পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম।
বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) সকালে পুলিশ সদরদপ্তরের কনফারেন্স রুমে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, নিরীহ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে, বাণিজ্য হচ্ছে, প্রতারণা হচ্ছে, ৫ আগস্ট ঘিরে এসব হচ্ছে। পাইকারিহারে গ্রেফতার করা যাবে না। গণহত্যায় জড়িত না এমন কাউকে গ্রেফতার করা হবে না।
সারা দেশের বেশ কিছু মিথ্যা মামলা ও হয়রানির বিষয়ে আইজিপি বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর অনেক মামলা হয়েছে। অনেক নিরীহ মানুষকে আসামি করা হয়েছে। সেটা নিয়ে অনেকে বাণিজ্য করছে। তবে আমরা আশ্বস্ত করতে চাই, আপনারা প্রতারিত হবেন না। নিরীহ মানুষদের কোনো ভয় নেই। মামলায় নাম থাকলেই কেউ গ্রেফতার হবে না। পুলিশ কাউকে গণহারে গ্রেফতার করছে না। যাচাই-বাছাই করে, যুক্তিযুক্ত মনে হলেই গ্রেফতারের জন্য যাবে পুলিশ।
গত ৫ আগস্টের পর থেকে নতুন করে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে পুলিশ। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পর নির্বাচনের জন্য মাঠ পর্যায়ে পুলিশকে প্রস্তুত করা হবে জানিয়েছেন পুলিশ প্রধান।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি আপনাকে ব্ল্যাংক চেক দিয়ে বলতে পারি, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে শতভাগ সহযোগিতা করার ক্ষমতা পুলিশের রয়েছে। পুলিশ সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে।
আইজিপি বলেন, সারা দেশে পুলিশ সদস্যরা অপরাধ নির্মূলে কাজ করছেন। কিছু সাময়িক অসুবিধা হচ্ছে। তবে সেটা ভালো কাজ করেই পুলিশকে জনগণের কাছে সেই আস্থা অর্জন করতে হবে।
গণ-অভ্যুত্থানে অতি বল প্রয়োগ করা পলাতক পুলিশ সদস্যদের বিষয়ে জানতে চাইলে আইজিপি বলেন, পলাতক পুলিশ সদস্যদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। যাঁরা দেশের ভেতরে আছেন, তাঁদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হবে। যাঁরা দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন, তাঁদের আইনি প্রক্রিয়ায় ফিরে আনা হবে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে আইজিপি বলেন, কোনো মৃত্যুই কাম্য নয়। ছাত্র-জনতার এই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ সব পরিবারের কাছে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি।
তিনি বলেন, সরকারও বলছে, কোনো নিরীহ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেক মামলা হয়েছে। আসামি অনেক। তাদের অনেকে নিরীহ বলেও গণমাধ্যমে উঠে আসছে। এগুলোকে কেন্দ্র করে অনেকে বাণিজ্য করছেন। তারা কিন্তু এই সমাজের প্রভাবশালী লোক। তারা নিরীহদের নানা প্রলোভনে প্রতারিত করছেন।
আইজিপি আহ্বান জানিয়ে বলেন, কেউ প্রতারিত হবেন না, যদি মনে করেন নিজের কোনো ইন্ধন বা সংশ্লেষ নেই, তাহলে সরাসরি পুলিশের কাছে আসুন। আমরা বিনা যুক্তিতে বা তদন্ত ছাড়া পাইকারি হারে গ্রেপ্তার করব না। মামলা থাকলেই বা নাম থাকলেই গ্রেপ্তার করতে হবে আইনেও তা নেই। এটা যুক্তিসংগত কারণ থাকতে হবে যে আপনি জড়িত বা অপরাধী।
আইজিপি আশ্বস্ত করে বলেন, আইন অনুযায়ী একজন পুলিশ অফিসার কখনোই পাইকারিভাবে গ্রেপ্তার করার কথা না। যারা নিরীহ এবং মনে করছেন কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা নেই হয়রানি করার জন্য মামলায় নাম দেওয়া হয়েছে, তারা এগিয়ে আসুন। আমরা আপনাদের বক্তব্য নিয়ে এগিয়ে যাব। চার্জশিট বা ফাইনাল রিপোর্ট দেব। সেখানে নিরীহরা বাদ যাবেন।
গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া সূত্রে জানতে পারছি, যারা হত্যার শিকার হয়েছিলেন তাদের কেউ কেউ জীবিত ফিরে আসছেন। সেক্ষেত্রে দায়ের হওয়া হত্যা মামলাগুলোর তদন্ত কার্যক্রম কীভাবে পরিচালনা করবেন?
এব্যাপারে আইজিপি বলেন, মামলায় বলা হয়েছে মারা গেছেন। কিন্তু এখন শোনা যাচ্ছে মারা যাননি। এক্ষেত্রে বাদী যদি না জেনে, না বুঝে মামলা করে থাকেন তাহলে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়েরের অভিযোগ আসবে না। সেই মামলায় শুধু ফাইনাল পুলিশ রিপোর্টই হবে। বাদীর বিরুদ্ধে ২১১ ধারায় প্রসিকিউশন হবে না। কিন্তু যদি ইচ্ছাকৃত বা উদ্দেশ্যমূলক মামলা করে থাকেন তাহলে আইনে বলা আছে যে, জেনেশুনে কেন জীবিত মানুষকে মৃত বলে মিথ্যা মামলা করলেন? এক্ষেত্রে ওই ২১১ ধারায় বিচারের মুখোমুখি হতে হবে বাদীকেই। এটাই আমাদের অনুসরণ করা উচিত। আমরা সেটাই চেষ্টা করব।
জঙ্গি কার্যক্রমে যারা জড়িত বলে বলা হয়েছিল তাদের অনেকে জামিন পেয়েছেন। তারা আসলে জঙ্গি কি-না, যেটি প্রমাণিত হয়নি সেটির সূত্র ধরে কীভাবে তাদের আখ্যা দেবেন? এ বিষয়ে আইজিপি বলেন, আদালত যদি কাউকে খালাস দিয়ে থাকে সেখানে তো আমাদের কিছু করার থাকে না। আদালতের রায়ই তো চূড়ান্ত, আমরা যাই বলি না কেন, শ্রদ্ধা করতে হবে।
জঙ্গি সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ আনসার আল ইসলামের নেতৃত্বদানকারী সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া। পুলিশের খাতায় জিয়া মোস্ট ওয়ান্টেড। তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশ সদর দপ্তর পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। সেই জায়গায় আপনারা আছেন কিনা? তিনি কি এখনো ফেরারি, তিনি কি এখনো শীর্ষ জঙ্গি কিনা? তাকে ধরিয়ে দিলে পুরস্কার দেবেন কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে আইজিপির হয়ে উত্তর দেন পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন ও ক্রাইম) রেজাউল করিম। তিনি বলেন, তার লিগ্যাল স্ট্যাটাস আগের মতো। কারণ তিনি কোনো মামলা থেকে খালাস পাননি। তিনি যদি খালাস পান তাহলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর যদি তিনি কনভিকটেড হন তাহলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা। আপাতত এর বাইরে আর কোনো তথ্য নেই।
পুলিশ সদর দপ্তর তদন্ত করছে, যেসব পুলিশ কর্মকর্তার বিভিন্ন মামলায় ও ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়ে নাম এসেছে তারা কোথায়? তাদের বিষয়ে পদক্ষেপ কি হবে? তাদের দায় আপনারা পেয়েছেন কিনা? জানতে চাইলে আইজিপি বলেন, গণমাধ্যমে অনেকের নাম পেয়েছি। আমরা নিজেরাও তদন্ত করছি। আমরা তাদের অবস্থান বের করতে পারিনি। এটা চলমান প্রক্রিয়া। কে কোথায় আছেন সেটা স্পষ্ট নয়। দেশের ভেতরে থাকলে আইনের আওতায় আসবে যদি অবস্থান চিহ্নিত করতে পারি। আর যদি বাইরে থাকেন তাহলেও বিধিগত প্রক্রিয়া আছে।
তিনি বলেন, আমরা প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অনুযায়ী চেষ্টা করছি। তাদের দায় এখনো প্রমাণিত হয়নি। সেটা তখনই বলা যাবে যখন মামলার তদন্ত শেষ হবে। তবে তাদের দায় তো ছিলই। তারা কেউই দায় এড়াতে পারবেন না। তারা তো সশরীরে থেকে পুলিশকে কমান্ড করেছেন। আইনি প্রক্রিয়া তো আছে। সব তথ্য প্রমাণ দিয়েই তাদের দায় নিরূপণ করা হবে। এবং আদালত তথ্যপ্রমাণই দেখেন।
আন্দোলনে এতোগুলো মানুষ মারা গেছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে কেন এশিয়ার ইতিহাসেও এমন ঘটনা নেই উল্লেখ করে আইজিপি বলেন, এমন একটা ঘটনা ও পরিবর্তনের পরও আমাদেরও সক্ষমতায় কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটেছে। সব জায়গায় সঠিক লোক দিয়ে আমরা শেষ করতে পারিনি। আমাদের পুনর্গঠনের কাজটা কিন্তু চলমান। বদলি হচ্ছে। তদন্ত করতে পারে সেরকম সক্ষম লোকদের বাছাই করে এই্ কাজে পুনরায় দায়িত্ব দেওয়া, সারাদেশে বিভাগ অনুযায়ী আলাদা মেন্টরিং ও মনিটরিং কমিটি করেছি। ঊর্ধ্বতন এবং অভিজ্ঞ, যারা বিপুল অভিজ্ঞতা নিয়ে অবসরে গেছেন তাদেরকেও আমরা সঙ্গে নিয়ে আটটা জায়গায় আলাদা মনিটরিং টিম করেছি। প্রতি থানায় মামলাগুলোর তদন্তকারী কর্মকর্তাকে গাইড ও মনিটরিং করার কাজ করবেন। যারা তদন্ত করছেন তাদের দক্ষতা আশানুরূপ নয়। আমার বিশ্বাস তদন্তের মানটা বাড়বে। আর যারা পালিয়েছেন তাদের আমরা লোকেট করতে পারবো।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত আইজি (প্রশাসন) মো. আলমগীর আলম; অতিরিক্ত আইজি (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মো আকরাম হোসেন; অতিরিক্ত আইজি (এইচআর) আবু নাছের মোহাম্মদ খালেদ; ডিআইজি (অপারেশনস) মো. রেজাউল করিম; ডিআইজি (কনফিডেন্সিয়াল) মো. কামরুল আহসান।