নিজস্ব প্রতিবেদক :
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এখন দফা একটাই- শেখ হাসিনার পদত্যাগ। আর কোনো দফা নেই। সংসদ বিলুপ্ত করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। ভোটাধিকার ফিরে দিতে হবে।
বুধবার (১২ জুলাই) রাজধানীর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত মহাসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমেই আমরা ক্ষমতার পরিবর্তন চাই। তবে সেই নির্বাচন আপনার মতো শেয়ালের হাতে হোক, তা চাই না। আপনি বারবার নির্বাচন গিলে খেয়ে ফেলেছেন। ২০১৪ সালে খেয়েছেন, ২০১৮ সালে একবার খেয়েছেন, আবারও খেতে চাইছেন। সেই সুযোগ আর দেওয়া হবে না। ভয়াবহ লুটেরা, ফ্যাসিস্ট অবৈধ এ সরকারকে সরিয়ে দেওয়া হবে।
আগামী নির্বাচনকে ঘিরে সরকার ছক কষছে অভিযোগ করে মির্জা ফখরুল বলেন, প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ; সব জায়গায় নিজেদের লোক বসাচ্ছেন। মন্ত্রীদের এপিএসদের পদোন্নতি দিয়ে জেলায় জেলায় ডিসি বানাচ্ছেন।
তিনি বলেন, ছক কষে আর কোনো লাভ হবে না। জনগণ রাস্তায় নেমে গেছে। আজকে দেখুন- ঢাকায় সুনামি হয়ে গেছে। মাত্র দুদিনের নোটিশে নয়াপল্টনের এ মহাসমাবেশ মানুষে মানুষে সয়লাব। পথে পথে বাধা দিয়েছেন, তবুও জনস্রোত থামাতে পারেননি। তরুণ-যুবকরা এ মহাসমাবেশে ছুটে এসেছেন।
বর্তমান সরকারের আমলে নেতাকর্মীদের খুন-গুম, মামলা-হামলার শিকার হতে হয়েছে জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, এ সরকার আমাদের ছয় শতাধিক নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। এ স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার শত শত মায়ের বুক খালি করেছে। সন্তানদের এতিম করেছে। সরকারের পেটোয়া বাহিনীর নির্যাতনে অনেকে পঙ্গু হয়ে বিছানায় কাতরাচ্ছেন। এমন অবস্থা থেকে আমাদের তরুণ-যুবকরা রুখে দাঁড়াচ্ছেন। তারা তারুণ্যের নেতা তারেক রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দেখুন, আজকের সমাবেশে চারদিকে তরুণ-যুবকের মুখ। তাদের প্রত্যাশা- একটি নতুন বাংলাদেশ দেখতে চাই। এ প্রত্যাশা নিয়ে সবাই এখানে এসেছেন। তারা পরিবর্তন চান। তারা গুম হওয়া মানুষগুলো ফেরত চান। সরকারকে বলবো- দিনে দিনে বাড়িতেছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ। বহু ঋণ হয়ে গেছে, সব শোধ করতে হবে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমাদের অনেক নেতারা এখন দিনক্ষণ গুণছে, আমান উল্লাহ আমানদের মতো কবে সাজা হবে। সবার বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দেওয়া হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখেছে। স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় রেখে অসুস্থ করা হয়েছে। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তা আমলে নেননি। কারণ তিনি মনে করেন বেগম খালেদা জিয়া হলেন সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ। তাকে যদি কারাগারে বন্দি করে রাখা যায় তাহলে তার নিষ্কণ্টকভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে।ইঘচকিন্তু দেশের মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আওয়ামী লীগকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না উল্লেখ করে বিএনপির শীর্ষ এই নেতা বলেন, কারণ সরকারের চুরি-ডাকাতি নিয়ে বলতে গেলে সারাদিন বলা যাবে। সবচেয়ে বড় বিষয় তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। আর সংসদ একটা আছে, যেখানে জনগণের কোনো কথা বলা যায় না।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, বেগম খালেদা জিয়াকে এই সরকার জীর্ণশীর্ণ কারাগারে রেখেছিল, তাকে ভালো চিকিৎসা পর্যন্ত দেয়নি। আমরা বাবারার তার চিকিৎসা বাইরের দেশে করানোর জন্য বলেছিলাম। পরিবার থেকেও বলা হয়েছিল। কিন্তু তাকে যেতে দেয়া হয়নি। এজন্যে তাকে বারবার হাসপাতালে যেতে হচ্ছে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, কোর্টকে ব্যবহার করে এ সরকার ক্ষমতায় থাকতে চায়। তারা মামলা দিয়ে মাসের পর মাস জেলে আটকে রাখে, জামিন দেয় না। যেটা মানুষের বিচার পাওয়ার শেষ ভরসাস্থল, সেখানে এখন বিচার পাওয়া যায় না।
তিনি আরো বলেন, এখন আর কথা বলার সময় নেই। এখন আমাদের একটাই কাজ- এই ভয়াবহ ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের আন্দোলনে নেমে আসা।
জনগণ জেগে উঠেছে জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, যখন জনগণ জেগে ওঠে, তখন তাদের আটকানো যায় না। ঝড় এলে বাঁধ দিয়ে ঠেকে রাখা যায় না। সুনামি এলে তাকে আটকানো যায় না। আজ বাংলাদেশে প্রতিবাদের সুনামি শুরু হয়েছে। ঢাকার বাহির থেকে আসতে অনেক বাধা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তা ঠেকানো গেছে? ঢাকার রাজপথ আজ নেতাকর্মীদের পদচারণায় ভরপুর।
কর্মসূচি ঘোষণার পর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এটা একদফা আন্দোলনের প্রাথমিক কর্মসূচি। এতে যদি আঙ্গুলে ঘি না উঠে, তবে কিভাবে আঙ্গুলে ঘি তুলতে হয়, তা এ দেশের জনগণ ভালো করেই জানেন।
তিনি বলেন, মাত্র দুই কোটি টাকার মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে সাজা ভোগ করতে হচ্ছে। একটি মিথ্যা মামলায় বছরের পর বছর তাকে কারাগারে থাকতে হয়েছে। আজকে মানুষ শপথ নিয়েছে আর এই অন্যায় অবিচার নয়; এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। যারা আমাদের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে, বিচার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে, শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে, তাদের অধীনে আর নয়।
বিএনপির মহাসচিব আরও বলেন, এই সরকারের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। সংসদে এমন আইন পাস করা হয়, যে আইনের মাধ্যমে তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে। এখানে জনগণের জন্য কোনো কাজ করা হয় না। এখন আর কথা বলার সময় নেই। এখন একটাই কথা সেটি হলো, এই অবৈধ লুটেরা সরকারের পতনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া।
তিনি বলেন, সুনামি এলে দেয়াল দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না, ঝড় এলে বাঁশ দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। অনেক বাধা দিয়েও আজকের সমাবেশ বানচাল করতে পারেনি। এই সরকার বাংলাদেশবিরোধী সরকার, এই সরকার গণতন্ত্রবিরোধী সরকার, এই সরকার বাংলাদেশের জনগণবিরোধী সরকার।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমাদের সংবিধানের সবচেয়ে বড় যে জিনিস সেটি হলো, মানুষের অধিকার। আর এই সরকার সেই অধিকার কেড়ে নিয়েছে। ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। আমরা এমন একটি ভোট চাই, যেখানে আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব। সেই ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করব।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সরকারের পদত্যাগ, বিদ্যমান সংসদের বিলুপ্তি, নিরপেক্ষ সরকার গঠন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ সকল রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তি, মিথ্যা-গায়েবি মামলা প্রত্যাহার, ফরমায়েশি সাজা বাতিল, সংবিধান ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি, ভোটাধিকার এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার একদফা দাবিতে রাজপথে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক জোট ও দলগুলোর যুগপৎ ধারায় ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন গড়ে তোলা ও সফল করার একদফা ঘোষণা করা হলো।
তিনি বলেন, অনেকেই বলছেন- এ কর্মসূচি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কর্মসূচি। এটা ঠিক নয়। এ কর্মসূচি ১৮ কোটি জনগণের আশা-ভরসার স্থল, যিনি সুদূর ১২শ’ কিলোমিটার দূরে লন্ডনে নির্বাসিত জীবন-যাপন করছেন, সেই তারুণ্যের অহংকার, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কর্মসূচি। এ কর্মসূচি বিএনপির সঙ্গে এতদিন ধরে যারা যুগপৎ আন্দোলন করে আসছে, তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে, কথা বলে চূড়ান্ত করা হয়েছে। সুতরাং এ কর্মসূচি তাদেরও কর্মসূচি। এ কর্মসূচি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী ১৮ কোটি মানুষের কর্মসূচি।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘চালের দাম এখন ৮০-৯০ টাকা। অথচ তারা (আওয়ামী লীগ) কথা দিয়েছিল ১০ টাকা কেজি চাল খাওয়াবেন। কিন্তু তাদের কথার সাথে সেটার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এরা আবার বলেছিল, কৃষকদের বিনামূল্যে সার দেবে। এখন সারের দাম তিন চার গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আবার সারও পাওয়া পায় না কৃষকরা। ঘরে ঘরে চাকরি দেবেন। চাকরি ঠিকই দিয়েছে, সেটা তাদের নিজেদের লোকদের। যদিও তাদের কাছ থেকেও ১০ লাখ, ১৫ লাখ টাকা ঘুস নিয়েছেন।
ফখরুল বলেন, ‘কৃষকদের কথা দিয়েছিল- বিনামূল্যে সার দেবে। সেই সারের দাম এখন তিন-চারগুণ বেড়েছে। মধ্যবিত্তদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। অথচ মন্ত্রীরা বলেন, উন্নয়নশীল দেশে দাম তো বাড়বেই। সবাই ভালো আছে, খেয়ে-দেয়ে শুয়ে বসে ভালোই চলছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী খাদিজার মুক্তি চেয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, তার (খাদিজা) অপরাধ, সে একটি ইউটিউব চ্যানেলে উপস্থাপনা করেছিল। যেখানে বক্তারা কিছু কথা বলেছিলেন। সেই কারণে তাকে রাতের অন্ধকারে তুলে নিয়ে গেছে। তার জামিনের জন্য হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টে গিয়েও মুক্তি মেলেনি। জামিন দিয়েও তা বাতিল করা হয়েছে। একটা নাবালক মেয়েকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে থাকতে হচ্ছে। তার মা বলছেন, আমার মেয়ের কী অপরাধ, তা তারা জানেন না।
সরকার শুধু দেশের নির্বাচনব্যবস্থা নয়, অর্থনীতি, স্বাস্থ্যব্যবস্থা সব ধ্বংস করেছে অভিযোগ করে তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলো সব ফাঁকা হয়ে গেছে। দেশ থেকে টাকা নিয়ে আমেরিকায় রাখছিলেন, আমেরিকা যেই স্যাংশনস দিয়েছে, সেখান থেকে অন্য দেশে সরাচ্ছেন। সেই টাকা দেশে ফেরাতে আবার প্রণোদনাও দেওয়া হচ্ছে। কালো টাকা দেশে আনতেও প্রণোদনা দিতে হচ্ছে।
দুপুর ১২ টার পর থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন ওয়ার্ড, অঙ্গ ও সাহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন ইউনিট, ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা-উপজেলা ও পৌরসভা ও ইউনিয়ন বিএনপির নেতারা ব্যানার, ফেস্টুন, ডিসপ্লে কার্ড, হেডার, জার্সি, পোস্টার, ধানের শীষ, ধানের শীষের রেপ্লিকা, ক্ষুদ্রবাদ্যযন্ত্র, ক্যাপ, টি-শার্ট, জাতীয় ও দলীয় পতাকা হাতে করে, গায়ে জড়িয়ে সামবেশ স্থলে এসে হাজির হয়েছেন। তারা তাদের নেত্রীর মুক্তি, নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা প্রত্যাহার, দ্রব্যমূল্য কমানো, সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধয়াকের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে স্লোগান দেন এবং মঞ্চে কেন্দ্রীয় নেতারা দেন বক্তব্য।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমানের সভাপতিত্বে এবং উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হক ও দক্ষিণের ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিনের সঞ্চালনায় বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহাজান ওমর, ডাক্তার এ জেড এম জাহিদ হোসেন, মোহাম্মদ শাহজাহান, শামসুজ্জামান দুদু, জয়নুল আবেদিন, নিতাই রায় চৌধুরী, অ্যাডভোকেট আহমদ আজম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম, আবুল খায়ের ভূঁইয়া, মিজানুর রহমান মিনু, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল, বিএনপি নেতা শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, কামরুজ্জামান রতন, ফজলুল হক মিলন, আব্দুস সালাম আজাদ, মীর সরাফত আলী সপু, স্বেচ্ছাসে বদলে সভাপতি এসএম জিলানী, ছাত্রদলের কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ ও সাইফ মাহমুদ জুয়েল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।