নিজস্ব প্রতিবেদক :
দুয়ারে কড়া নাড়ছে ঈদ। তাই কিছু মানুষ এখন কোরবানির পশু কেনার জন্য হাটমুখী আর কিছু মানুষ কাঁচাবাজারে ভিড় করছে। আর মসলা হচ্ছে এ কোরবানির ঈদের অন্যতম অনুষঙ্গ। তাই কোরবানির পশু কেনার সঙ্গে সঙ্গে এখন ভিড় বেড়েছে বিভিন্ন মসলার বাজারেও।
মসলাজাতীয় পণ্যের বাজারে অস্থিরতা চলছে। বাড়তি মুনাফা করতে ধাপে ধাপে বাড়ানো হয়েছে দাম। পরিস্থিতি এমন-কেজি প্রতি ৩৩৫ টাকায় আমদানি করা জিরা খুচরা বাজারে সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ১৩০ টাকা কেজির আদা ক্রেতাকে ৪০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। পাশাপাশি এলাচ, লবঙ্গ, গোলমরিচ ও দারুচিনির দামও হুহু করে বেড়েছে। সঙ্গে ঈদ ঘিরে পোলার চাল, চিনি ও সেমাই কিনতেও গুনতে হচ্ছে বাড়তি মূল্য। এরপরও বাজার তদারকি সংস্থাগুলো একপ্রকার নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিবছর কুরবানির ঈদ এলেই অসাধু ব্যবসায়ীরা মসলাজাতীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করে। তবে এবার সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়েছে।
এদিকে মসলার বাজারে অস্থিরতা কমাতে ২৮ মে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সভা করেন। সভায় জানানো হয়, প্রতি কেজি আদার আমদানি মূল্য ১২৯-১৩০ টাকা। কিন্তু রাজধানীর সর্ববৃহৎ আড়ত শ্যামবাজারে ২৬০ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৩৫০ টাকায়। আদার দাম বাড়াচ্ছেন শ্যামবাজারের আড়তদাররা। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নিজেই অসাধুদের চিহ্নিত করেন। কিন্তু ওই সময় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোনো দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
পাশাপাশি একই সভায় জিরার মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হয়েছে বলে জানায় বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি কেজি জিরা আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৩৩২-৩৩৫ টাকা। কিন্তু ওই সময়ে বাজারে ৮০০-৮৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এলসি থেকে খুচরা বাজারে দামের অনেক পার্থক্য।
রাজধানীর খুচরা বাজার ঘুরে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ দিন প্রতি কেজি জিরা ৯৫০-১০০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা রোজার ঈদের আগে ৪৫০ টাকা ছিল। লবঙ্গ বিক্রি হচ্ছে ১৫০০ টাকা কেজি, যা ওই সময়ে ১৩০০ টাকা ছিল। প্রতি কেজি ভালোমানের এলাচ বিক্রি হচ্ছে ২১০০ টাকা, যা কয়েকদিন আগে ২০০০ টাকা ছিল। ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া দারুচিনি ৪৫০-৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সাদা গোলমরিচ বিক্রি হচ্ছে ১১০০ টাকা, যা রোজার সময়ে ৯০০ টাকা ছিল। দারুচিনি ৫৫০ টাকা, ধনিয়া ১৮০ টাকা, সরিষা ৪০০ টাকা, মেথি ৪৫০ টাকা, তেজপাতা ২২০ টাকা, মিষ্টি জিরা ৫৫০ টাকা, কালোজিরা ৬৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। কেজি প্রতি প্রতিটি মসলা গড়ে ১০ থেকে ১০০ টাকা করে বেড়েছে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা, যা ৪৫ টাকা ছিল। প্রতি কেজি ৯০-১০০ টাকায় বিক্রি হওয়া রসুন ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৬০০ টাকা কেজির শুকনা মরিচ ৭০০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে সোমবার কথা বলে আরও জানা যায়, প্রতি কেজি পোলাও চাল ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি লিটার ঘি বিক্রি হচ্ছে ১৩৬০ টাকা। ২০০ গ্রাম প্যাকেটজাত চিকন সেমাই বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকা আর লাচ্চা সেমাই বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা। এছাড়া প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩৫-১৪০ টাকা।
এদিকে মসলার বাজারে গিয়ে দাম শুনে ঘাম ছুটছে ক্রেতাদের। এদিন বাজারে এক কেজি জিরা ৯০০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। এলাচ তিন হাজার টাকা, দারুচিনি ৪০০ টাকা, আদা ৪৫০ টাকা আর লবঙ্গ ১৮০০ টাকা কেজি বিক্রি হতে দেখা গেছে।
বাজার করতে আসা ভ্যানচালক শরিফুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন যা রোজগার হচ্ছে তা দিয়ে চাল কিনবো নাকি বাজার করবো ভেবে পাচ্ছিনে। দাম বেড়ে যাওয়ায় সবজি কিনতে হিমশিম খাচ্ছি। এভাবে দাম বাড়তে থাকলে আমাদের মতো দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ কিভাবে বেঁচে থাকবে?
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন সালমা খাতুন। আক্ষেপ করেই বলেন, গরিবের দিকে কেউ নজর দেয় না। অল্প বেতন পাই। এতে বর্তমানে বাজার করা খুব কষ্ট।
খুচরা সবজি বিক্রেতা আরিফ হোসেন বলেন, বাজারে সব ধরনের সবজির জোগান একেবারেই কম। আমরা আড়ত থেকে যে দামে কিনছি তার চেয়ে কিছুটা লাভে বিক্রি করছি।
শনির আখড়া মসলা কিনতে এসেছিলেন গৃহিনী রানু বেগম। তিনি বলেন, আমি প্রতি সপ্তাহে একবার বাজার করতে আসি। তবে কোরবানির ঈদ উপলক্ষে আজ মসলার বাজার অনেক গরম। প্রতিটি মসলার ঝাঁঝ লেগেছে দামেও। বাজারে গেলো সপ্তাহের তুলনায় মসলা ভেদে কেজিপ্রতি দাম দুই থেকে তিনশ’ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে বলে জানান এ গৃহিণী।
তবে শনির আখড়া খুচরা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান মিলন স্টোরের মালিক মিলন হোসেন বলেন, দাম যা বাড়ার তা অনেক আগেই বেড়েছে। ঈদে কোনো মসলার দাম নতুন করে আর বাড়েনি। তবে যারা এক মাস বা এরও বেশি সময় পর এখন বাজারে আসছেন তাদের কাছে দামটা বেশি মনে হচ্ছে।
পাইকারি মসলা বিক্রেতা মেসার্স সেলিম ট্রেডার্সের মালিক রফিকুল আলম বলেন, পাইকারি বাজারেও মসলার দাম বাড়েনি। মোটামুটি এক মাস আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের মসলা। কারণ এবার আমদানি ও মজুদ বেশি। তাই নতুন করে দাম বাড়েনি বলেও দাবি করেন পাইকারি মসলার এ বিক্রেতা।
পাইকারি মসলা ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেন বলেন, রাজশাহীর বাজারে মসলার দাম এমনিতেই বেশি। এর ওপর কোরবানির ঈদ উপলক্ষে আরেক দফা দাম বেড়েছে। তাই তাদের বেশি দাম দিয়েই ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে প্রতিটি মসলা কিনে আনতে হয়েছে। এতে আসলে তাদের কারসাজির কিছু নেই, পণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামই দায়ী।
এ বিষয়ে মসলা বিক্রেতা ইশরাক মিয়া বলেন, মসলার বাজার সব সময়ই আমদানি নির্ভর। যারা আমদানি করে সেখানে থেকে দাম বৃদ্ধি করলে এর প্রভাব খুচরা বাজারে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। বর্তমানে ব্যবসায়ীরা চাইলেই এলসি খুলতে পারেন না। যার প্রভাব পড়েছে মসলার দাম।
বাজারের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বিষয়ে জানতে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, যে কোনো উৎসবের আগে আমাদের বাজারের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে গেছে। বাজার যাদের তদারকি করার কথা, তাদের কোনো ভূমিকা না থাকায় এমন অবস্থা। দাম নিয়ন্ত্রণে সংস্থাগুলো তদারকি জোরদার করতে হবে।
রাজধানীর কাওরান বাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা মো. রাসেল বলেন, কুরবানির ঈদ এলেই প্রতিটি পরিবারে বিভিন্ন ধরনের মসলার চাহিদা বাড়ে। এর সুযোগ নিয়ে প্রতিবছর এই সময়ে বিক্রেতারা দাম বাড়িয়ে দেয়। এবার মনে হচ্ছে দাম অনেক বাড়িয়েছে। দেখারও যেন কেউ নেই।
রাজধানীর জিনজিরা কাঁচাবাজারের মুদি বিক্রেতা মো. সাক্কুর আলম বলেন, পাইকারি বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়েছে। সরকারের তদারকি সংস্থা জানে কে বা কারা পণ্যের দাম বাড়ায়। কিন্তু তাদের শাস্তি হয় না। শাস্তি হয় আমাদের মতো খুচরা বিক্রেতাদের।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, মসলাজাতীয় পণ্যের দাম কমাতে অধিদপ্তরে সভা হয়। সেদিন থেকেই মহাপরিচালকের নির্দেশে পাইকারি ও খুচরা বাজারে অভিযান পরিচলনা করা হয়। এখন পর্যন্ত তদারকি চলমান আছে। অনিয়ম পেলে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।