নিজস্ব প্রতিবেদক :
দুয়ারে পবিত্র ঈদুল ফিতর। প্রিয়জনের সঙ্গে গ্রামের বাড়ি ঈদ উদযাপন করতে ঢাকা ছাড়ছে রাজধানীবাসী। বুধবার (১৯ এপ্রিল) থেকে সরকারি অফিস ছুটি। তাই মঙ্গলবার (১৮ এপ্রিল) থেকেই নাড়ির টানে ঘরে ফিরছেন অনেকে। তবে সন্ধ্যার পর থেকে রাজধানীজুড়ে বাস টার্মিনালের মানুষের চাপ। এদিকে আগে বুকিং দিয়ে রাখলেও বাস টার্মিনালে এসে অধিকাংশ বাসের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ তুলেছেন অনেকে।
তবে ছুটির আমেজ নিয়ে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে যেতেই ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে ঘরমুখো মানুষদের। তীব্র গরম ও যানজটে নাজেহাল দশা তাদের। রাজধানীর পল্টন থেকে সদরঘাট পর্যন্ত যেতে ২ ঘণ্টার বেশি সময় গাড়িতে বসে থাকতে হচ্ছে। অনেকেই তীব্র গরম উপেক্ষা করে বিরক্ত হয়ে হেঁটেই গন্তব্যস্থলে যাচ্ছেন।
অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে সদরঘাট টার্মিনাল থেকে শুরু করে আশপাশের এলাকার রাস্তায় দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। জগ্ননাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে লক্ষ্মীবাজার, সুত্রাপুর, বাংলাবাজার, ইসলামপুর রোড, রায়সাহেব বাজার, নয়াবাজার, বংশাল পর্যন্ত যানজটের কারণে যাত্রীদের পায়ে হেঁটে টার্মিনালে আসতে দেখা গেছে।
বাস, সিএনজি, রিকশা, প্রাইভেট কার, মোটরবাইকসহ যে যেভাবে পারছেন ছুটে চলছেন নিজ নিজ গন্তব্যে। ফলে ঈদের তিন-চারদিন বাকি থাকায় অন্য যেকোনো সময়ের থেকে সড়কে যানবাহন বেড়েছে কয়েকগুণ। এদিকে পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে দেশের ঘরমুখো মানুষেরা একত্রিত হচ্ছেন রাজধানীর সায়দাবাদ, গাবতলী, গুলিস্তান, মিরপুর, মহাখালীসহ ছোট-বড় সব বাস কাউন্টারে। ফলে রাজধানীজুড়ে শুরু হয়েছে তীব্র যানজট।
মঙ্গলবার (১৮ এপ্রিল) রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আপনজনদের সঙ্গে ঈদ করতে রাজধানী ছাড়ছে মানুষ। বিকেল থেকে ঘরমুখো মানুষের চাপ বাড়তে থাকে। সন্ধ্যার আগে আগে সেটা আরও বেড়ে যায়। ফলে রাজধানীর কাকরাইল মোড় থেকে যানজটের সৃষ্টি হয়, যা সদরঘাট পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেও মন্থর গতিতে চলা গাড়িতে বসে থাকতে হয়েছে যাত্রীদের। এর সঙ্গে তীব্র গরম। গরম আর যানজটে অতিষ্ঠ ঘরমুখো মানুষ।
গুলিস্তান থেকে রায়সাহেব বাজার হয়ে সদরঘাট পর্যন্ত ছিল বাড়তি যানবাহনের চাপ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বিরক্ত হয়ে অনেক যাত্রী নির্দিষ্ট সময়ে যাতে যেতে পারেন সেজন্য বাস থেকে নেমে গরম উপেক্ষা করে হেঁটেই গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। আবার অনেক যাত্রী যানজটের কারণে গাড়িতেই শুধু পানি দিয়ে ইফতার করেছেন।
রায়সাহেব বাজার থেকে বাহাদুর শাহ পার্কের আশপাশের এলাকাগুলোতে যাত্রীদের ভোগান্তির শেষ নেই। যানজটের কারণে অনেক গাড়ি রায়সাহেব বাজার থেকে ঘুরে চলে আসে। আর যেগুলো যাচ্ছে সেগুলো বাহাদুরশাহ পার্কের কাছে যাত্রীদের নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে হেঁটে বা রিকশায় করে সদরঘাট পৌঁছান যাত্রীরা। ফলে বাহাদুরশাহ পার্ক থেকে সদরঘাট পর্যন্ত দুপাশে যানবাহনের তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়।
গাজীপুর থেকে পরিবার নিয়ে সদরঘাটে যাচ্ছিলেন কবির শেখ। তিনি বলেন, দুপুর ২টায় রওনা দিয়েছি। এখন সাড়ে ৬টা বাজে গুলিস্তানে আছি। আরও দেরি হলে লঞ্চ পাবো না। তাই পায়ে হেঁটে রওনা দিলাম। যে গরম, বাচ্চা নিয়ে বাসে আর বসে থাকা যাচ্ছিল না। চার পাঁচ ঘণ্টা যানজটে থেকে এখন ধৈর্যে কুলাচ্ছে না। অনেক কষ্ট হয়েছে। তবুও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে পারবো সে আশায় বাড়ি যাচ্ছি।
মোটরসাইকেল নিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছিলেন শরিয়তপুরের হেমন্ত কুমার। তাঁতীবাজার মোড়ে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, পল্টন থেকে মোটরসাইকেলে নিয়ে তাঁতীবাজার মোড় পর্যন্ত আসতে সময় লেগেছে প্রায় ২ ঘণ্টা। কী বলবো ভাই যানজটের কথা! এরকম যানজট আগে আমি দেখিনি। পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল নিয়ে চলাচলের অনুমতি দিয়েছে, সেজন্য নিজের মোটরসাইকেল নিয়ে যাচ্ছি। যাতে ঝামেলামুক্তভাবে বাড়ি যেতে পারি। কিন্তু যানজটে দুই ঘণ্টা শেষ!
ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের যাত্রী সাইফুল ইসলাম বলেন, কুড়িল বিশ্বরোড থেকে ৪টায় বাসে উঠেছি। এখনও রায়সাহেব বাজারে বসে আছি। বাসেই পানি খেয়ে ইফতার করেছি। তীব্র গরম এবং সঙ্গে ভারী ব্যাগ থাকায় হেঁটে যাচ্ছি না। নইলে হেঁটেই চলে যেতাম সদরঘাটে। লঞ্চ ৮টায় ছাড়বে, পাবো কিনা জানি না।
সদরঘাটে বিআইডব্লিটিএ’র ট্রাফিক ইন্সপেক্টর হেদায়েত উল্লাহ বলেন, কাল থেকে ছুটি শুরু হচ্ছে। আজ থেকেই ঘাটে যাত্রীর ভিড় দেখা যাচ্ছে। দিনের তুলনায় রাতে বেশি যাত্রী নিয়ে সদরঘাট থেকে লঞ্চ ছাড়বে। ঘাটে লঞ্চ বেশি থাকায় যাত্রীদের ওঠানামা করতেও বেশ অসুবিধা হচ্ছে।
যাত্রী পরিবহনের জন্য মহাখালী টার্মিনাল বাসে বাসে পরিপূর্ণ। এর বাইরেও যেসব বাস টার্মিনালে জায়গা পায়নি, তাদের স্থান হয়েছে রাস্তার দুইপাশে। এছাড়া নাবিস্কো থেকে মহাখালী রেল গেট পর্যন্ত বাসগুলোর সারি দেখা গেছে।
ঘরফেরা মানুষেরা নিজ নিজ গন্তব্যের বাস খুঁজে সেসব বাসের যাত্রী হওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে রাস্তা এবং টার্মিনালের ভেতরে অপেক্ষা করছেন। নামকরা বাস কোম্পানিগুলো ঈদ উপলক্ষে অতিরিক্ত ভাড়া না নিলেও অন্যান্য বাসগুলোতে ঠিকই বেশি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি বাসগুলোর কর্মীরাও নিশ্চিত করেছেন, ঈদ উপলক্ষে তারা ভাড়া বেশি নিচ্ছেন।
রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে জামালপুরের বকশীগঞ্জ যাওয়া যায় নিয়মিত ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। কিন্তু আজ সেই বাসে ভাড়া হাঁকাচ্ছে ১০০০ টাকা। এমনই পরিস্থিতিতে গন্তব্যের অন্য বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন শাকিল আহমেদ।
তিনি বলেন, আমরা সবসময়ই ৪০০-৫০০ টাকাতেই বকশীগঞ্জ যাই সরকার ট্রাভেলসের বাসে। কিন্তু আজ তারা এক হাজার টাকার নিচে কোনো যাত্রীকে নিচ্ছে না। এখানে দেখভালের দায়িত্বে বিভিন্ন সংস্থা থাকলেও কেউ কোনো কথা বলছে না।
ঈদ উপলক্ষ্যে ভাড়া বেশি নিচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে শেরপুরগামী জে কে এন্টারপ্রাইজের হেলপার রুবেল হাসতে হাসতে বলেন, আগে আমরা ৫০০ টাকা করে শেরপুর যেতাম। ঈদ উপলক্ষে এখন ২০০ টাকা বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করে যাওয়া হচ্ছে। আজ যাত্রীরা ৭০০ টাকা করে যেতে পারলেও আগামীকাল ভাড়া আরও বাড়বে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে এনা পরিবহনের কাউন্টারের সামনে গিয়ে দেখা যায় তারা একটি ব্যানার টাঙ্গিয়ে দিয়েছে। সেখানে স্পষ্ট করে লেখা আছে, ঈদ উপলক্ষ্যে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হয় না। এনা পরিবহন সম্পর্কে কোনো যাত্রী অধিক ভাড়া নিয়েছে বলেও অভিযোগ করেননি।
মহাখালী বাস টার্মিনালের ভেতরে দেখা যায়, শতাধিক মানুষ অপেক্ষা করছে বাসের জন্য। তাদেরই একজন শামীম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি নওগাঁ যাব। শাহ ফতেহ আলী বাসের টিকেট কিনেছি। ৬৮০ টাকা ভাড়া নিয়েছে। অন্যান্য সময়ও একই ভাড়া নেয় তারা। ঈদে তাদের অতিরিক্ত ভাড়া চাইতে শুনিনি।
মহাখালী বাস টার্মিনালে একটি ডিজিলেন্স টিম বুথ গঠন করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। পাশেই রয়েছে র্যাবের কন্ট্রোল রুম। বাসস্ট্যান্ডের শুরুতে রয়েছে পুলিশের একটি কন্ট্রোল রুম।
এদিকে বাসচালকরা দাবি করছেন, আজ রাতে তেমন যাত্রী না হলেও আগামীকাল সকাল থেকেই যাত্রীর চাপ আরও বাড়বে।
চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের যাত্রী প্রসেনজিৎ চৌধুরী বলেন, আজ যাত্রীর চাপ কমও না আবার বেশিও না, স্বাভাবিকই মনে হচ্ছে। আমি আজ এখানে এসে টিকিট কেটেছি, আমার গন্তব্যস্থলের টিকিট পেতে কষ্ট করতে হয়নি। চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স বাসের টিকিট অনলাইনে বিক্রি হয় না। তাই এখান থেকে টিকিট কিনতে হচ্ছে। আশা করছি সুন্দর মতো বাড়িতে যেতে পারব।
এদিকে এসডি ট্রাভেলসের টিকিট বিক্রেতা মুরাদ বলেন, কিছু কিছু বাস অগ্রিম টিকিট বিক্রি করছে। আমরা ডেকে ডেকে টিকিট বিক্রি করছি। ঈদের আগেও একটি বাস ভর্তি হতে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগত। আজও এমন সময় লাগছে। আমাদের বাসগুলো চুয়াডাঙ্গা, মধুখালী ও আলফাডাঙ্গা যায়। ঈদযাত্রা শুরু হলেও যাত্রীর তেমন চাপ নেই।
দেশ ট্রাভেলসের সেলস এক্সিকিউটিভ মো. রাজীব বলেন, আমাদের সব টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে। তবে রাজশাহীর যাত্রী বেশি রয়েছে। যশোর আর বেনাপোলের যাত্রী তুলনামূলক কম।
দেশ ট্রাভেলসে নিয়মিত ভাড়া ৬৫০ টাকা। তবে ঈদ উপলক্ষ্যে ৭৫০ টাকার নেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন যাত্রীরা। রাফাত নামের এক যাত্রী অভিযোগ করে বলেন, দেশ ট্রাভেলসের নিয়মিত ভাড়া ৬৫০ টাকা। আর আজ সেটা ৭৫০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে।
লাগাতার তাপদাহ অপরদিকে দীর্ঘ যানজটে ঘরমুখো মানুষের আনন্দের ঈদযাত্রা রূপ নিচ্ছে বিষাদে। এদিকে ঈদকে সামনে রেখে ২০০ টাকার চুক্তিভিত্তিক সিএনজি ভাড়া ৪০০ টাকা, ১৫০ টাকার বাইক ভাড়া ৩০০ টাকাসহ কিছু কিছু গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ করছেন যাত্রীরা।
মেটলাইফ ইনসুরেন্সে কর্মরত নিজাম উদ্দিন বলেন, প্রায় এক ঘণ্টা হলো মুগদা থেকে বাসে উঠেছি পোস্তগোলায় যাবার উদ্দেশে। কিন্তু যাত্রাপথের অর্ধেকও পৌছাতে পারিনি। জানিনা কখন পৌঁছব। দীর্ঘসময় ধরেই বন্ধ হয়ে আছে বাস। আজ পবিত্র কদরের রাত। বাসায় গিয়ে নামাজ আদায় করব কিন্তু রাস্তাতেই সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে।
ফরিদপুরগামী রেদোয়ান বলেন, দুই ঘণ্টা আগে রামপুরা থেকে রাইদা পরিবহনে উঠেছি। এখন মাত্র কমলাপুরে আসলাম। আগে তো বাস ধীরগতি হলেও চলেছে কিন্তু এখন সামনেই এগুচ্ছে না। ভেবেছিলাম রাত ১০টার মধ্যে বাসায় পৌঁছাতে পারব। রাত ১২টা বাজলেও পৌঁছানো সম্ভব হবে না মনে হচ্ছে।
রাজশাহীগামী আরেক যাত্রী বাপ্পি বলেন, অনেক কষ্ট হচ্ছে গাড়িতে বসে থাকতে। সারাদিন রোজা রেখে এভাবে এত যানজট মাড়িয়ে যাওয়া খুব কষ্টকর। পরিবারের অন্য সদস্যরা আগে বাসায় গেলেও নিজের কিছু কাজ থাকায় আমার যেতে দেরি হয়েছে। কিন্তু রাস্তায় ভীষণ ভোগান্তি। গরমে অসহ্য লাগছে সবকিছু।