নিজস্ব প্রতিবেদক :
নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, তা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে আলোচনা অর্থহীন হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বুধবার (২৯ মার্চ) গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানাতেই এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল কর্তৃক মহাসচিবকে প্রেরিত পত্রটির বিষয়ে আলোচনা হয়। পত্রে বিএনপিকে আনুষ্ঠানিক না হলেও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা ও মতবিনিময়ের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে বৈঠক মনে করে, বর্তমানের মূল রাজনৈতিক সংকট নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কোনো আলোচনা অথবা সংলাপ ফলপ্রসূ হবে না এবং তা হবে অর্থহীন।
তিনি বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল একজন অত্যন্ত ভদ্রলোক, তার আবেদনও ভেরি গুড (খুব ভালো)। কিন্তু বাস্তবতা আমরা জানি, তার (সিইসি) কোনো ক্ষমতা নেই। অহেতুক আলাপ করে কী হবে?
মির্জা ফখরুল বলেন, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে যে, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন নয়। ইচ্ছা থাকলেও নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যেহেতু মূল রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের কোনো সম্ভাবনা নির্বাচন কমিশন প্রস্তাবিত আলোচনা ও মতবিনিময়ে সম্ভব নয়, সে কারণে বিএনপি এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারছে না। তবে চিঠি দেওয়ার জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে বিএনপি।
নির্বাচন কমিশনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিএনপি সুযোগ নেবে কি না- এমন প্রশ্নে মির্জা ফখরুল বলেন, সুযোগ কে নেবে? কার কাছ থেকে নেবে? নির্বাচন কমিশন? যার কোনো ক্ষমতা নেই। চলমান সংকট রাজনৈতিক। এই সংকট নিরসনে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। সংকট সমাধানের উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে, তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে।
মির্জা ফখরুল আরও বলেন, পবিত্র রমজান মাসে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির কারণে জনজীবন সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে। অথচ অবৈধ সরকারের মন্ত্রী এবং শাসক দলের নেতাদের—‘জিনিসপত্রের দাম জনগণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে এবং এত মানুষ লাইন দিয়ে ইফতার সামগ্রী কিনছেন প্রমাণ করে যে, তাদের আয় বেড়েছে’; এমন জনগণের সঙ্গে নিকৃষ্ট ধরনের মশকরা ছাড়া আর কিছু নয়।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর বার বার সরকারকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান করলেও সরকার এ ব্যাপারে উদাসীন। সরকারি দলের ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ও এক শ্রেণির কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণেই দ্রব্যমূল্য কমানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। এই জনবিচ্ছিন্ন সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপি ইতোমধ্যে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে দেশব্যাপী কর্মসূচি নিয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, সংসদ বিলুপ্ত করতে হবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিষয় ছাড়া এই সরকারের সঙ্গে অন্য কোনো আলোচনার সিদ্ধান্ত আমাদের নেই।
তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া কোনো আলাপ নেই। আলোচনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিষয় আসলে দল হিসেবে আমরা (আলোচনায় অংশ নেওয়ার বিষয়) বিবেচনা করবো।
নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ২০১৪ সালের মতো সরকারকে বিএনপি ওয়াকওভার দেবে কি না- এমন প্রশ্নে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছি, ২০১৮ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলাম। তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে একবার নয়, দুই দফায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিত করেছিলেন যে নির্বাচনে কোনো ভোট কারচুপি হবে না। প্রশাসন থাকবে নিরপেক্ষ। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখেছি? আমাদের স্পষ্ট কথা বিএনপি বিশ্বাস করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং নির্বাচনের মাধ্যমেই রাষ্ট্র পরিচালনায় যাওয়া।
দৈনিক প্রথম আলোর সাভার প্রতিনিধির নিঃস্বার্থ মুক্তি দাবি করে মির্জা ফখরুল বলেন, সাংবাদিকদের মধ্যে বিভাজন নতুন নয়। পরিকল্পিতভাবেই ভাগ করা হয়েছে জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ সাংবাদিক সংগঠনগুলো।
তিনি বলেন, বিপদগ্রস্ত হচ্ছে সাংবাদিক সমাজ। এর মধ্যে কিছু সাংবাদিক আছেন যাদের সুবিধা দিয়ে সরকার তাদের পক্ষে অবস্থান নেওয়াচ্ছে। আমাদের কথা তো এক সেকেন্ড দেখানোর সুযোগ হয় না, যারা কথা বলতে পারেন তাদের টকশোতে ডাকা হয় না, এটাই বাস্তবতা। এই সরকারের একটাই লক্ষ্য, ক্ষমতায় টিকে থাকতে হবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, এই সরকারের অধীনে কর্মরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যথেচ্ছভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেই চলেছে। হাইকোর্ট এরই মধ্যে বিষয়টি আমলে নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলকে সব তথ্য উপস্থাপন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। সংবাদ মাধ্যমগুলো এরই মধ্যে এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো অবিলম্বে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছে। অবিলম্বে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত তথ্য জনসম্মুখে উপস্থাপন এবং সুলতানা জেসমিনকে হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছে বিএনপি।
ইউরোপ ও আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিকদের দেশে বসবাসকারী নিকট আত্ময়ীয়দের ওপর হামলা ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলায় বৈঠকে গভীর ক্ষোভ, উদ্বেগ ও নিন্দা প্রকাশ করা হয় উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, সম্প্রতি আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেল ‘আল-জাজিরায়’ বাংলাদেশে মোবাইল টেলিফোন আড়িপাতার লক্ষ্যে বিদেশ থেকে প্রযুক্তি ক্রয়ের বিষয়ে সরকারের যোগসাজশ সম্পর্কিত তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশকারী সাংবাদিক জুলকার নাইন সায়ের খানের ভাই মাহিনুর আহমেদ খানকে গত ১৭ মার্চ সাদা পোশাকধারী লোকেরা মারাত্মকভাবে কুপিয়ে আহত করার বিষয়ে গভীর ক্ষোভ, উদ্বেগ ও নিন্দা প্রকাশ করা হয়।
এছাড়াও বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপ প্রবাসী কয়েক জন সাংবাদিকদের দেশে বসবাসরত পরিবারের ওপর আক্রমণ, হুমকির নিন্দা জানানো হয়। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী সাংবাদিক কনক সারোয়ারের গৃহবধূ বোনকে গ্রেফতার এবং মিথ্যা মামলায় কারাগারে প্রেরণের নির্যাতনের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। অবিলম্বে সাংবাদিক এবং তাদের পরিবারবর্গের প্রতি ভীতি প্রদর্শন এবং সকল ধরনের নির্যাতন বন্ধ করার দাবি জানানো হয় বলে জানান মির্জা ফখরুল।
বৈঠকে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ বিমানের ই-মেইল সার্ভার হ্যাকারদের কবলে পড়ার সংবাদে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ইতোপূর্বে ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সাইবার আক্রমণের কবলে পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা করতে না পারা সরকারের ব্যর্থতা এবং কোনো প্রভাবশালী মহলের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে। ডিজিটাল সিকিউরিটির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সাইবার নিরাপত্তা রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার।
‘প্রকৃত পক্ষে সাইবার নিরাপত্তার নামে সরকার নিপীড়নমূলক আইন তৈরিতেই ব্যস্ত একই সঙ্গে এই আইনের অপ্রয়োগের মাধ্যমে ভিন্ন মত পোষণকারী সাংবাদিক, সাধারণ নাগরিক ও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপরে নির্যাতনে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করে নিজেদের অবৈধ ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী কারার হীন চক্রান্ত করছে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান গুলোর আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করনে চূড়ান্তভাবে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। ’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে বৈঠকে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহ উদ্দিন আহমেদ, বেগম সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু উপস্থিত ছিলেন।