স্পোর্টস ডেস্ক :
ইস্তাম্বুলের আতাতুর্ক অলিম্পিয়াত স্টেডিয়ামে হাজির হয়েছিলেন প্রায় ৭২ হাজার দর্শক। ইতিহাসের সাক্ষী হতে এসেছিলেন তারা। ইউরোপ সেরার শিরোপাটা ইংল্যান্ড নাকি ইতালিতে যায় সে সাক্ষী হওয়ার জন্য। সবচেয়ে বড় কথা, ম্যানসিটি যদি ফাইনালটি জিতে যায়, তাহলে হবে ইতিহাস। কারণ, একদিকে তাদের জন্য যেমন হবে প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়, তেমনি হবে ২৪ বছর পর কোনো ইংলিশ ক্লাবের ট্রেবল জয়। অবশেষে ঘুচল সেই আক্ষেপও। তুরস্কের ইস্তানবুলে ইন্টার মিলানকে হারিয়ে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইউরোপিয়ান মুকুট জয় করলো ম্যানচেস্টারের ক্লাবটি।
যারা ইতিহাসের সাক্ষী হতে এসেছিলেন, তাদের উদ্দেশ্য সফল। ইতালিয়ান ক্লাব ইন্টার মিলানকে ১-০ গোলে হারিয়ে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় করলো ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটি।
সে সঙ্গে ১৯৯৯ সালে ম্যানইউর পর ২৪ বছর বিরতি দিয়ে এই প্রথম কোনো ইংলিশ ক্লাব হিসেবে ট্রেবল জয় করলো পেপ গার্দিওলার শিষ্যরা। শুধু তাই নয়, ইতিহাসে ১০ম দল হিসেবে ট্রেবল জয়ের গৌরব অর্জন করলো তারা। মোট ৮টি ক্লাব ১০বার ট্রেবল জয়ের কৃতিত্ব অর্জন করেছে। এর মধ্যে ম্যানইউর পর ম্যানসিটি হচ্ছে দ্বিতীয় ইংলিশ ক্লাব, যারা ট্রেবল জয় করলো।
ম্যানসিটি কোচ পেপ গার্দিওলার জন্য এটা দ্বিতীয়বার ট্রেবল জয়ের ঘটনা। একই সঙ্গে তিনি তৃতীয়বারের মতো জিতলেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা। বার্সেলোনার হয়ে এর আগে দু’বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জয়ে করেছিলেন তিনি। একবার জিতেছিলেন ট্রেবল শিরোপা।
স্প্যানিশ কোচ গার্দিওলার হাত ধরে এমন কোনো শিরোপা বাকি নেই, যেগুলো জয় করেনি ম্যানসিটি। শেষ ৬ বছরে পাঁচবার ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জয়ের পরও উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জয় করতে পারছিলো না তারা। এর আগে ২০২০-২১ মৌসুমেও ফাইনালে উঠেছিল সিটি। কিন্তু সেবার চেলসির কাছে হেরে শিরাপো বঞ্চিত থাকতে হয়। এবার আর ইন্টার মিলানের কাছে হারতে হলো না।
শনিবার (১০ জুন) ইস্তানবুলে আতাতুর্ক অলিম্পিক স্টেডিয়ামে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ফাইনালে ইন্টার মিলানকে ১-০ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন সিটিজেনরা।
ম্যাচের মাত্র ৫ম মিনিটেই দারুণ সুযোগ সৃষ্টি করেছিলেন বার্নার্দো সিলভা। ডি বক্সে ঢুকে শট নিয়েছিলেন, কিন্তু টার্গেট মিস করে গেছেন। এরপর পাল্টা আক্রমণে উলটো বিপদেই পড়তে যাচ্ছিল সিটি। ২৫ মিনিটে বারেল্লার দূরপাল্লার শট অল্পের জন্য জাল ছোঁয়নি। তৈরি ছিলেন না সিটির গোলরক্ষক এডারসনও।
এরপর টানা কয়েকটি আক্রমণ চালিয়েও গোল পেতে ব্যর্থ হয় সিটিজেনরা। ইন্টার মিলানের জমাট রক্ষণ কিছুতেই ভাঙতে পারেনি হলান্ড-গ্রিলিশরা। প্রথমার্ধে সিটির জন্য বড় ধাক্কা কেভিন ডি ব্রুইনার চোট।
ম্যাচের ৩০ মিনিটে মাঠে পড়ে যান কেভিন ডি ব্রুইনা। সে সময় শুশ্রূষা নিয়ে ফের মাঠে ফিরলেও অস্বস্তি ছিল চোখে-মুখে। ৩৫ মিনিটে বড় ধাক্কা খায় ম্যানসিটি। অস্বস্তিতে ভোগা ডি ব্রুইনাকে মাঠ থেকে তুলে নেন গার্দিওলা। নামেন ফিল ফোডেন। অবাক করা তথ্য হচ্ছে, ২০২০-২১ মৌসুমের ফাইনালে চেলসির বিপক্ষেও ইনজুরি নিয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন এই বেলজিয়ান প্লেমেকার। ম্যাচটি ১-০ গোলে হেরে যায় ম্যানসিটি। এবার আর সেই আক্ষেপের পুনরাবৃত্তি হলো না।
ইনজুরি টাইমের প্রথম মিনিটে আকানজির বাঁ পায়ের শট গোলবারের ওপর দিয়ে গেলে গোল ছাড়াই প্রথমার্ধ শেষ করে ম্যানসিটি।
দ্বিতীয়ার্ধের ৫৮ তম মিনিটে সিটির গোলরক্ষককে একা পেয়েও গোল করতে ব্যর্থ হন লাওতারো মার্টিনেজ। পাল্টা আক্রমণে ওঠে আসে সিটি। সুফল পেতেও সময় লাগলো না। ৬৮ মিনিটে একটা সংঘবদ্ধ আক্রমণে বল পেয়ে দারুণ শটে গোল করলেন সিটির স্প্যানিশ মিডফিল্ডার রদ্রি। তার জোরালো শটের কোনো জবাবই ছিল না ইন্টারের গোলরক্ষক ওনানার কাছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন বল জালে জড়িয়ে যেতে।
পরের মিনিটেই গোল প্রায় শোধ দিয়েই ফেলেছিল ইন্টার। প্রতিআক্রমণে উঠে ঢুকে পড়েছিল সিটির রক্ষণভাগে। ডামফ্রির ক্রসে যে হেড নিয়েছিলেন ডিমারকো তা এডারসনকে পরাস্ত করলেও ফেরে ওপরের পোস্টে লেগে। ফিরতি বলে ফের ডিমারকো হেড নিয়ে বল দিয়েছিলেন লুকাকুকে। অবিশ্বাস্যভাবে সুযোগ নষ্ট করেন এই বেলজিয়ান। ৭৩ মিনিটে ফের সুযোগ নষ্ট করেন লুকাকু।
৭৮ মিনিটে দারুণ সুযোগ পেয়েছিলেন ফোডেন। কিন্তু ডিবক্সে ঢুকে বাঁ পায়ে যে শট নেন তা সহজেই নিজের আয়ত্তে নেন ওনানা।
৮৮ মিনিটে দারুণ সেভ করে দলকে বাঁচান সিটির গোলরক্ষক এডারসন। ম্যাচে সমতায় ফিরতে একের পর এক চেষ্টা করে গেছে ইন্টার। কিন্তু শেষের সময়টুকু দারুণভাবে রক্ষণ সামলেছে গার্দিওলার শিষ্যরা। শেষ বাঁশি বাজতেই ইতিহাস গড়ার আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন সিটির খেলোয়াড়রা।
ম্যাচেও ছিল ম্যানসিটির স্পষ্ট আধিপত্য। বল দখলের লড়াইয়ে গার্দিওলার শিষ্যরা ছিলেন অনেক এগিয়ে। ৫৬ ভাগ বল ছিল তাদের দখলে। ইন্টারের ছিল ৪৪ ভাগ বল দখলে। গোল লক্ষ্যে ৭টি শর্ট নিয়েছিল সিটি। তবে গোল লক্ষ্যে শট নেওয়ায় ইন্টার এগিয়েছিল। তারা শট নিয়েছে ১৪টি। যার টার্গেটে ছিল ৬টি। কিন্তু ম্যানসিটির ব্রাজিলিয়ান গোলরক্ষক এডারসন ছিলেন যেন হিমালয়ের মতো দৃঢ়। তাকে ফাঁকি দিয়ে একবারও বল জালে জড়াতে পারেনি।
২০০৮ সালে আবুধাবির রাজকীয় পরিবার ম্যানসিটির দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ক্লাবটির উত্থান শুরু। এরপরই তারা যেতে প্রথম ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা। তবে গত দেড় দশকে বেশ কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের দারুণ সম্ভাবনা তৈরি করেও কাঙিক্ষত সাফল্য পায়নি তারা।
শিরোপা জয়ের পর গোলদাতা রদ্রি বললেন, এটা খুবই আবেগী একটি মুহূর্ত। একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন হলো। এখানে সবাই এই একটি শিরোপার জন্য ভুভুক্ষের মতো অপেক্ষায় ছিলাম। জানি না সবার জন্য সেটা কত বছরের, আমার জন্য কত বছরের।
সিটি অধিনায়ক ইলকায় গুন্ডোগান বলেন, আমরা আজ ইতিহাস সৃষ্টি করেছি। আমরা জানতাম, সবাই ট্রেবল জয়ের কথা বলছিলো। যার কারণে প্রচুর চাপ ছিল। কিন্তু এই দলটি এমন কিছু ফুটবলারে গড়া, যাদের চাপ জয় করার দারুণ ক্ষমতা রয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা, এখন আর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড একমাত্র ক্লাব নয়, যারা ইংলিশ ক্লাব হিসেবে ট্রেবল জিতেছিল। তাদের সঙ্গে বসে গেছে নগর প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার সিটির নামও। সেই ১৯৯৯ সালে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের হাত ধর প্রথম এবং সর্বশেষ ট্রেবল জিতেছিল ম্যানইউ।
২৪টি বছর আর কোনো ইংলিশ ক্লাব ট্রেবল জয়ের কৃতিত্ব দেখাতে পারেনি। এবার যেটা পারলো ম্যানসিটি। ইস্তাম্বুলে ইন্টার মিলানের বিপক্ষে ম্যাচের ৬৮তম মিনিটে স্প্যানিশ মিডফিল্ডার রদ্রির গোলে ইউরোপ বিজয় নিশ্চিত করে গার্দিওলার শিষ্যরা। আর্সেনালকে পেছনে ফেলে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, ৩ জুন ওয়েম্বলিতে ম্যানইউকে হারিয়ে এফএ কাপ এবং সর্বশেষ ইন্টারমিলানকে ১-০ গোলে হারিয়ে জিতলো চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা।
২০১৬ সালে প্রিমিয়ার লিগে সিটির কোচ হয়ে আসার পর ৫টি লিগ শিরোপা জয় করেছেন। এর মধ্যে ২০১৯ সালে ডমেস্টিক ট্রেবল জয়ের কৃতিত্ব দেখান। এছাড়া ২০১৭-১৮ মৌসুমে প্রথম এবং একমাত্র ইংলিশ ক্লাব হিসেবে ১০০ পয়েন্টের মাইলফলক স্পর্শ করে তার ক্লাব সিটি।
এতসব সত্ত্বেও বড় মুকুটটা উঠছিল না ম্যানসিটি কোচ গার্দিওলার মাথায়। বেশ কয়েকবার দুর্দান্ত একটি স্কোয়াড নিয়েও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জিততে পারছিল না তারা। এমনকি ২০২০-২১ মৌসুমে ফাইনালে উঠেও চেলসির কাছে হেরে যেতে হয়।
ইস্তাম্বুলের ফাইনালের আগে এ কারণেই গার্দিওলা বলেছিলেন, তিনি এবং তার দল কখনোই কিংবদন্তি হতে পারবেন না, যদি না তারা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপাটি জয় করতে না পারেন।
এবার অপেক্ষার পালা শেষ হলো। ইস্তাম্বুল ম্যানসিটির ইতিহাসে আলাদা একটি স্থান করে নিলো। এই শহরটিই ম্যানসিটির ট্রফি ক্যাবিনেটে সবচেয়ে বড় মুকুটটি বসিয়ে দিয়েছে।
ফাইনাল জয়ের পর পেপ গার্দিওলা বলেন, এই ইতিহাস লেখা হলো তারকা ফুটবলারদের দ্বারা। এটা এখন আমাদের। আমি শুধু চেষ্টা করেছি। আমি খুবই সন্তুষ্ট। কারণ, এই শিরোপা জয়টা ছিল খুবই কঠিন।