নিজস্ব প্রতিবেদক :
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি তথা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের কোনো সংলাপের সম্ভাবনা রয়েছে কি না- এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমেরিকায় ট্রাম্প-বাইডেন যেদিন বৈঠক করবে সেদিন আমরাও বৈঠক করবো।
মঙ্গলবার (৩১ অক্টোবর) বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামে যোগদান উপলক্ষে সম্প্রতি বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে তিনদিনের সরকারি সফরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে সংবাদ সম্মেলন করছেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কার সঙ্গে সংলাপ? বিরোধী দলের সঙ্গে। কোন বিরোধী দল? বিরোধী দলটা কে? সংসদীয় নিয়মে বিরোধী দলের একটা ব্যাখ্যা আছে। বিরোধী দল হচ্ছে, সেই দল যাদের সংসদে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি আছে। এর বাইরেরগুলো পরিগণিত হয় না। আমেরিকায়ও হয় না। ট্রাম্পকে তারা (যুক্তরাষ্ট্র) কী বলবে? যদিও আমরা তাদের মতো সরকার ব্যবস্থায় নেই। এটা মাথায় রাখতে হবে।
তিনি বলেন, এই যে মানুষগুলোরে হত্যা করা হলো, তাকে (মার্কিন রাষ্ট্রদূত) একটা প্রশ্ন করা হলো না কেন- যখন উপনির্বাচনে একটা ঘটনা ঘটেছে, হিরো আলমের ওপর হামলা, বিচার চাইল। এখন পুলিশ হত্যা করল, এতগুলো সাংবাদিককে মারল, তারা এটার বিচার দাবি করল না কেন?
শেখ হাসিনা বলেন, খুনিদের সঙ্গে আবার কীসের বৈঠক। খুনিদের সঙ্গে আবার কীসের আলোচনা? যারা মানুষের সম্পদ নষ্ট করেছে, যারা আমাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নষ্ট করেছে। সে বসে বসে ডিনার খাক (মার্কিন রাষ্ট্রদূত), ডায়ালগ করুক। এটা আমাদের দেশ, আমরা স্বাধীনতা এনেছি রক্ত দিয়ে।
তিনি বলেন, আমরা যে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র এ কথাটা মনে রাখা দরকার। খুনিদের সঙ্গে সংলাপ এটা আমাদের বাংলাদেশের মানুষও চাইবে না। বরং বাংলাদেশের মানুষ এখন বিএনপি-জামায়াতকে ঘৃণা করে। তারা যেটুক অর্জন করেছে, সেটাও তারা হারিয়েছে। এখন মানুষের কাছে তারা ঘৃণার পাত্র, দুর্নীতিবাজ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের দুর্নীতির জন্য কানাডা থেকে লোক এসে সাক্ষ্য দিচ্ছে।
২৮ অক্টোবরের ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, এখন তারা চুপ কেন? অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ মানবাধিকার সংস্থাগুলো এখন চুপ কেন? তাদের মানবিক বোধগুলো গেল কোথায়? দেশের বুদ্ধিজীবীরা চুপ কেন?
সাংবাদিকদের উদ্দেশে সরকারপ্রধান বলেন, মাঝখানে কিছুদিন বিএনপি রাজনৈতিকভাবে কর্মসূচি করছিল এবং আপনারা নিশ্চয়ই বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছিলেন আমাদের সরকার কিছু তাদের কোনো বাধা দেয়নি। তাদের ওপর একটা শর্ত ছিল, তারা অগ্নিসংযোগ বা ভাঙচুর করবে না।
বিএনপি একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায় মন্তব্য করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেছেন, এরা (বিএনপি) আসলে নির্বাচনই চায় না।
আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে কোনো সংলাপ হবে না বলে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, কার সঙ্গে সংলাপ, খুনিদের সঙ্গে কীসের সংলাপ, কীসের আলোচনা? খুনিদের সঙ্গে সংলাপ, এটা বাংলাদেশের জনগণও চায় না।
নির্বাচন কেউ ঠেকাতে পারবে না জানিয়ে তিনি আরও বলেন, নির্বাচন হবে এবং সময়মতোই হবে। নির্বাচন থামাতে পারবে না, আগেও পারেনি, এবারও পারবে না। যে যা-ই বলিআমরা কারও হুমকি পরোয়া করি না।
শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি সন্ত্রাসী সংগঠন। কানাডার আদালত একাধিকবার সেই রায় দিয়েছে। তাই সন্ত্রাসীদের কীভাবে শিক্ষা দিতে হয়, এবার সেভাবেই দিতে হবে।
ফিলিস্তিনে বর্বরোচিত হামলা চালানো ইসরায়েলের সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াতের হামলার কোনো পার্থক্য নেই বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাঝখানে তারা (বিএনপি) কিছুটা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করছিল। আমাদের সরকার তাদের কোনো বাধাও দেয়নি। তাদের ওপর একটি শর্ত ছিল তারা যেন অগ্নিসন্ত্রাস-ভাঙচুর, এগুলো না করে। তারা যখন সুস্থ রাজনৈতিক কর্মসূচি করছিল, মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসও ধীরে ধীরে অর্জন করতে শুরু করেছিল। কিন্তু ২৮ তারিখে তাদের যেই ঘটনা, বিএনপি যেসব ঘটনা ঘটাল, বিশেষ করে মাটিতে ফেলে পুলিশকে যেভাবে কোপালো, সাংবাদিকদের ওপর হামলা, এই ঘটনার পরে জনগণের ধিক্কার ছাড়া, বিএনপির আর কিছু জুটবে না।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পরিচয় দেওয়া মিঞা জাহিদুল ইসলাম আরেফিকে নিয়ে বিএনপির বিতর্কিত ও হাস্যকর কর্মকাণ্ডের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আসলে তাদের নেতাই নেই, দলটির সমস্যা এটাই।’
এক প্রশ্নের জবাবে সরকারপ্রধান বলেন, একজন ফ্রড, ভুয়া সে এসে তাদের (বিএনপির) অফিসে বসে সাফাই গাইল। আর যখন ধরা পড়ল তখন বলল, জানে না। আসলে তাদের (বিএনপির) নেতাই নেই। দলটার সমস্যাটাই এটা। নেতৃত্ব নেই, আছে কিছু মাইকবাজ। সারাদিন মুখে মাইক লাগিয়ে কথা বলে। সেটাও এখন আবার আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে গেছে। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি। আন্ডার গ্রাউন্ড থেকে সেই সুবিধা নিয়ে কথা বলছে।
২৮ অক্টোবর বা পরবর্তীতে যারা অগ্নিসন্ত্রাস করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে সরকারপ্রধান বলেন, কিছু অপরাধী জামিন পেয়ে ছুটে এসেছে। জামিন পেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেহেতু এরা জামিন পেয়ে গেছে, এরা অপরাধ করছে। এদের দ্রুত সাজা দিয়ে শিক্ষা দেওয়া উচিত। এভাবে আগুন লাগাবে আর মানুষের ক্ষতি করবে এটা কখনও মেনে নেওয়া যায় না। যারা এভাবে অগ্নিসন্ত্রাস করে যাচ্ছে, তাদের সাজাটা যেন ঠিকমতো হয়; সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। যে হাত দিয়ে আগুন দেবে, সেই হাতে শাস্তি দিলে তাহলে তারা কষ্ট বুঝতে পারবে।
এ সময় দেশবাসীকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, দেশবাসীকে সজাগ ও সচেতন থাকার আহ্বান জানাই। যারা এসব অগ্নিসন্ত্রাস করছে তাদের ধরিয়ে দিন। এর আগে তারা যখন শুরু করেছে তখনও মানুষ ঠেকিয়েছে। এবারও মানুষই ঠেকাবে।
২৮ অক্টোবরকে কেন্দ্র করে ঢাকায় ঘটে যাওয়া ঘটনা সরকারের পক্ষে গেল কি না এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, লাভ-লোকসানের ব্যাপার না। মানুষকে হত্যা করছে, মানুষই সিদ্ধান্ত নেবে। বরং আমাদের লাভ-লোকসান না জিজ্ঞেস করে বিএনপি জিজ্ঞেস করা দরকার; তারা যে গুন্ডামি-সন্ত্রাসী, অগ্নিসন্ত্রাস করে যাচ্ছে তাতে তারা কতটুকু লাভবান হচ্ছে। এটা আপনারা (প্রশ্ন করা সাংবাদিককে প্রধানমন্ত্রী) বরং বিএনপি নেতাদের জিজ্ঞেস করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আকার ছোট করলে দেখা যায়—অনেক মন্ত্রণালয়ের কাজ হয় না। কাজগুলো বাধাগ্রস্ত হয়ে যায়। ওই জন্যই বলেছি, আমাদের যেভাবে আছে ওভাবেই চলমান থাকবে। সরকার রুটিন কাজ করবে।’
তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার কে হবে, সেদিকে আমরা যাচ্ছি না। আমরা যেভাবে চলারৃ অন্যান্য দেশের সঙ্গে আলাপ করেছি, সংসদীয় গণতন্ত্র যেভাবে আছে সেভাবে চলবে। আমরা যারা থাকবো, নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে আমরা রুটিনওয়ার্ক পালন করবো। দৈনন্দিন কাজ করবো যাতে সরকার অচল হয়ে না যায়। যে প্রার্থী হবে সে তো আর সরকারি কোনও সুযোগ পাবে না।
নির্বাচনের সময় ভারত, কানাডা বা ইংল্যান্ডসহ সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে হয়, বাংলাদেশেও সেটা হবে উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, যখনই তফসিল হবে এবং নমিনেশন সাবমিট হবে, তখন থেকে আর মন্ত্রীরা সুযোগ-সুবিধা বা পতাকা কোনও সুবিধা ব্যবহার করতে পারবে না। একজন প্রার্থী হিসেবে তাকে ভোট চাইতে হবে। ২০১৮ সালে সেভাবে হয়েছিল। হ্যাঁ, ২০১৪ সালে আমি অন্য দল থেকে কিছু মন্ত্রী নিয়েছিলাম। ২০১৮ সালে সেই পদ্ধতি করিনি। যেটা অন্য দেশে হয় এবারও সেই পদ্ধতি হবে। রাষ্ট্রপতি অসুস্থ, তিনি বাইরে আছেন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হবে। তফসিলের পর যে সময়টা দেওয়া হয়, মনোনয়নপত্র জমার সময় দেওয়া হয়। বাছাই হয়। প্রত্যাহার হয়। প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রতীক বরাদ্দের পর নির্বাচন প্রচারণা শুরু হয়। নির্বাচন প্রচারণার সময় কোনও মন্ত্রী কোনও সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিতে পারবে না। এটাই নিয়ম। কিন্তু সরকার থেমে থাকবে না। সরকারি দৈনন্দিন যে কাজ রুটিন ওয়ার্ক যেটা বলে, সেগুলো চলবে। নইলে তো স্থবির হয়ে যাবে, দেশ তো চলবে না।’
নিজে প্রার্থী হওয়ায় গণভবনে বসে আর ভিডিও কনফারেন্স করবেন না বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি আলাদা একটা অফিস নিয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন।
বিএনপির কার্যালয়ে কথিত মার্কিন নাগরিককে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে জড়িত সাবেক সেনা কর্মকর্তা হাসান সারওয়ার্দীর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা হবে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘উনি তো সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে আসছে। তার থেকে ওই নামটা আসছে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো। তাকে ছাড়া হচ্ছে না। তাকে ছাড়া হবেও না। ইতোমধ্যে আমি নির্দেশ দিয়েছি। তাকেও গ্রেফতার করা হবে এবং জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তাকে খোঁজ করা হচ্ছে। তাকে ঠিকই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, এরকম ফ্রড সে করলো কেন? সে যেই হোক আইনের কাছে সবাই সমান।
বিএনপির কার্যালয়ে কথিত মার্কিন নাগরিকের সংবাদ সম্মেলন প্রশ্নে শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটি রাজনৈতিক দলের দরজা খোলা থাকে, যে কেউ আসতে পারে। যে কেউ কথা বলতে পারে। কিন্তু যে এসে বসলো! যেভাবে খাতির তর্জমা করে বসানো হলো। আর যেভাবে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হলো। এবং যত মিথ্যা তথ্য দিয়ে গেলো। বোধহয় নিজেদের কিছু ইমেজ বাড়ানোর জন্য এ ধরনের ভাড়াটে লোক নিয়ে আসছে। তাকে যখন ধরা হলো এবং জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো, তখন আসল কথা বেরিয়ে এলো। সে ভাড়া খাটতে আসছিল। তিনি মার্কিন নাগরিক, এটা মার্কিনদের দেখতে হবে। আর কথায় কথায় আমাদের স্যাংশন দেয়। আমার জনগণ আছে আর আমার দেশ আছে। আমি এটা নিয়ে আছি।’
শঠের সঙ্গে শঠের মতো আচরণ করতে হবে, এমনটা উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘তারা এখানে সেখানে চোরাপথে গিয়ে একেকটা গাড়ি পোড়াচ্ছে। তাদের চিহ্নিত করা ও গ্রেফতার করে যথাযথ শাস্তি দেওয়া… আর যে হাত দিয়ে গাড়ি পোড়াবে, আমার তো মনে হয়—যার গাড়ি যখন পোড়াবে আর যে ধরা পড়বে, তার হাতও ওই আগুন দিয়ে পোড়ায়ে দেওয়া উচিত। তাহলে তাদের শিক্ষা হবে, না হলে শিক্ষা হবে না। তাদের শিক্ষাটা ওইভাবে করতে হবে। আচরণের জন্য সে রকম শিক্ষা দিতে হবে।’
বিএনপিকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আশা করবো এগুলো বন্ধ করবে। না করলে পরিণতি তাদের ভোগ করতে হবে। এবার এমনি এমনি যেতে দেবো না। নির্বাচন এভাবে তারা থামাতে পারবে না। ২০১৩ সালে পারেনি, ২০১৮ সালে পারেনি। এবারও পারবে না। নির্বাচন যথাসময়ে হবে। তারা তো চাচ্ছে এটাই (নির্বাচন বানচাল)। তারা তা পারবে না। জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। জনগণ ওদের সঙ্গে নেই। জনগণকে কষ্ট দিয়ে রাজনীতি হয় না। এটা তারা ভুলে যায়।’