স্পোর্টস ডেস্ক :
উরুগুয়ের ফুটবলের অন্যতম আইকন লুইস সুয়ারেজ। ১৭ বছর জাতীয় দলের হয়ে খেলে ৬৯ গোল করেছেন তিনি। দুর্দান্ত ক্যারিয়ারে ইতি টানার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারকা এই ফুটবলার। আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় জানানোর ঘোষণা দিতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলেন সুয়ারেজ।
আগামী শুক্রবার বিশ্বকাপ বাছাইয়ে প্যারাগুয়ের বিপক্ষে ম্যাচটিই হতে চলেছে উরুগুয়ের জার্সিতে সুয়ারেজের শেষ ম্যাচ। এই ম্যাচ দিয়েই জাতীয় দলের জার্সিখানা তুলে রাখবেন তিনি।
স্থানীয় সময় সোমবার (০২ সেপ্টেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা দেন তিনি।
প্যারাগুয়ে ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে সুয়ারেস বলেন, দেশের হয়ে শুক্রবারই (শনিবার) হবে আমার শেষ ম্যাচ। আমি ইনজুরির কারণে বা জাতীয় দলে ডাকবে না এই ভয়ে অবসর নিচ্ছি না। অবসর নেওয়ার এই সিদ্ধান্তটি আমাকে স্বস্তি দিচ্ছে এবং ব্যক্তিগতভাবে সহায়তা করছে। এটা কঠিন, তবে শেষ ম্যাচ পর্যন্ত নিজের সবটুকু দিয়েছি আমি। এটাই আমাকে মানসিক শান্তি দিচ্ছে। আমার বয়স এখন ৩৭ এবং আমি জানি পরের বিশ্বকাপ খেলা আমার জন্য খুবই কঠিন। আমি খুবই ভাগ্যবান যে, জীবনে অনেক শিরোপা জিতেছি। তবে কোনো কিছুর বিনিময়েই আমি কোপা আমেরিকার শিরোপাকে হাতছাড়া করতে রাজি নই। আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সেরা মুহূর্ত এটি। আবারও বলছি, কোনো কিছুর সঙ্গে আমি এটা পরিবর্তন করতে রাজি নই।
তিনি বলেন, অবসরের সটিক সময় কোনটি, এটি জেনে বিদায় নেওয়ার চেয়ে গর্বের কিছু আর নেই এবং সৌভাগ্যবশত, আমার বিশ্বাস, জাতীয় দল থেকে এমন সময়ে অবসর নিচ্ছি, যখন আমি জানি যে সরে দাঁড়ানোর সময় হয়েছে। ৩৭ বছর বয়স হয়ে গেছে, পরের বিশ্বকাপ খেলা কঠিন আমার। এটা ভেবে স্বস্তি পাচ্ছি যে, চোটের কারণে বা পারফরম্যান্সের কারণে আমাকে অবসর নিতে হচ্ছে না। ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য এটা শান্তির অনুভূতি যে, নিজে থেকেই সরে দাঁড়াতে প্রস্তুত। সিদ্ধান্তটি অবশ্যই কঠিন। বিদায় বলা কখনোই সহজ নয়। তবে এই মানসিক শান্তি আমার সঙ্গী যে, শেষ ম্যাচ পর্যন্ত নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছি এবং ভেতরের বারুদ আস্তে আস্তে মিইয়ে আসেনি। এজন্যই আমার মনে হয়েছে, এখনই সময়।
২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলম্বিয়ার বিপক্ষে ৩-১ গোলের জয় দিয়ে শুরু হয়েছিল সুয়ারেসের উরুগুয়ে অধ্যায়। প্রায় দেড় যুগের পথচলায় দেশের হয়ে ১৪২ ম্যাচ খেলেছেন তিনি। উরুগুয়ের সর্বোচ্চ ৬৯ গোলের রেকর্ড তার।
অভিষেকের পর জাতীয় দলে নিয়মিত হতে খুব একটা সময় তার লাগেনি। ২০১০ বিশ্বকাপে উরুগুয়ের সেমি-ফাইনালে ওঠায় এই ফরোয়ার্ডের ছিল বড় অবদান। টুর্নামেন্টে তিনটি গোল করেছিলেন তিনি। তবে এর চেয়েও বেশি সাড়া জাগিয়েছিলেন ঘানার বিপক্ষে গোল বাঁচিয়ে। কোয়ার্টার-ফাইনাল ম্যাচের শেষ সময়ে গোল লাইন থেকে হাত দিয়ে বল ফেরান তিনি। লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হয় তাকে। সেই হ্যান্ডবল থেকে পাওয়া পেনাল্টি কাজে লাগাতে পারেনি ঘানা। পরে টাইব্রেকারে জিতে শেষ চারে পা রাখে উরুগুয়ে।
সেই কাণ্ড নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা অনেক হলেও সুয়ারেস নিজে সবসময়ই বলে এসেছেন, দেশের জন্য তিনি সঠিক কাজটিই করেছেন। এখনও তিনি পেছন ফিরে তাকিয়ে বলেন, “সেটি ছিল টুর্নামেন্টের সেরা সেভ।”
গৌরবময় ক্যারিয়ারে সব মিলিয়ে চারটি বিশ্বকাপ ও পাঁচটি কোপা আমেরিকা খেলেছেন সুয়ারেস। ২০১০ বিশ্বকাপের সাফল্যের পথ ধরে ২০১১ কোপা আমেরিকায় চ্যাম্পিয়ন হয় উরুগুয়ে। চার গোল করে ও দুটি গোলে সহায়তা করে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি পান সুয়ারেস।
লিভারপুল, বার্সেলোনা, আতলেতিকো মাদ্রিদের মতো দলের হয়ে ক্লাব ফুটবল মাতানো সুয়ারেসের কাছে ক্যারিয়ারের সেরা অর্জন ২০১১ কোপা আমেরিকা জয়।
“ক্যারিয়ারে অনেক শিরোপা জিততে পেরে আমি সৌভাগ্যবান। তবে কোপা আমেরিকার শিরোপার সঙ্গে দুনিয়ার কিছ্ ুবদল করতে রাজি নই। পেশাদার ফুটবলার হিসেবে আমার ক্যারিয়ারের সুন্দরতম মুহূর্ত ছিল ২০১১ কোপা আমেরিকার ট্রফি জয় করা। অনেক কিছুই জিতেছি, কিন্তু এটা কোনো কিছুর বিনিময়েই বদল করব না।”
উরুগুয়ের হয়ে তার সবশেষ দারুণ স্মৃতিও কোপা আমেরিকায়। এবারের আসরে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে কানাডার বিপক্ষে ৯০ মিনিট শেষে যোগ করা সময়ে গোল করে দলকে সমতায় ফেরান তিনি। পরে টাইব্রেকারেও বল জালে পাঠান। ৪-৩ গোলে জিতে তৃতীয় হয় উরুগুয়ে।
সেই পারফরম্যান্সকে সুয়ারেস বললেন তার সন্তানদের জন্য উপহার।
“আমার স্বপ্ন ছিল, আমার সন্তানেরা যেন জাতীয় দলের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু জিততে দখে আমাকে। ওই শেষ গোলটি আমার সন্তানদের জন্য দারুণ ছিল। যদিও ট্রফি জিততে পারিনি, তবু কিছু একটা পেয়েছে ওরা। মানুষকে আমি দেখাতে চেয়েছিলাম, জাতীয় দলের হয়ে এখনও অবদান রেখে যেতে পারি এবং কোপা আমেরিকায় তা দেখিয়েছি।”
কোপা আমেরিকা দিয়েই বিদায় নেওয়ার ভাবনা তার ছিল। তবে প্যারাগুয়ের বিপক্ষে শুক্রবারের ম্যাচটি খেলার কারণ তিনি জানালেন।
“কোপার পরই ভালোভাবে বিদায় বলতে পারতাম। কিন্তু সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে আমার মনে হয়েছে, আমার দেশের সমর্থকদের সামনে আমার স্টেডিয়ামে বিদায় নিতে পারলেই ভালো। আমি চাই, আমার সন্তানরা যেন মুহূর্তটি হৃদয়ে লালন করতে পারে। নিজের দর্শকদের সামনে বিদায় নেওয়ার সুযোগ সবার আগে না।”
২০১১ সালে জিতেছিলেন কোপা আমেরিকার শিরোপা। সেটাই তার ক্যারিয়ারের শ্রেষ্ঠ অর্জন, ‘আমি অনেক ভাগ্যবান এজন্য যে, ক্যারিয়ারে অনেক শিরোপা জিতেছি। তবে কোপা আমেরিকার শিরোপার সাথে আর কিছুর তুলনা হবে না আমার ক্ষেত্রে। ২০১১ সালে কোপা আমেরিকার শিরোপা জেতার স্মৃতিটা আমার জন্য সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত ছিল।’
২০০৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় দলে অভিষেক হয় সুয়ারেজের। ওই ম্যাচে কলম্বিয়াকে ৩-১ গোলে হারিয়েছিল তারা। এরপর থেকে উরুগুয়ের দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যান সুয়ারেজ। জাতীয় দলের হয়ে তিনি চারটি বিশ্বকাপ ও পাঁচটি কোপা আমেরিকায় খেলেন। সবশেষ ২০২২ বিশ্বকাপ ও ২০২৪ কোপা আমেরিকায়ও খেলেন তিনি। উরুগুয়ের জার্সিতে এখন পর্যন্ত তিনি খেলেছেন ১৪২ ম্যাচ। দেশের হয়ে সর্বাধিক ৬৯টি গোল করেছেন তিনি।
ক্লাব ফুটবলে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন এই তারকা স্ট্রাইকার। স্প্যানিশ লা লিগার ক্লাব বার্সেলোনাতে লিওনেল মেসি ও নেইমার জুনিয়রের সঙ্গে জুটি করে খেলেছেন বহুদিন। তার আগে খেলেছিলেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব লিভারপুলে।