নিজস্ব প্রতিবেদক :
রাজধানীর বঙ্গবাজার মার্কেটের মূল আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও ২৮ ঘণ্টা পর এখনো জ্বলছে আগুন, উঠছে ধোঁয়া। এখনো কোথাও কোথাও জ্বলছে সেই আগুন। উঠছে কালো ধোঁয়া। তা নিভাতে পানি ছিটাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরাও। আর পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া দোকানের অংশ দেখতে সকাল থেকেই আসছেন ব্যবসায়ীরা। আলোচনায় বারবার ঘুরে ফিরে আসছে অগ্নিকাণ্ডের কথা।
সকালে পুড়ে যাওয়া দোকানের কাছে এসে দোকানের মালিকরা দেখছেন তাদের জীবনের শেষ সম্বল কিভাবে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তারা জীবনেও ভাবেনি তাদের এমন একটি ভোর দেখতে হবে। হাজারো ব্যবসায়ী ঈদকে সামনে রেখে নতুন পুঁজি খাটিয়েছিলেন, আগুনে তাদের সর্বস্ব গেছে।
বুধবার (৫ এপ্রিল) রাজধানীর বঙ্গবাজারে পুড়ে যাওয়া মার্কেটে গিয়ে এমন চিত্রই দেখা গেছে।
এছাড়া ধ্বংসস্তূপ দেখতে বঙ্গবাজার এলাকায় সকাল থেকে ভিড় জমাচ্ছে উৎসুক জনতা। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পরিচিত জন। তাদের আলোচনায় অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতার কথা উঠে আসছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বঙ্গবাজারে পুড়ে যাওয়া মার্কেটে আজও কোথাও কোথাও আগুন জ্বলছে। একাধিক স্থানে উঠেছে ধোঁয়া। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা কাজ করছে। জীবনের শেষ সম্বল হারানো হাজারো ব্যবসায়ীরা ঘুরে ঘুরে তা দেখছেন আর স্মৃতিচারণ করছেন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে ব্যবসায়ী মো. ইউসুফ বলেন, আমাদের চারটা দোকান ছিল। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমার আর কিছুই করার নেই। সামনে ঈদ সবাই আমার দিকে তাকিয়ে ছিল একদিনেই সব শেষ হয়ে গেলো।
ব্যবসায়ী মেহেদী বলেন, ১৪ থেকে ১৫ লাখ টাকার গার্মেন্টসের মালামাল ছিল দোকানে। সব পুড়ে গেছে।বঙ্গবাজারে আজও কোথাও কোথাও জ্বলছে আগুনএনাম নামের আরেক ব্যবসায়ী বলেন, দুইটা দোকানে তার প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকার মালামাল ছিল। সব পুড়ে গেছে। নিঃস্ব হয়ে গেছি।
মার্কেটের উল্টোপাশে ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের বারান্দায় বসে কান্নায় ভেঙে পড়েন সোহেল। তিনি বলেন, ঈদের জন্য দোকানে সব নতুন মাল তুলেছিলাম। দোকান-গোডাউন মিলে প্রায় ৪০ লাখ টাকার মাল ছিল। গত সোমবার রাত হয়ে যাওয়ায় মাল কেনার নগদ ৪০ লাখ টাকা ক্যাশে রেখে গেছিলাম। মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আমার বাকি মাল যায় যাক, আমার নগদ টাকাটা বাঁচাতে পারলাম না। আমার সব শেষ হয়ে গেল ভাই।
ইমরান গার্মেন্টসের কর্মী হাবিবুর রহমান বলেন, উপরে শুধু কাপড়ের দোকান। সেখানে কাপড়ের গোডাউন থাকায় অনবরত ধোঁয়া বের হচ্ছিল। এছাড়া অবশিষ্ট মালামালের যেন ক্ষতি কম হয় তাই পানি ছেটাচ্ছে ফায়ার সার্ভিস। আর এর মধ্যেই আমাদের মতো দোকানগুলোর লোকজন মালামাল বের করার চেষ্টা করছে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে ব্যবসায়ী মো. ইউসুফ বলেন, আমাদের চারটা দোকান ছিল। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমার আর কিছুই করার নেই। সামনে ঈদ সবাই আমার দিকে তাকিয়ে ছিল একদিনেই সব শেষ হয়ে গেল।
সব হারিয়ে আহাজারি করছিলেন ‘রাসেল গার্মেন্টস’-এর কর্ণধার মুরাদ হোসেন। দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে গড়ে তোলা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিমিষে ভস্মীভূত হতে দেখে ভেঙে পড়েন তিনিও। মুরাদ বলেন, এটিই আমার উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম ছিল। আমি জানি না এখন পরিবার নিয়ে কী করব। ঋণের টাকা কোথা থেকে পরিশোধ করব। আদতেও দোকানের জায়গাটা আবার বুঝে পাব কিনা তা নিয়েও দুশ্চিন্তায় আছি।
সবুজ মিয়া নামে এক ব্যবসায়ী তার দোকান চিহ্নিত করে ক্যাশ বাক্স বের করে পুড়ে যাওয়া টাকাগুলো দেখছেন আর কাঁদছেন।
তিনি বলেন, এরকম একটা অবস্থা দেখার জন্য কোনদিন প্রস্তুত ছিলাম না। আমার তিনটি দোকানে ঈদ উপলক্ষে প্রায় কোটি টাকার পণ্য তুলেছিলাম। আমি এখন পথের ফকির হয়ে গেছি। কিছু চাপা আগুন রয়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন। আমার দোকানের একটি মালও সরাতে পারিনি। এখন আল্লাহ ছাড়া আমাদের কোন উপায় নেই। বাসা ভাড়া ও পরিবার নিয়ে কি করে বাঁচবো সেই চিন্তায় করছি।
এনেক্সকো টাওয়ারের ৩য় তলায় কাপড়ের দোকানের ম্যানেজার আলমাছ আলী বলেন, মার্কেটটিতে গার্মেন্টস প্রোডাক্ট আর শাড়ির দোকান বেশি। সবই তো পুড়েছে অনেকের, আবার কারও কারও কিছু মাল অবশিষ্ট রয়ে গেছে। তাই সবাই তাদের অবশিষ্ট মালামাল সরিয়ে নিচ্ছে। কর্মীরা এসব মালামাল বস্তায় ঢুকিয়ে নিচে ফেলছে। আর নিচ থেকে সেগুলো সংগ্রহ করে ভ্যান, পিকআপে করে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
মার্কেটটিতে দোলন হাউজের কর্মী তুহিন আহমেদ বলেন, যেহেতু ৪/৫তলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে মালামাল নামানো যাচ্ছে না, তাই উপর থেকেই বস্তায় ভরে সরাসরি রাস্তায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে। উপরে শুধু ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। এরইমধ্যে লোকজন উপরে উঠে নিজেদের পোড়া মালামাল ছাড়া যে পণ্য কিছুটা ভালো আছে মূলত সেগুলোই নামিয়ে নিচ্ছেন।
নিচে অপেক্ষমাণ মার্কেটটির এক দোকানের কর্মী ফয়সাল হাসান বলেন, আমাদের দোকানের কর্মীসহ শ্রমিকদের সমন্বয়ে মালামাল গোছানো হচ্ছে ৫তলায়। উপরে এখনও ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে আছে। এরইমধ্যে অবশিষ্ট মালামাল গুছিয়ে বস্তায় করে নিচে ফেলা হচ্ছে। আর নিচে আমরা অপেক্ষা করছি এগুলো ভ্যানে করে অস্থায়ী এক জায়গায় নিয়ে যাবো। রাস্তার ডিভাইডারের উপরে এমন শত শত বস্তা জমা করেছেন বিভিন্ন দোকান মালিকরা। পরে এগুলো ভ্যান বা পিকআপে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
বঙ্গবাজারে আজও কোথাও কোথাও জ্বলছে আগুন অন্যদিকে, অগ্নিকাণ্ডে কারো প্রাণহানির খবর পাওয়া না গেলেও উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া ফায়ার সার্ভিসের একাধিক সদস্য আহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। মার্কেটের অধিকাংশ দোকানের মালামাল পুড়ে গেছে। ঈদ ঘিরে ব্যবসায়ীরা চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ব্যবসায়ীদের অনেকে জানিয়েছেন, তারা ঈদ সামনে রেখে ঋণ ও ধারদেনা করে দোকানে নতুন মালামাল তুলেছিলেন। আগুন লাগার ঘটনায় তাদের অনেকে নিঃস্ব হয়ে গেছেন।
সেখানে কর্তব্যরত এক পুলিশ সদস্য জানান, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে এখানে জনসাধারণের চলাচল সীমিত করার পাশাপাশি নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের উপ-পরিচালক আক্তারুজ্জামান জানান, আমরা ডাম্পিং ডাউনের কাজ করছি। এখন আর খোলা জায়গায় আগুন নেই। তবে এনেক্সকো টাওয়ারের ৫-৭ তলায় কিছুটা আগুন থাকতে পারে। আমরা সেটি নির্বাপন করছি।
প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) সকাল ৬টা ১০ মিনিটে বঙ্গবাজারে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছায় তারা। পরে প্রায় সাড়ে ৬ ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিটের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এ আগুনে বঙ্গবাজারসহ আশপাশের ৬টি মার্কেটের ৫ হাজার ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান। প্রাথমিকভাবে আগুনের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি।