আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
টানা তিন দিন ধরে একের পর এক ফ্লাইট বাতিল করছে ভারতীয় বিমান পরিষেবা সংস্থা ইন্ডিগো এয়ারলাইন্স। শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) চতুর্থ দিনে এসেও বাতিল হয়েছে ইন্ডিগো’র ১ হাজারেরও বেশি ফ্লাইট। এতে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েছেন লক্ষাধিক যাত্রী।
শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) এক বিবৃতিতে বিষয়টি স্বীকার করেছেন ইন্ডিগো’র প্রধান নির্বাহী (সিইও) পিটার এলবার্স। তিনি বলেছেন যে, শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) ১ হাজারেরও বেশি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে, যা তাদের দৈনিক ফ্লাইটের অর্ধেকেরও বেশি। এ প্রেক্ষিতে আজকেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
পাইলটদের বাধ্যতামূলক ৪৮ ঘণ্টা সাপ্তাহিক ছুটি প্রদানসহ সরকারের তরফ থেকে জারি করা একাধিক নিয়মের সাথে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হওয়ায় আজ নিয়ে টানা ৪ দিন পাইলট সংকটের সম্মুখীন হয়েছে ইন্ডিগো।
সিইও পিটার এলবার্স ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, ইন্ডিগোর পুরো অপারেশনাল সিস্টেম পুনরায় চালু করার কারণেই এই বিশাল বিপর্যয় ঘটেছে। উল্লেখ্য, ভারতের বিমান পরিষেবা খাতের ৬০ শতাংশ বর্তমানে ইন্ডিগোর দখলে আছে। প্রতিদিন ২ হাজারেরও বেশি ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে সংস্থাটি।
সমস্যা সমাধানে সরকারের তরফ থেকে ইতোমধ্যেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকার আশ্বস্ত করেছে যে, শনিবারের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে এবং সোমবারের মধ্যে বিমান পরিষেবা সম্পূর্ণভাবে পুনরুদ্ধার হবে। তবে সিইও এলবার্স বলেছেন অন্য কথা।
ভিডিও বার্তায় এলবার্স জানিয়েছেন যে, সম্পূর্ণ পরিষেবা (অপারেশন) পুনরুদ্ধার হতে পাঁচ থেকে দশ দিন সময় লেগে যাবে। ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে পরিষেবা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসবে। যাত্রীদেরকে ফ্লাইট আপডেটগুলো অনুসরণ করার কথাও জানিয়েছেন তিনি।
বড় ধরনের এই সংকটের কারণে সৃষ্ট অসুবিধার জন্য যাত্রীদের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমাও চেয়েছেন পিটার এলবার্স। পাশাপাশি তিনি অনুরোধ করেছেন, অতিরিক্ত ঝামেলা এড়াতে বাতিল হওয়া ফ্লাইটের জন্য যাত্রীরা যেন বিমানবন্দরে ভিড় না করেন।
পাইলটদের বেশি বিশ্রাম এবং রাতের ডিউটিতে বিধিনিষেধ আরোপ করার মতো নতুন নিয়মগুলোর প্রতিপালনে সরকারের কাছে সাময়িক ছাড় চেয়েছে ইন্ডিগো।
বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) বাতিল করেছিল ৫৫০টি ফ্লাইট। পূর্ব নোটিশ ছাড়া ফ্লাইট বাতিল করায় বিপাকে পড়েছেন যাত্রীরা।
যাত্রীদের এই ভোগান্তি অবশ্য চলছে বেশ কয়েক দিন ধরেই। বৃহস্পতিবার দিনভর এবং শুক্রবার সকালে দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে সার্বিক অব্যবস্থাই লক্ষ্য করা গেছে। ইন্ডিগোর যাত্রীদের অভিযোগ, খাবার এবং আশ্রয় ছাড়াই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছেন তারা। কিন্তু ঠিক কোন সময়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যের ফ্লাইট ছাড়বে, তা বিমানসংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে না। অন্য দিকে, এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অন্য বিমানসংস্থাগুলি বিমানের টিকিটের দাম হু হু করে করে বাড়িয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ যাত্রীদের।
কী কারণে এই ইন্ডিগো বিভ্রাট
ইন্ডিগোর বিমান পরিষেবা ব্যাহত হওয়ার নেপথ্যে ভারতের বেসামরিক ফ্লাইট নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিজিসিএ’র একটি বিধিকে দায়ী করা হচ্ছে। বিমান পরিষেবায় নিরাপত্তা আরও মজবুত করতে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে পাইলট এবং বিমানকর্মীদের কাজের সময় এবং বিধি নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল ডিজিসিএ। ‘ফ্লাইট ডিউটি টাইম লিমিটেশনস’ নামের ওই বিধিতে বলা হয়েছিল, প্রতি সপ্তাহে পাইলট এবং বিমানকর্মীদের বিশ্রামের জন্য ৪৮ ঘণ্টা সময় দিতে হবে এবং প্রতি সপ্তাহে মাত্র ২টি বিমান রাতে অবতরণ করাতে পারবেন এক জন পাইলট (আগে এবং সংখ্যা ছিল ৬)। বিধিতে আরও বলা হয়েছে, পাইলট এবং বিমানকর্মীদের পর পর দু’দিন নাইট ডিউটি দেওয়া যাবে সপ্তাহে এক বারই।
২০২৪ সালের জুনে এই বিধি কার্যকর করার কথা ছিল। কিন্তু বিমানসংস্থাগুলোর অনুরোধে তা বার বার পিছিয়ে যায়। সম্প্রতি নতুন বিধি কার্যকর করার জন্য ডিজিসিএ-কে নির্দেশ দেয় দিল্লি হাই কোর্ট। হাইকোর্টের নির্দেশের পর জুন এবং নভেম্বরে দুই দফায় ধাপে ধাপে নির্দেশিকায় থাকা নিয়মাবলী কার্যকর করার পথে হাঁটে ডিজিসিএ।
কেন বেশি সমস্যায় ইন্ডিগো
অন্যান্য বিমান পরিষেবা সংস্থার তুলনায় ইন্ডিগো সস্তায় বিমান পরিষেবা দিয়ে থাকে যাত্রীদের। পরিষেবা প্রদানের বিচারে ভারতের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে সমৃদ্ধ পরিষেবা সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়ার তুলনায় অনেক এগিয়ে রয়েছে ইন্ডিগো। দেশের ৯০টি এবং বিদেশের ৪৫টি বিমানবন্দরে পরিষেবা দিয়ে থাকে তারা।
ইন্ডিগোর অনেক বিমানই রাতে অবতরণ করে। তাই নতুন বিধিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে এই বিমানসংস্থাই। এ বিধি মেনে পরিষেবা স্বাভাবিক রাখতে যত সংখ্যক কর্মী এবং পাইলট প্রয়োজন, বর্তমানে তা ইন্ডিগোর নেই। পাইলট এবং কর্মী অপ্রতুলতার কথা স্বীকার করে ইতিমধ্যেই যাত্রীদের কাছে একাধিক বার ক্ষমাও চেয়েছে ইন্ডিগো।
কী অভিযোগ পাইলট সংগঠনগুলোর
ভারতের পাইলটদের সংগঠন ‘ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান পাইলটস’-এর অভিযোগ, ডিজিসিএ নতুন নিয়মাবলি নিয়ে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর প্রায় দু’বছর কেটে গিয়েছে। অন্য বিমানসংস্থাগুলো সেই অনুযায়ী প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছিল। কিন্তু ইন্ডিগো দীর্ঘ সময় ধরে নতুন পাইলট এবং বিমানকর্মী নিয়োগ করেনি।
ফেডারেশন অব পাইটলটসের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, নতুন বিধি কার্যকর হবে—তা জেনেও দীর্ঘমেয়াদি কোনও পরিকল্পনা নেয়নি ইন্ডিগো। বরং দীর্ঘ দিন ধরে নিয়োগপ্রক্রিয়া বন্ধ রেখেছে।
পাইলটদের আর এক সংগঠন ‘দ্য এয়ারলাইন্স পাইলটস অ্যাসোসিয়েশন’-এর অভিযোগ—বিধি শিথিল করতে কেন্দ্রকে বাধ্য করার কৌশল নিয়েছিল ইন্ডিগো। সেই কারণেই বিমান পরিষেবা ব্যাহত হলেও ইন্ডিগো কোনও কার্যকর পদক্ষেপ করেনি বলে দাবি ওই সংগঠনের।
তদন্তের নির্দেশ কেন্দ্রীয় সরকারের
বৃহস্পতিবার রাতে সমাজমাধ্যমে একটি পোস্ট করে পরিষেবার উপর ‘নেতিবাচক প্রভাব’ পড়ার জন্য প্রযুক্তিগত ত্রুটি, শীতকালীন সময়সূচি পরিবর্তন, প্রতিকূল আবহাওয়া, বিমান ব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান যানজট এবং বিমানকর্মীদের কাজের সংশোধিত সময়সূচিকে দায়ী করেছে ইন্ডিগো। তবে কী কারণে এই বিভ্রাট, তা খতিয়ে দেখতে শুক্রবার উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়।
আন্তর্জাতিক ডেস্ক 






















