আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
বাংলাদেশে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা শিক্ষার্থীরা যেদিন নতুন একটি রাজনৈতিক দল গড়ে মাঠে নামলেন, সেদিন হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেছিলেন তাঁদের পরিকল্পনার কথা শুনতে। সেই সমাবেশ হয়েছিল চলতি বছরের শুরুতে। কিন্তু এখন রাজপথের শক্তিকে ভোটে রূপান্তর করার জন্য দলটিকে লড়তে হচ্ছে।
ছাত্র নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারা দশকের পর দশক ধরে চলা স্বজনপ্রীতি এবং দুই দলের আধিপত্য থেকে দেশকে মুক্ত করবে। তবে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে দলটি।
এনসিপিপ্রধান নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সংগঠন দুর্বল; কারণ, আমরা এটিকে গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট সময় পাইনি। আমরা এটা জানি। তবে এখনো চ্যালেঞ্জ নিচ্ছি।’
গত বছর সরকারবিরোধী আন্দোলনে নাহিদ ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি স্বল্প মেয়াদে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
ঢাকার একটি বহুতল ভবনে দলীয় কার্যালয় থেকে রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলেন ২৭ বছর বয়সী নাহিদ। ঘরটির একদিকের দেয়ালে আঁকা রয়েছে গণ-অভ্যুত্থানের শামিল জনতার ছবি।
জরিপে দলটির অবস্থান তৃতীয়
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০টি আসনের সব কটিতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায় এনসিপি। চলতি ডিসেম্বরে একটি জনমত জরিপের ফল প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই)। জরিপটি বলছে, সমর্থনের দিক থেকে এনসিপি তৃতীয় অবস্থানে আছে। দলটিকে সমর্থন করছে মাত্র ৬ শতাংশ মানুষ, যা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ৩০ শতাংশ জনসমর্থনের অনেকটাই পেছনে।
এ জরিপ অনুযায়ী, কট্টরপন্থী দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলমীও এনসিপির চেয়ে এগিয়ে আছে। জনসমর্থনের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে (২৬ শতাংশ) আছে দলটি।
গত বছর ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সক্রিয় প্রাপ্তি তাপসী রয়টার্সকে বলেন, ‘তারা যখন যাত্রা শুরু করে, তখন অন্যদের মতো করে আমিও তাদের মধ্যে আশা দেখেছিলাম।’
২৫ বছর বয়সী প্রাপ্তি আশা করেছিলেন নতুনেরা দুই প্রধান দলের বহু বছরের শাসন ভেঙে দেবে। তবে পরে তিনি হতাশ হন।
প্রাপ্তি বলেন, ‘তারা বলে যে তারা মধ্যপন্থী, কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তা মেলে না।’
নারীবাদী এই অধিকারকর্মী আরও বলেন, সংখ্যালঘুদের অধিকারই হোক বা নারীর অধিকারের প্রশ্ন হোক, তারা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধায় ভোগে। আর যখন তারা অবস্থান নেয়, তখন অনেক দেরি হয়ে যায়।’
এনসিপিকে নিয়ে মানুষের হতাশা বাড়ার আরেকটি নমুনা হচ্ছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন (ডাকসু)। ওই নির্বাচনে এনসিপি একটি পদেও জিততে পারেনি। এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিল ২৪-এর অভুত্থানের কেন্দ্রবিন্দু।
রাজনৈতিক জোট গঠনের আলোচনা
নেতা সীমিত সাংগঠনিক কাঠামো, তহবিলের স্বল্পতা এবং নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকারসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে অনিশ্চিত হিসেবে চিহ্নিত অবস্থানের মতো বাধার কথা বলছেন। তাঁঞরা বলছেন, এনসিপি এখন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য দলের সঙ্গে আলোচনা করছে।
এনসিপির এক জ্যেষ্ঠ নেতা ঝুঁকিগুলো আমলে নিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সকে বলেন, ‘আমরা যদি স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করি, তাহলে হয়তো একটি আসনও জিততে পারব না।’
এদিকে বিশ্লেষকেরা বলছেন, জোট গঠন করলে দলটির ‘বিপ্লবী’ ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার ঝুঁকি থাকবে।
লেখক ও রাজনীতি-বিশ্লেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, ‘যদি তারা জোট করে, তখন জনগণ আর তাদের আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে বিবেচনা করবে না।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এবং একজন এনসিটি নেতা আরেকটি কথাও বললেন। শিক্ষার্থীরা হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য স্বল্প সময়ের জন্য দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হলেও তাদের বেশির ভাগই পরে নিজ নিজ দলে ফিরে যায়। এনসিপি গঠনের জন্য হাতে থাকে মাত্র কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী ।
এখন এনসিপিকে এমন সব প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হতে হচ্ছে, যাদের প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত শক্তিশালী নেটওয়ার্ক এবং সুসংগঠিত কাঠামো রয়েছে।
নাহিদ ইসলাম বলেন, অর্থের বিষয়টিও একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে আছে। কারণ, দলের সদস্যরা মূলত পূর্ণকালীন চাকরির বেতন, ছোট ছোট অনুদান ও ক্রাউডফান্ডিংয়ের ওপর নির্ভর করে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কেউ কেউ গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে গিয়ে সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তেমনই একজন ২৮ বছর বয়সী হাসনাত আবদুল্লাহ।
রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকার মানুষকে বলি যে আমার টাকাপয়সা নেই। আমি তাঁদের বলেছি, একজন নেতার মূল কাজ ভোটারকে অর্থ দেওয়া নয়, বরং সরকারি তহবিলের সঠিক বণ্টন ও ব্যবহার নিশ্চিত করা’
তবে কিছু এনসিপি নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় দলের ভাবমূর্তির ওপর প্রভাব পড়ছে। যদিও দলটি নেতাদের দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেছে। দলটির দাবি, তারা দুর্নীতির বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে।
‘নতুন কিছু দেওয়া’
তবু কিছু তরুণ এখনো এনসিপিকে সমর্থন করছেন। কারণ, তাঁরা আশা করছেন, দলটি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অর্থ, শক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক ক্ষমতার সংস্কৃতিতে বদল নিয়ে আসবে এবং সমতা প্রতিষ্ঠা করবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মনজিলা রহমান বলেন, ‘তারা তরুণ, তারা বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছিল। আমি আশা করি, তারা পরিবর্তন আনতে পারবে—যদি তারা নিজেরাই স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে না ওঠে।’
এনসিপি গত নভেম্বর মাসে অভিনবভাবে প্রার্থী খোঁজার অভিযান চালায়। দুই দিনের মধ্যে তারা দেশের সাধারণ নাগরিকদের মধ্য থেকে ১ হাজারের বেশি মনোনয়নপ্রত্যাশীর সাক্ষাৎকার নেয়। তরুণ দলীয় নেতারা ঘুরে ঘুরে সম্ভাবনাময় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এর মধ্যে এক রিকশাচালক আছেন, বিক্ষোভের সময় পুলিশের ছোড়া ছররা গুলিতে আংশিক দৃষ্টিশক্তি হারানো ২৩ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থীও আছেন।
৩২ বছর বয়সী রিকশাচালক মোহাম্মদ সুজন খান বলেন, ‘কেউ হয়তো ভাবতে পারেন যে রিকশাচালকের তো সংসদে কিছু দেওয়ার নেই। আমাকে একবার সুযোগ দিন, দেখুন আমি দেশে পরিবর্তন আনতে কী করি।’
এ ধরনের একটি ভবিষ্যতের সম্ভাবনা চিকিৎসক তাসনিম জারাকে দলটির প্রতি আকৃষ্ট করেছে। তিনি কেমব্রিজে সফল ক্যারিয়ার ছেড়ে এনসিপিতে যোগ দিয়েছেন। তিনি দলকে মূল থেকে গড়ে তুলতে চান।
তাসনিম জারা বলেন, ‘আমরা রাজনীতিকে উন্মুক্ত করতে চাই, শক্তিশালী পরিবারগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না। ক্ষমতাকে সাধারণ মানুষের হাতে ফিরিয়ে দিতে চাই।’
বিএনপি ও জামায়াত নেতারাও এ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন।
বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘তরুণেরাই ভবিষ্যতে রাজনীতিতে আধিপত্য করবে, তাই আমরা যদি তাদের সংসদে জায়গা করে দিতে পারি তবে তা ভালো হবে।’
এনসিপি নেতারা বলছেন, তাঁরা আসন্ন ভোট ছাড়াও দীর্ঘ মেয়াদে প্রতিষ্ঠানগত ও কাঠামোগত সংস্কার নিয়ে ভাবছেন।
এনসিপির হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘হার-জিত যা–ই হোক, শুধু নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই আমরা নতুন কিছু দিচ্ছি।’
আন্তর্জাতিক ডেস্ক 





















