সিরাজগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি :
জামতৈল রেলওয়ে স্টেশন, যেটি ব্রিটিশ আমলে চালু হয়। শত বছরেরও বেশি পুরোনো এবং সিরাজগঞ্জের প্রাচীনতম রেলস্টেশনগুলোর মধ্যে অন্যতম এই স্টেশনটি সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলায় অবস্থিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই স্টেশনটিতে উন্নয়ন হওয়ার বদলে যেন আরও হয়েছে অবনতি। রাত বাড়লেই স্টেশনটি যেন ছিনতাইকারীদের দখলে চলে যায়। প্রতিকার না পাওয়ায় আর অভিযোগও দেন না ভুক্তভোগী যাত্রীরা।
লোক দেখানো সিসি ক্যামেরা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবণতি, নিয়মিত ছিনতাইসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত এই স্টেশনটিতে ক্রসিংয়ের সময় আসলেই আতঙ্কিত থাকে সাধারণ মানুষজন। প্রতি রাতেই ছোট কিংবা বড় ধরনের ছিনতাই ক্রমাগত হয়ে চলেছে।
রাত হলেই চলন্ত ট্রেনের দরজা, প্ল্যাটফর্মের দুই প্রান্ত এবং অন্ধকার গলি সব জায়গাতেই সক্রিয় হয়ে ওঠে একটি সংঘবদ্ধ দল। যাত্রীরা আতঙ্কে স্টেশনে উঠানামা করলেও কার্যকর নিরাপত্তা ব্যবস্থার অনুপস্থিত। মানহীন সিসি ক্যামেরা ও কম আলো মিলিয়ে অনেকটাই ‘ঝুঁকিপূর্ণ জোন’ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই স্টেশন। ফুট ওভারব্রিজ থাকলেও ব্যবহার করে না মানুষজন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেস ও ঢাকা থেকে পঞ্চগড়গামী দ্রুতযান আন্তনগর এক্সপ্রেস ট্রেনে এসব ঘটনার হার সবচেয়ে বেশি। রাত সাড়ে ১০টার পর স্টেশনে যে ট্রেনগুলোর ক্রসিং হয়, সেগুলোতেও ছিনতাই হচ্ছে প্রায় নিয়মিতভাবেই। ক্রসিং এর সময়কেই বেছে নিয়ে থাকে ছিনতাইকারীরা।
এই চক্রটির সদস্য সংখ্যা ৭-৮ জন। এরা সবাই তরুণ যুবক, যাদের বয়স ২৮ বছরের মধ্যেই। এই দলটি প্রায় ১০ মাস ধরেই যাত্রীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মূল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নেয় বলে জানা গেছে। যাত্রীরা মোবাইলে কথা বললে বা জানালার পাশে দাঁড়ালে মুহূর্তেই হাত বাড়িয়ে জিনিস টেনে নেওয়া হয়। স্টেশনে ১৮টি সিসি ক্যামেরা থাকলেও মানহীন ক্যামেরা হওয়ায় পরিচয় শনাক্ত করা যায় না বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ে স্টেশনের এক দোকানি বলেন, সিসি ক্যামেরায় চেহারা না বোঝার সুযোগ কাজে লাগিয়ে ক্রসিংয়ের সময় ছিনতাই হয়ে থাকে। আবার পর্যাপ্ত লাইট না থাকায় ছিনতাই করার পরেই ছিনতাইকারীরা অন্ধকারে মিশে যায়।
জিআরপি থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, প্ল্যাটফর্মের বাইরে পৃথকভাবে এসব ঘটে, আর আগের তুলনায় ছিনতাই কমেছে। চলতি বছরে জড়িত ১৬ জনকে গ্রেপ্তারের কথাও জানিয়েছে পুলিশ। সিরাজগঞ্জ বাজার স্টেশন রেলওয়ে থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দুলাল উদ্দিন বলেন, আমি আসার পর স্টেশনটিতে ছিনতাই কমেছে। আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
জামতৈল রেলওয়ে স্টেশনের দক্ষিণ পাশের কামারের গলির দোকানসংলগ্ন এলাকা এবং উত্তর পাশের কমিউনিস্ট পার্টি অফিসসং লগ্ন অন্ধকার গলি ছিনতাইকারীদের মূল আশ্রয়স্থল। দ্বিতীয় লাইন আলোকবিহীন থাকায় সেখানেও ঝুঁকি বাড়ছে।
সার্বিক বিষয়ে জামতৈল রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার (ইনচার্জ) আবু হান্নান বলেন, প্রায় রাতে ট্রেন ছাড়ার সময় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। তবে যাত্রীরা রানিং হওয়ায় কেউ মৌখিক বা লিখিত অভিযোগ দেয় না। ক্যামেরার মান খুব খারাপ, তাই ছিনতাইকারীদের চেহারা বোঝা যায় না। বিষয়টি জিআরপি ও কামারখন্দ থানা পুলিশকে জানিয়েছি।
রুহুল নামের এক যাত্রী বলেন, ট্রেনে ওঠার সময় মোবাইল হাতে থাকলে মনে হয় আরেক মিনিটেই হয়তো ছিনতাই হয়ে যাবে। এ স্টেশনে রাতের বেলায় ভয় লাগে। এমনকি আগস্ট মাসে তাজুরপাড়া ব্রিজ এলাকায় সিগন্যাল লাইটে খড়কুটা বা বস্তা ঢুকিয়ে লাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল ট্রেন থামিয়ে ছিনতাই করা। চালক বিষয়টি বুঝে ট্রেন থামাননি।
জামতৈল রেলওয়ে স্টেশনে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়া এবং সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনের করণীয় রয়েছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে কামারখন্দ উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিপাশা হোসাইন সুযোগ নেই বলেই জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (পশ্চিম) ফরিদ আহমেদ বলেন, আইনশৃঙ্খলার বিষয়টি জিআরপি থানা দেখবে। অচল সিসি ক্যামেরার সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত এই রেলওয়ে স্টেশনটিতে আজও কেন পুলিশ ফাঁড়ি নেই? এমন প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, এই বিষয়টি পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে দেখা হয়। আর পাকশী থেকে জামতৈলের দূরত্ব অনেক, তাই দেখাও সম্ভব না। তবে উল্লাপাড়া রেলওয়ে স্টেশনে পুলিশ ফাঁড়ি দেওয়ায় প্রস্তাবনা এসেছে। আগামী দুই মাসের মধ্যেই কার্যক্রম শুরু হবে। তখন সমস্যাগুলোর সমাধান হবে।
সিরাজগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি 




















