Dhaka বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ১৫ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের নেই : মির্জা ফখরুল

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশের সময় : ০২:০২:৫৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫
  • ১৯৩ জন দেখেছেন

নিজস্ব প্রতিবেদক : 

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। ঐক্যমত কমিশনের প্রস্তাব জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।

মির্জা ফখরুল অভিযোগ করেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত, ভিন্নমত ও নোট অব ডিসেন্ট উল্লেখ করা হয়নি। যা দীর্ঘ এক বছরের ধারাবাহিক আলোচনাকে অর্থহীন করার পাশাপাশি প্রহসনমূলক এবং জাতির সঙ্গে প্রতারণার শামিল।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ঐকমত্য হওয়া কয়েকটি দফায় অগোচরে পরিবর্তন এনেছে ঐকমত্য কমিশন। কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকার আমলে নেয়নি। এ সময় জাতীয় নির্বাচনের দিন ছাড়া গণভোটের সিদ্ধান্ত বিএনপি কোনোভাবেই মেনে নেবে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন।

মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন- ১। দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এক নতুন গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার সূচনা হয়। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর গণতান্ত্রিক সংস্কারের জাতীয় প্রত্যাশা এবং শহীদদের আকাঙ্ক্ষা পূরণের এক ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, বিএনপি গণঅভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর পূর্বেই ২০২৩ সালে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর গণতান্ত্রিক সংস্কারের লক্ষ্যে জাতির সামনে ৩১ দফা উপস্থাপন করে। এর পূর্বে ২০২২ সালে ২৭ দফা এবং ২০১৭ সালে ভিশন-২০৩০ প্রকাশ করে। অতএব, বিএনপি এবং ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট সকল রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, ব্যক্তি ও শক্তিসমূহ জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী সার্বিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার ব্যক্ত করে আসছে। সুতরাং, রাষ্ট্র কাঠামোর প্রকৃত গনতান্ত্রিক সংস্কার বিএনপির অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক এজেন্ডা।

২। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তীতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক ঘোষিত ও গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। সংস্কার কমিশনগুলোর কাছে আমরা সংবিধান, বিচারবিভাগ, নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার, প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশ প্রশাসন সংক্রান্ত বিষয়ে আমাদের দলের পক্ষ থেকে বিস্তারিত মতামত প্রদান করেছি। অন্যান্য রাজনৈতিক দলসমূহও তাদের মতামত প্রদান করেছে। পরবর্তীতে উক্ত ছয়টি সংস্কার কমিশনের সঙ্গে আমাদের এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের দীর্ঘ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত ছয়টি সংস্কার কমিশন কর্তৃক প্রণীত সংস্কার প্রস্তাবগুলোর ওপরই দফাভিত্তিক আলাপ-আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সমস্ত আলাপ-আলোচনার ফলস্বরূপ প্রণীত রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়, যার সভাপতি প্রধান উপদেষ্টা।

৩। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলসমূহের প্রথম বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, যে সমস্ত বিষয়ে রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে, সেই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে একটি জাতীয় সনদ প্রণীত ও স্বাক্ষরিত হবে। পরবর্তীতে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সেই সনদের বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করবে। তিনি জাতির উদ্দেশে দেওয়া বিভিন্ন ভাষণেও তার এই বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে পুনঃব্যক্ত করেছেন। জুলাই ঘোষণাপত্রেও এই বক্তব্য উধৃত হয়েছে।

৪। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ ধারাবাহিক আলোচনায় কিছু কিছু বিষয়ে কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের ভিন্নমত/নোট অব ডিসেন্ট সহকারে ঐকমত্য হয়েছে। জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ যে ভাবে প্রণীত হয়েছে তাতে নোট অব ডিসেন্ট এর অংশে এই বক্তব্য স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, ভিন্নমত/নোট অব ডিসেন্ট প্রদানকারী কোন রাজনৈতিক দল বা জোট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখপূর্বক যদি জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করে, তাহলে তারা সেমতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। এখানে উল্লেখ্য যে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সকল অনুষ্ঠান বিটিভিসহ অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সম্প্রচারিত হয়েছে, যা সমস্ত জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। অতঃপর গত ১৭ই অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় এক ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমরা কেবল মাত্র আলোচনার মাধ্যমে প্রণীত সনদ এর অঙ্গিকারনামায় সাক্ষর করেছি। কিন্ত উক্ত দিনে জুলাই জাতীয় সনদ এর চূড়ান্ত কপি আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়নি। ৫। পরবর্তীতে প্রিন্টেড পুস্তক হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদের কপি আমরা হাতে পাওয়ার পর আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে যে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে সম্মত কয়েকটি দফা আমাদের অগোচরে পুনরায় সংশোধন করা হয়েছে ।

যেমনঃ ক। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বিভিন্ন সরকারি/বেসরকারি অফিসে টাঙ্গানো সংক্রান্ত বিধান [অনুচ্ছেদ ৪ (ক)] বিলুপ্ত করার বিষয়টি সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। যদিও প্রায় সকল রাজনৈতিক দল সম্মতি পত্র দিয়েছে।

খ। সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদ (পঞ্চম , ষষ্ঠ , সপ্তম তফসিল) পুরোপুরি বিলুপ্ত করার বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবের বিষয়ে প্রায় সকল রাজনৈতিক দল সম্মতি প্রকাশ করলেও অগোচরে সেটা চূড়ান্ত সনদে সংশোধনী আনা হয়েছে।

৬। জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এর বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ ২৮ অক্টোবর সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রেরিত চিঠিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি হিসেবে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টাও একজন দস্তখাতকারি বটে। ঐকমত্য কমিশন এবং সরকার একই অংগ হিসেবে প্রতিয়মান হয়। উক্ত পত্রে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এ সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে দুইটি বিকল্প পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের এবং আইনগত ভিত্তি প্রদানের জন্য সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছে।

৭। চিঠিতে বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিষয়গুলো কার্যকর করার উদ্দেশ্যে সরকার “জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫” শিরোনামে একটি আদেশ জারী করবে। এরুপ প্রস্তাবিত আদেশের একটি খসড়া সংযুক্তি-২ এবং সংযুক্তি-৩ এ সংযোজিত করা হয়েছে।

৮। সরকারের এরকম আদেশ জারী করার এখতিয়ার নাই। সংবিধানের ১৫২ নং অনুচ্ছেদের সংজ্ঞা অনুসারে “আদেশ” আইনের মর্যাদাপ্রাপ্ত, অতএব সেটি জারি করা রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার।

৯। বিকল্প প্রস্তাব ১ এ সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি পুর্নাংগ খসড়া বিল গণভোটে উপস্থাপন করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিলের তফসিল-১ এ সংস্কার প্রস্তাবসমূহ সন্নিবেশিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে বিল সরকারি গেজেটে প্রকাশ করা হবে।

১০। বিলে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সংবিধান সংশ্লিষ্ট তফসীল-১ এ বর্ণীত ৪৮ টি দফার (জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত দফাগুলি) উপরে গণভোট হবে।

১১। উক্ত দফাসমুহের বিপরীতে স্বাক্ষরিত জুলাই জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত রাজনৈতিক দলসমুহের মতামত, ভিন্নমত, নোট অব ডিসেন্ট উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব এবং সুপারিশ একপেশে ও জবরদস্তিমুলকভাবে জাতির উপরে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তা’হলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, দীর্ঘ প্রায় ১ বছরব্যাপী সংস্কার কমিশন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলসমুহের দীর্ঘ ধারাবাহিক আলোচনা ছিল অর্থহীন, অর্থও সময়ের অপচয়, প্রহসনমূলক এবং জাতির সাথে প্রতারণা।

১২। গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমত থাকবে এটাই স্বাভাবিক এবং সে কারণে সংলাপের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন ভিন্নমত পোষণে রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকারকে আমলেই নেয়নি।

১৩। উক্ত বাস্তবায়ন আদেশে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার পাশাপাশি একই সঙ্গে একটি “সংবিধান সংস্কার পরিষদ” গঠিত হবে। এবং তারা আলাদাভাবে সংসদ সদস্য এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদ সদস্য হিসেবে শপথ নিবেন। অর্থাৎ নির্বাচিত জাতীয় সংসদটি একই সঙ্গে “সংবিধান সংস্কার পরিষদ” হিসেবে অভিহিত হবে। প্রশ্ন হল, নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে জাতীয় সংসদ এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত; সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের লক্ষ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের বিষয়টি এজেন্ডাভুক্ত ছিলনা, আলোচনার জন্য উপস্থাপিত হয়নি, সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের বিষয়ে কোন ঐকমত্য হওয়ার অবকাশও ছিল না। উল্লেখ্য এ জাতীয় কোন সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন করতে হলে তাও পরবর্তী জাতীয় সংসদে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বলা হয়েছে উক্ত বাস্তবায়ন আদেশ অনুসারে অনুষ্ঠিত গণভোটে যদি ইতিবাচক সম্মতি পাওয়া যায় তাহলে সংবিধান সংস্কার বিলটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ তার দায়িত্ব পালনে সহায়ক হিসেবে বিবেচনা করবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠান হওয়ার পূর্বেই এই ধরণের ঢ়ৎব-বসঢ়ঃরাব পদক্ষেপ আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।

১৪। বলা হয়েছে, সংবিধান সংস্কার পরিষদ প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ হতে ২৭০ পঞ্জিকা দিবসের মধ্যে যদি সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয় তাহলে গণভোটে অনুমোদিত সংবিধান সংস্কার বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও হাস্যকর। জাতীয় সংসদে অনুমোদনের পর যে কোন বিল রাষ্ট্রপতির অনুমোদনপ্রাপ্তির পরই কেবল আইনে পরিণত হয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কোন সুযোগ নেই এবং তা গণতান্ত্রিক রীতি ও সংসদীয় সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী।

১৫। বিকল্প-২ প্রস্তাবে জুলাই সনদ আদেশের বিষয়টি বিল আকারে না দিয়ে সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত প্রস্তাবসমূহ সরাসরি গণভোটে উপস্থাপন করা হবে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রেও ঐকমত্য কমিশনের আলোচনাকালে বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিকদলসমুহ কর্তৃক প্রদত্ত মতামত, ভিন্নমত ও নোট অব ডিসেন্ট গণভোটে উপস্থাপনের সুযোগ রাখা হয়নি।

১৬। চিঠিতে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে অথবা নির্বাচনের দিন উক্ত আদেশ অনুযায়ী গণভোট নির্বাচন করা যেতে পারে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বিএনপি জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে জুলাই সনদের আইনী ভিত্তি রচনা এবং জনগনের সম্মতি গ্রহনের জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোটের প্রস্তাব করেছিল। ১৭। ২০২৬ সনের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। সেক্ষেত্রে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে প্রস্তাবিত গণভোট অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। সময় স্বল্পতা ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিপুল অঙ্কের ব্যয় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ ব্যাপক লোকবল নিয়োগ এবং একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মত বিশাল আয়োজনের বিবেচনায় নির্বাচনের পূর্বে গণভোট অনুষ্ঠান অপ্রয়োজনীয়, অযৌক্তিক এবং অবিবেচনাপ্রসূত। একই আয়োজনে এবং একই ব্যয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট অনুষ্ঠান করা বাঞ্ছনীয়।

১৮। জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এ উল্লেখিত যে সকল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আইন, বিধিবিধান পরিবর্তন বা সংশোধন করা দরকার, সরকার তা অধ্যাদেশ জারী ও বিধিবিধান/সংশোধন করে বাস্তবায়ন করতে পারে (সংযুক্তি-৪) এবং যে সকল সিদ্ধান্ত নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়নযোগ্য সে গুলো অবিলম্বে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন করতে পারে (সংযুক্তি-৫)। এই প্রস্তাবের সাথে আমরা এবং প্রায় সকল রাজনৈতিক দল ঐকমত্য পোষণ করেছি। এছাড়া জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন এর আইনী ভিত্তি দেয়ার জন্য আমরা গণভোটে সম্মত হয়েছি। যে সকল বিষয়ে ভিন্নমত / নোট অব ডিসেন্টসহ ঐকমত্য হয়েছে তার উল্লেখ না রেখে এবং দীর্ঘ আলোচনায় যে সব প্রসঙ্গ আলোচনায় আসেনি তা অন্তর্ভূক্ত করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অন্য সকল সুপারিশ অগ্রহণযোগ্য বিধায় আমারা একমত হতে পারছিনা। আমরা অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি যে, এই সকল সুপারিশ কেবল জাতিকে বিভক্ত করবে, ঐক্যের বদলে অনৈক্য সৃষ্টি করবে। মনগড়া যেকোনো সংস্কার প্রস্তাব গ্রহন করলে জাতীয় জীবনে দীর্ঘ মেয়াদে অকল্যাণ ডেকে নিয়ে আসতে পারে।

১৯। আমরা আশা করি, জাতির প্রত্যাশা পূরণে এবং দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও ২০২৪ সালের ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের সকল শহীদের রক্তের অঙ্গীকার অনুযায়ী এবং যারা দীর্ঘ এই সংগ্রামে ফ্যাসিবাদী শাসনামলে গুম, খুন, অপহরণ, নির্যাতন, মামলা, হামলার শিকার হয়েছেন—তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুনর্গঠন করতে পারব। প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। সেই লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখা আমাদের সকলের কাম্য এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতির অভিপ্রায় অনুযায়ী সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য হবে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা এবং উক্ত জাতীয় সংসদকে প্রকৃত অর্থে জাতীয় জীবনের সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে পরিণত করা। প্রিয় সাংবাদিক বন্দুগণ, দেশ ও দেশের জনগণের কল্যাণে গণতন্ত্র পুণঃপ্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্র পরিচালনা পদ্ধতি, জাতীয় অর্থনীতির বিকাশসহ সকল বিষয়ে যুগান্তকারী সব সংস্কার ও উন্নয়ন করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা কর্মসূচী, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভিশন-২০৩০ এবং জনাব তারেক রহমানের ২৭ দফা যা আন্দোলনের সহযোগীদের মতামতের ভিত্তিতে ৩১ দফায় পরিণত হয়- এই সব প্রত্যেকটি কর্মসূচী সংস্কারের বিষয়ে বিএনপি’র আন্তরিকতা ও আগ্রহের প্রমাণ।

এবারও গত প্রায় ১ বছর ধরে আমাদের দল এবং দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধিগণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত সংস্কার কমিশন এবং অতপর ঐকমত্য কমিশনের সকল সভা, আলোচনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে ও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আমাদের দলের পক্ষ থেকে অনেক বিষয়েই ছাড় দেওয়া হয়েছে। আমরা আন্তরিকভাবেই চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ার সাফল্য কামনা করি। কিন্তু একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসাবে দেশ ও জনগণের প্রকৃত কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমাদের অবস্থান গ্রহণ ও প্রকাশে আমরা দায়বদ্ধ।

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান, সালাহউদ্দিন আহমেদ ও মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।

জনপ্রিয় খবর

আবহাওয়া

ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন না দিতে পারলে এর দায় অন্তর্বর্তী সরকারকেই নিতে হবে : নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী

জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের নেই : মির্জা ফখরুল

প্রকাশের সময় : ০২:০২:৫৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক : 

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। ঐক্যমত কমিশনের প্রস্তাব জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।

মির্জা ফখরুল অভিযোগ করেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত, ভিন্নমত ও নোট অব ডিসেন্ট উল্লেখ করা হয়নি। যা দীর্ঘ এক বছরের ধারাবাহিক আলোচনাকে অর্থহীন করার পাশাপাশি প্রহসনমূলক এবং জাতির সঙ্গে প্রতারণার শামিল।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ঐকমত্য হওয়া কয়েকটি দফায় অগোচরে পরিবর্তন এনেছে ঐকমত্য কমিশন। কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকার আমলে নেয়নি। এ সময় জাতীয় নির্বাচনের দিন ছাড়া গণভোটের সিদ্ধান্ত বিএনপি কোনোভাবেই মেনে নেবে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন।

মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন- ১। দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এক নতুন গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার সূচনা হয়। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর গণতান্ত্রিক সংস্কারের জাতীয় প্রত্যাশা এবং শহীদদের আকাঙ্ক্ষা পূরণের এক ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, বিএনপি গণঅভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর পূর্বেই ২০২৩ সালে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর গণতান্ত্রিক সংস্কারের লক্ষ্যে জাতির সামনে ৩১ দফা উপস্থাপন করে। এর পূর্বে ২০২২ সালে ২৭ দফা এবং ২০১৭ সালে ভিশন-২০৩০ প্রকাশ করে। অতএব, বিএনপি এবং ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট সকল রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, ব্যক্তি ও শক্তিসমূহ জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী সার্বিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার ব্যক্ত করে আসছে। সুতরাং, রাষ্ট্র কাঠামোর প্রকৃত গনতান্ত্রিক সংস্কার বিএনপির অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক এজেন্ডা।

২। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তীতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক ঘোষিত ও গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। সংস্কার কমিশনগুলোর কাছে আমরা সংবিধান, বিচারবিভাগ, নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার, প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশ প্রশাসন সংক্রান্ত বিষয়ে আমাদের দলের পক্ষ থেকে বিস্তারিত মতামত প্রদান করেছি। অন্যান্য রাজনৈতিক দলসমূহও তাদের মতামত প্রদান করেছে। পরবর্তীতে উক্ত ছয়টি সংস্কার কমিশনের সঙ্গে আমাদের এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের দীর্ঘ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত ছয়টি সংস্কার কমিশন কর্তৃক প্রণীত সংস্কার প্রস্তাবগুলোর ওপরই দফাভিত্তিক আলাপ-আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সমস্ত আলাপ-আলোচনার ফলস্বরূপ প্রণীত রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়, যার সভাপতি প্রধান উপদেষ্টা।

৩। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলসমূহের প্রথম বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, যে সমস্ত বিষয়ে রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে, সেই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে একটি জাতীয় সনদ প্রণীত ও স্বাক্ষরিত হবে। পরবর্তীতে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সেই সনদের বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করবে। তিনি জাতির উদ্দেশে দেওয়া বিভিন্ন ভাষণেও তার এই বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে পুনঃব্যক্ত করেছেন। জুলাই ঘোষণাপত্রেও এই বক্তব্য উধৃত হয়েছে।

৪। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ ধারাবাহিক আলোচনায় কিছু কিছু বিষয়ে কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের ভিন্নমত/নোট অব ডিসেন্ট সহকারে ঐকমত্য হয়েছে। জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ যে ভাবে প্রণীত হয়েছে তাতে নোট অব ডিসেন্ট এর অংশে এই বক্তব্য স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, ভিন্নমত/নোট অব ডিসেন্ট প্রদানকারী কোন রাজনৈতিক দল বা জোট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখপূর্বক যদি জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করে, তাহলে তারা সেমতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। এখানে উল্লেখ্য যে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সকল অনুষ্ঠান বিটিভিসহ অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সম্প্রচারিত হয়েছে, যা সমস্ত জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। অতঃপর গত ১৭ই অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় এক ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমরা কেবল মাত্র আলোচনার মাধ্যমে প্রণীত সনদ এর অঙ্গিকারনামায় সাক্ষর করেছি। কিন্ত উক্ত দিনে জুলাই জাতীয় সনদ এর চূড়ান্ত কপি আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়নি। ৫। পরবর্তীতে প্রিন্টেড পুস্তক হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদের কপি আমরা হাতে পাওয়ার পর আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে যে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে সম্মত কয়েকটি দফা আমাদের অগোচরে পুনরায় সংশোধন করা হয়েছে ।

যেমনঃ ক। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বিভিন্ন সরকারি/বেসরকারি অফিসে টাঙ্গানো সংক্রান্ত বিধান [অনুচ্ছেদ ৪ (ক)] বিলুপ্ত করার বিষয়টি সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। যদিও প্রায় সকল রাজনৈতিক দল সম্মতি পত্র দিয়েছে।

খ। সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদ (পঞ্চম , ষষ্ঠ , সপ্তম তফসিল) পুরোপুরি বিলুপ্ত করার বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবের বিষয়ে প্রায় সকল রাজনৈতিক দল সম্মতি প্রকাশ করলেও অগোচরে সেটা চূড়ান্ত সনদে সংশোধনী আনা হয়েছে।

৬। জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এর বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ ২৮ অক্টোবর সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রেরিত চিঠিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি হিসেবে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টাও একজন দস্তখাতকারি বটে। ঐকমত্য কমিশন এবং সরকার একই অংগ হিসেবে প্রতিয়মান হয়। উক্ত পত্রে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এ সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে দুইটি বিকল্প পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের এবং আইনগত ভিত্তি প্রদানের জন্য সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছে।

৭। চিঠিতে বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিষয়গুলো কার্যকর করার উদ্দেশ্যে সরকার “জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫” শিরোনামে একটি আদেশ জারী করবে। এরুপ প্রস্তাবিত আদেশের একটি খসড়া সংযুক্তি-২ এবং সংযুক্তি-৩ এ সংযোজিত করা হয়েছে।

৮। সরকারের এরকম আদেশ জারী করার এখতিয়ার নাই। সংবিধানের ১৫২ নং অনুচ্ছেদের সংজ্ঞা অনুসারে “আদেশ” আইনের মর্যাদাপ্রাপ্ত, অতএব সেটি জারি করা রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার।

৯। বিকল্প প্রস্তাব ১ এ সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি পুর্নাংগ খসড়া বিল গণভোটে উপস্থাপন করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিলের তফসিল-১ এ সংস্কার প্রস্তাবসমূহ সন্নিবেশিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে বিল সরকারি গেজেটে প্রকাশ করা হবে।

১০। বিলে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সংবিধান সংশ্লিষ্ট তফসীল-১ এ বর্ণীত ৪৮ টি দফার (জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত দফাগুলি) উপরে গণভোট হবে।

১১। উক্ত দফাসমুহের বিপরীতে স্বাক্ষরিত জুলাই জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত রাজনৈতিক দলসমুহের মতামত, ভিন্নমত, নোট অব ডিসেন্ট উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব এবং সুপারিশ একপেশে ও জবরদস্তিমুলকভাবে জাতির উপরে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তা’হলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, দীর্ঘ প্রায় ১ বছরব্যাপী সংস্কার কমিশন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলসমুহের দীর্ঘ ধারাবাহিক আলোচনা ছিল অর্থহীন, অর্থও সময়ের অপচয়, প্রহসনমূলক এবং জাতির সাথে প্রতারণা।

১২। গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমত থাকবে এটাই স্বাভাবিক এবং সে কারণে সংলাপের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন ভিন্নমত পোষণে রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকারকে আমলেই নেয়নি।

১৩। উক্ত বাস্তবায়ন আদেশে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার পাশাপাশি একই সঙ্গে একটি “সংবিধান সংস্কার পরিষদ” গঠিত হবে। এবং তারা আলাদাভাবে সংসদ সদস্য এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদ সদস্য হিসেবে শপথ নিবেন। অর্থাৎ নির্বাচিত জাতীয় সংসদটি একই সঙ্গে “সংবিধান সংস্কার পরিষদ” হিসেবে অভিহিত হবে। প্রশ্ন হল, নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে জাতীয় সংসদ এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত; সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের লক্ষ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের বিষয়টি এজেন্ডাভুক্ত ছিলনা, আলোচনার জন্য উপস্থাপিত হয়নি, সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের বিষয়ে কোন ঐকমত্য হওয়ার অবকাশও ছিল না। উল্লেখ্য এ জাতীয় কোন সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন করতে হলে তাও পরবর্তী জাতীয় সংসদে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বলা হয়েছে উক্ত বাস্তবায়ন আদেশ অনুসারে অনুষ্ঠিত গণভোটে যদি ইতিবাচক সম্মতি পাওয়া যায় তাহলে সংবিধান সংস্কার বিলটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ তার দায়িত্ব পালনে সহায়ক হিসেবে বিবেচনা করবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠান হওয়ার পূর্বেই এই ধরণের ঢ়ৎব-বসঢ়ঃরাব পদক্ষেপ আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।

১৪। বলা হয়েছে, সংবিধান সংস্কার পরিষদ প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ হতে ২৭০ পঞ্জিকা দিবসের মধ্যে যদি সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয় তাহলে গণভোটে অনুমোদিত সংবিধান সংস্কার বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও হাস্যকর। জাতীয় সংসদে অনুমোদনের পর যে কোন বিল রাষ্ট্রপতির অনুমোদনপ্রাপ্তির পরই কেবল আইনে পরিণত হয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কোন সুযোগ নেই এবং তা গণতান্ত্রিক রীতি ও সংসদীয় সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী।

১৫। বিকল্প-২ প্রস্তাবে জুলাই সনদ আদেশের বিষয়টি বিল আকারে না দিয়ে সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত প্রস্তাবসমূহ সরাসরি গণভোটে উপস্থাপন করা হবে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রেও ঐকমত্য কমিশনের আলোচনাকালে বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিকদলসমুহ কর্তৃক প্রদত্ত মতামত, ভিন্নমত ও নোট অব ডিসেন্ট গণভোটে উপস্থাপনের সুযোগ রাখা হয়নি।

১৬। চিঠিতে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে অথবা নির্বাচনের দিন উক্ত আদেশ অনুযায়ী গণভোট নির্বাচন করা যেতে পারে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বিএনপি জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে জুলাই সনদের আইনী ভিত্তি রচনা এবং জনগনের সম্মতি গ্রহনের জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোটের প্রস্তাব করেছিল। ১৭। ২০২৬ সনের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। সেক্ষেত্রে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে প্রস্তাবিত গণভোট অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। সময় স্বল্পতা ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিপুল অঙ্কের ব্যয় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ ব্যাপক লোকবল নিয়োগ এবং একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মত বিশাল আয়োজনের বিবেচনায় নির্বাচনের পূর্বে গণভোট অনুষ্ঠান অপ্রয়োজনীয়, অযৌক্তিক এবং অবিবেচনাপ্রসূত। একই আয়োজনে এবং একই ব্যয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট অনুষ্ঠান করা বাঞ্ছনীয়।

১৮। জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এ উল্লেখিত যে সকল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আইন, বিধিবিধান পরিবর্তন বা সংশোধন করা দরকার, সরকার তা অধ্যাদেশ জারী ও বিধিবিধান/সংশোধন করে বাস্তবায়ন করতে পারে (সংযুক্তি-৪) এবং যে সকল সিদ্ধান্ত নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়নযোগ্য সে গুলো অবিলম্বে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন করতে পারে (সংযুক্তি-৫)। এই প্রস্তাবের সাথে আমরা এবং প্রায় সকল রাজনৈতিক দল ঐকমত্য পোষণ করেছি। এছাড়া জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন এর আইনী ভিত্তি দেয়ার জন্য আমরা গণভোটে সম্মত হয়েছি। যে সকল বিষয়ে ভিন্নমত / নোট অব ডিসেন্টসহ ঐকমত্য হয়েছে তার উল্লেখ না রেখে এবং দীর্ঘ আলোচনায় যে সব প্রসঙ্গ আলোচনায় আসেনি তা অন্তর্ভূক্ত করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অন্য সকল সুপারিশ অগ্রহণযোগ্য বিধায় আমারা একমত হতে পারছিনা। আমরা অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি যে, এই সকল সুপারিশ কেবল জাতিকে বিভক্ত করবে, ঐক্যের বদলে অনৈক্য সৃষ্টি করবে। মনগড়া যেকোনো সংস্কার প্রস্তাব গ্রহন করলে জাতীয় জীবনে দীর্ঘ মেয়াদে অকল্যাণ ডেকে নিয়ে আসতে পারে।

১৯। আমরা আশা করি, জাতির প্রত্যাশা পূরণে এবং দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও ২০২৪ সালের ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের সকল শহীদের রক্তের অঙ্গীকার অনুযায়ী এবং যারা দীর্ঘ এই সংগ্রামে ফ্যাসিবাদী শাসনামলে গুম, খুন, অপহরণ, নির্যাতন, মামলা, হামলার শিকার হয়েছেন—তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুনর্গঠন করতে পারব। প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। সেই লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখা আমাদের সকলের কাম্য এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জাতির অভিপ্রায় অনুযায়ী সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য হবে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা এবং উক্ত জাতীয় সংসদকে প্রকৃত অর্থে জাতীয় জীবনের সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে পরিণত করা। প্রিয় সাংবাদিক বন্দুগণ, দেশ ও দেশের জনগণের কল্যাণে গণতন্ত্র পুণঃপ্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্র পরিচালনা পদ্ধতি, জাতীয় অর্থনীতির বিকাশসহ সকল বিষয়ে যুগান্তকারী সব সংস্কার ও উন্নয়ন করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা কর্মসূচী, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভিশন-২০৩০ এবং জনাব তারেক রহমানের ২৭ দফা যা আন্দোলনের সহযোগীদের মতামতের ভিত্তিতে ৩১ দফায় পরিণত হয়- এই সব প্রত্যেকটি কর্মসূচী সংস্কারের বিষয়ে বিএনপি’র আন্তরিকতা ও আগ্রহের প্রমাণ।

এবারও গত প্রায় ১ বছর ধরে আমাদের দল এবং দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধিগণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত সংস্কার কমিশন এবং অতপর ঐকমত্য কমিশনের সকল সভা, আলোচনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে ও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আমাদের দলের পক্ষ থেকে অনেক বিষয়েই ছাড় দেওয়া হয়েছে। আমরা আন্তরিকভাবেই চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ার সাফল্য কামনা করি। কিন্তু একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসাবে দেশ ও জনগণের প্রকৃত কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমাদের অবস্থান গ্রহণ ও প্রকাশে আমরা দায়বদ্ধ।

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান, সালাহউদ্দিন আহমেদ ও মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।