নিজস্ব প্রতিবেদক :
সাতটি প্রতিষ্ঠান মেট্রোরেল নির্মাণের সঙ্গে জড়িত ছিল। এর তদারকিতেও রয়েছে একই দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। ফলে কাজের গুণগত মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি, করা হয়নি নিরাপত্তাসংক্রান্ত অডিট। বিষয়টি অনেকটা এমন- শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিচ্ছে, আবার তারা নিজেরাই উত্তরপত্রে নম্বর দিচ্ছে। এমনটা ঘটেছে ঢাকার মেট্রোরেল নির্মাণে। ফলে মেট্রোরেলে ঝুঁকি হ্রাসের বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি।
জাপানের মতো দেশের কাজের গুণগত মান নিয়ে প্রশংসা করা হয়। যদিও বন্ধুপ্রতীম এ দেশটির কিছু শর্ত মানতে অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হয়েছে। ধারণা ছিল, দেশটি মানের ক্ষেত্রে কোনো আপস করে না। কিন্তু বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনায় আগের ধারণা ভাঙতে শুরু করেছে। নকশাগত ত্রুটি ও তদারকিতে আপসের খেসারত হিসেবে একটি তাজাপ্রাণ ঝরে পড়ে। আরও সমস্যা হচ্ছে, ওই সময়ে মেট্রোরেল নির্মাণের বড় দায়িত্বে থাকা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) ও প্রকল্প পরিচালক দুজনের কারও কারিগরি জ্ঞান ছিল না। তবু তাদের সিদ্ধান্তেই বাস্তবায়ন হলো ব্যয়বহুল এই প্রকল্প। সময়ের আগে কাজ শেষ করার তাড়াও প্রকল্পের ক্ষতি করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ডিএমটিসিএলের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ বলেন, বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনা তদন্ত চলছে। এর পরই বিস্তারিত বলা সম্ভব।
একাধিক কর্মকর্তা জানান, মেট্রোরেল চলে সাধারণত সোজা পথ দিয়ে এবং মূল সড়ক বরাবর। কিন্তু আমাদের দেশের মূল সড়কগুলোর অনেক জায়গাতেই বাঁক রয়েছে। এ কারণে মেট্রোরেলেও বাঁক দেওয়া হয়েছে অন্তত তিনটি জায়গায়। বিপত্তিটা সেখানেই। দ্রুত গতিতে ট্রেন চলাচলের সময় এই বাঁকের বিয়ারিং প?্যাড একটু একটু করে সরে যেতে থাকে। একে বলা হয় নকশার ত্রুটি। ৪৩৩ নম্বর পিয়ারের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে। এর আগে পড়ে যায় ৪৩০ নম্বর পিয়ারের প্যাড। যে স্থানে দুইবার বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছে, সে জায়গায় বড় বাঁক রয়েছে। এ ছাড়া স্থানটি অন্য জায়গা থেকে কিছুটা উঁচু। এখানে নকশাগত ত্রুটি আছে বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
জাপানের কয়েকটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে তদারকির দায়িত্বে মেট্রোরেলের। নাম এনকেডিএম অ্যাসোসিয়েশন। নির্মাণকাজ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সবই দেখার কথা পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু তারা তা করেনি। এ জন্য ওই প্রতিষ্ঠানকে এরই মধ্যে নোটিশ করা হয়েছে। পুরো ব্যবস্থার নকশা প্রণয়ন, ঠিকাদার নিয়োগ এবং নির্মাণকাজ তদারকির দায়িত্বে ছিল পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এনকেডিএম অ্যাসোসিয়েশন, যা বেশ কয়েকটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত জোট।
এই জোটের মূল নেতৃত্বে রয়েছে জাপানের নিপ্পন কোই। এ ছাড়া আরও আছে নিপ্পন কোই ইন্ডিয়া, দিল্লি মেট্রোরেল করপোরেশন, যুক্তরাজ্যের মট ম্যাগডোনাল্ড, মট ম্যাকডোনাল্ড ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশের ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালটেন্টস। তাদের দলনেতা ছিলেন জাপানের তাকাউকি ফুজিতোমি। মেট্রোরেল প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১২ সালে। তখন অনুমোদনের সময় ব্যয় ছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। সর্বশেষ ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। মেট্রোরেল প্রকল্পের জন্য জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) কাছ থেকে ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। প্রতি কিলোমিটার মেট্রোরেলের পথ নির্মাণে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে; যা আশপাশের দেশের তুলনায় অনেক বেশি, বিশ্বেই অন্যতম শীর্ষে। কারিগরি ত্রুটি ধরার জন্য নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ধাপে ধাপে তা রক্ষণাবেক্ষণ করা ও গাইডলাইন দেওয়ার কথা। এ কাজটি যথাযথ হয়নি। এ কারণেই নির্মাণকাজের ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়েনি। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি এসেট ম্যানেজমেন্টে দুর্বলতা রয়েছে বলে মনে করছেন প্রকৌশলীরা।
বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে নিচে পড়ে যায়, এখানে কয়েক বছরে অকালক্ষয় বা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবজনিত অবনতি হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম। ইঙ্গিত করে যে, এটি পিয়ার ও ডেকের মধ্যে সংযোগ অবস্থায় ছিল না।
এদিকে কেন মেট্রোরেলে নিরাপত্তাঝুঁকি থাকবে এ ক্ষেত্রে জাপানের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এনকেডিএমের কোনো দায় ও গাফিলতি আছে কি না, সেটাও তদন্ত করা যৌক্তিক বলে মনে করা হচ্ছে। জাপানের চুক্তির শর্তের কারণে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া সমীচীন নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বলা হচ্ছেÑ রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পথে মেট্রোরেল চালানো শুরু করা হয়েছিল তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা নিরীক্ষা (অডিট) ছাড়াই। এরপর দুইবার বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনা ঘটল।
তবে অন্য একটি সূত্র বলেছে, বিভিন্ন রেলপথ, উড়াল সড়কসহ মেগা প্রকল্পের কোনোটাই তৃতীয় পক্ষ দিয়ে নিরীক্ষা অডিট করা হয়নি। জরুরি এ কাজটি উপেক্ষিত। গত জুন থেকে এ পর্যন্ত স্থাপনার সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য সাতটি চিঠি দিয়েছে ডিএমটিসিএল। ঠিকাদারের কাজ তদারকির মূল দায়িত্ব পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্প পরিচালকের দপ্তরের। তাই সব কটি চিঠি পরামর্শক ও প্রকল্প পরিচালকের উদ্দেশে দেওয়া হয়েছে।
২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পথে প্রথম মেট্রোরেল চালু হয়। মতিঝিল পর্যন্ত সব স্টেশনে যাত্রী ওঠানামা শুরু হয় ২০২৩ সালের শেষ দিনে। ২০২৪ সালের নির্বাচন সামনে রেখে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার তাড়াহুড়া করে মেট্রোরেল চালু করে। যদিও তখন যাত্রী নিয়ে চলার আগে পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হয়েছে। নিরাপত্তার নানা বিষয় দেখা হয়েছে।
নিজস্ব প্রতিবেদক 





















