পদ্মা সেতু নির্মাণে খরচ হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এই বিশাল বিনিয়োগের প্রাপ্তি হিসাবের দুটি উপায় আছে। একটি হলো মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) বাড়তি প্রাপ্তি বিবেচনা, অন্যটি সেতু দিয়ে পারাপার হওয়া বিভিন্ন যানবাহন থেকে নির্দিষ্ট হারে টোল আদায়ের মাধ্যমে সরাসরি খরচ উঠিয়ে আনা।
কোন উপায়ে কত বছরে পদ্মা সেতুর ব্যয় উঠে আসতে পারে, সরকারিভাবে তার সুনির্দিষ্ট হিসাব পাওয়া যায় না। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষা এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নানা তথ্য-উপাত্ত থেকে এ বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়া যায়।
এই সেতু দিয়ে দেশের ২৩ জেলায় প্রতিদিন ২১ হাজার ৩০০ যানবাহন চলাচল করবে, যা ২০২৫ সাল নাগাদ বেড়ে দাঁড়াবে ৪১ হাজার ৬০০। এদের সবার থেকে টোল বাবদ যে আয় হবে, শুধু তা দিয়ে সেতুর ব্যয় উঠে আসতে সময় লাগবে সাড়ে ৯ বছর।
অন্যদিকে সেতু চালু হওয়ার কারণে আগামী এক বছর বা ১২ মাসে অর্থনীতিতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) বাড়তি প্রাপ্তি যোগ হবে চলতি বাজারমূল্যে ৪২ হাজার ৩৬২ কোটি ২১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা, যা জিডিপির ১.২ শতাংশের সমান।
এই বিবেচনায় মাত্র ৯ মাসে উঠে আসবে ৩১ হাজার ৭৭১ কোটি ৬৬ লাখ ৩২ হাজার টাকা, অর্থাৎ অর্থনীতিতে মাত্র এই ৯ মাসের প্রাপ্তি হবে পদ্মা সেতুর মোট ব্যয়ের সমান।
বিশাল বিনিয়োগের প্রকল্প শুরু করার আগে সেটি অর্থনৈতিকভাবে কতটা সুফল দেবে এবং তার প্রাপ্তি কতকাল ধরে অর্থনীতি পেতে থাকবে, তার আগাম সমীক্ষা করা হয়ে থাকে। প্রকল্পের গুরুত্ব বুঝে এ ধরনের সমীক্ষায় দেশীয় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিদেশি স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে সরকার এ মূল্যায়নে সম্পৃক্ত করেছে বিশ্বব্যাংক ও জাইকাকে। জাতীয়ভাবে সরকারও প্রকল্পের সমীক্ষা চালায়। সম্ভাব্যতা জরিপে বলা হয়, সেতুটি নির্মিত হলে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এতে ওই অঞ্চলের মানুষের আয় বাড়বে ১ দশমিক ৪ শতাংশ এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে ৭ লাখ ৪৩ হাজার মানুষের।
জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সমীক্ষাতেও বলা হয়, জিডিপি বাড়বে ১ দশমিক ২ শতাংশ। আর বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষায় বলা হয়, পদ্মা সেতু চালু হলে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে ১ শতাংশ হারে।
সরকারের দায়িত্বশীল একাধিক মন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে পদ্মা সেতুর প্রভাবে জিডিপি ১ দশমিক ২ থেকে ১ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ার তথ্য দেন। এ ছাড়া দেশীয় একাধিক গবেষণা সংস্থার দাবি, জিডিপি বাড়বে দেড় থেকে দুই শতাংশ পর্যন্ত।
সেতু পারাপারে টোল হার কার্যকরের মাধ্যমে সরাসরি ব্যয় তুলে আনার বিষয়ে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) একটি নিজস্ব গণনা পদ্ধতি রয়েছে। এই পদ্ধতিকে যে এলাকায় সেতু নির্মিত হবে, ওই এলাকায় ফেরি পারাপার থেকে দৈনিক যে পরিমাণ টোল আদায় করা হয়, সেতু পারপারে তার দেড় থেকে দুই গুণ টোল ধার্য করার নিয়ম রয়েছে।
পদ্মা সেতুতেও টোল হার নির্ধারণ করার আগে ফেরিতে কী পরিমাণ টোল আদায় হয় এবং কী পরিমাণ যানবাহন পারাপার হয়, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) থেকে এ তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এই সংস্থার তথ্য মতে, ২০২০ সালের নভেম্বরে মাওয়া এবং জাজিরার মধ্যে ফেরিতে যানবাহন পারাপারে দৈনিক ৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা আয় হয়েছে।
সেতু বিভাগ (বিবিএ) এ পরিসংখ্যানকে ভিত্তি ধরে প্রাথমিকভাবে দৈনিক ৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা টোল আদায়ের আশা করছে। অর্থাৎ বিআইডব্লিউটিএর আয়ের দেড় গুণের বেশি এবং দুই গুণের কম আয়ের একটি মধ্যবর্তী ভিত্তি নির্ধারণ করা হয়েছে।
তবে টোল হার যেটিই নির্ধারণ করা হোক না কেন, ব্যয় উঠে আসার সময়সীমার ক্ষেত্রে পরিষ্কার কিছু বলা হয়নি। এ নিয়ে নানা গণমাধ্যমে বিচ্ছিন্নভাবে খবর হয়েছে। এতে সেতু বিভাগের প্রাথমিক সমীক্ষায় বলা হয়, ৩৫ বছরে উঠে আসবে পদ্মা সেতুর ব্যয়। একই ইস্যুতে দায়িত্বশীলদের কেউ কেউ বলছেন, সময় লাগবে ২০ থেকে ২৫ বছর এবং কেউ আবার ১৭ বছরের কথা বলছেন।
অনুসন্ধান করে জানা যায়, টোল থেকে পাওয়া সমুদয় হিসাব বিবেচনায় নিলে সেতুর ব্যয় তুলে আনতে ৯ বছর ৫ মাস ৬ দিনের বেশি লাগবে না।
তবে এ হিসাবে সেতুর পরিচালন খরচ এবং এর সঙ্গে ১৪৭ কিস্তির ১ শতাংশ সুদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘টোল হিসাবে যে রাজস্ব আসবে, সে হিসাবে পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যয় উঠে আসার কথা ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। সেতুটি নিয়ে যখন প্রজেক্ট ডিজাইন করা হয়েছে, তখন এমন সম্ভাব্যতার কথাই বলা হয়েছে। তবে আদায় পর্যায়ে টোল হার বিবেচনায় এই সময় আরও কমবেশি হতে পারে।
অন্যদিকে সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব খন্দকার আনোরুল ইসলাম মন্ত্রিসভা বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, ১৭ বছরে উঠে আসতে পারে পদ্মা সেতুর ব্যয়।
তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর টাকা সেতু কর্তৃপক্ষকে ১ শতাংশ হারে সুদে সরকারকে ফেরত দিতে হবে। ফিজিবিলিটি স্টাডিতে বলা হয়েছে, ২৪ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে টাকাটা (নির্মাণ ব্যয়) উঠে আসবে। এখন মনে হচ্ছে ১৬ থেকে ১৭ বছরের মধ্যেই টাকাটা উঠে আসবে, কারণ মোংলা পোর্ট যে এত শক্তিশালী হবে, পায়রা বন্দর হবে, এত শিল্পায়ন হবে, সেগুলো কিন্তু ফিজিবিলিটি স্টাডিতে আসেনি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সবশেষ পূর্ণাঙ্গ হিসাব আছে গত ২০২০-২১ অর্থবছরের। সেখানে টাকার অঙ্কে মোট দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ ৩৫ লাখ ৩০ হাজার ১৮৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
আগামী বছর পদ্মা সেতুর প্রভাবে জিডিপি দেড় শতাংশ বাড়লে অর্থনীতিতে প্রথম বছর এর বাড়তি অর্থমূল্য দাঁড়াবে ৫২ হাজার ৯৫২ কোটি ৭৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। জিডিপি ১ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়লে সার্বিক অর্থনীতিতে ৪৫ হাজার ৮৯২ কোটি ৪০ লাখ ২৪ হাজার টাকার বাড়তি স্ফীতি ঘটবে। আর জিডিপি ১ দশমিক ২ শতাংশ বাড়লে টাকার অঙ্কে জিডিপির বাড়তি প্রাপ্তি আসবে মোট ৪২ হাজার ৩৬২ কোটি ২১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। জিডিপি সর্বনিম্ন ১ শতাংশ ধরা হলে আগামী বছর জিডিপির অতিরিক্ত প্রাপ্তি মিলবে মোট ৩৫ হাজার ৩০১ কোটি ৮৪ লাখ ৮০ হাজার টাকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান জানান, আমরা সম্ভাব্যতার বড় জায়গাটায় না গেলাম, সর্বনিম্ন সমীক্ষাটিই যদি গ্রহণ করি, তাও তো জিডিপি বাড়ার হার ন্যূনতম ১ শতাংশ হবে। এটাই হলো আমাদের পদ্মা সেতু, যা বাংলাদেশের সক্ষমতা, সমৃদ্ধি, অহংকার ও সাহসের প্রতীক, যার স্বপ্ন দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ড. আতিউর রহমান বলেন, উত্তরবঙ্গে যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর দেশের অর্থনীতিতে বিরাট বিস্ফোরণ ঘটেছিল, যার ধারাবাহিকতা এখনও আছে। পদ্মা সেতু চালুর ফলে আগামীর অর্থনীতিতে তার চেয়েও বড় বিস্ফোরণ ঘটাতে যাচ্ছে।