Dhaka সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ২৮ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে সাড়ে ১১ কিলোমিটার সড়কের নাজুক পরিস্থিতি, দুর্ভোগের চলাচলকারীরা

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রতিনিধি : 

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নির্মাণাধীন চার লেন মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ থেকে সরাইল বিশ্বরোড পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার অংশে নাজুক পরিস্থিতি। এতে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন এই মহাসড়কে চলাচলরত পরিবহন যাত্রী ও চালকরা।

এতে মহাসড়কে চলাচলতরত যানবাহনগুলো স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারছে না। একইসঙ্গে সংস্কার কাজের জন্য নির্মাণসামগ্রী রেখে ঢাকা থেকে কুমিল্লা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়াগামী ইউটার্নটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে মহাসড়কের বিশ্বরোড অংশে সকাল থেকে তীব্র যানজটের বেধেছে।

এই ভোগান্তি লাঘবে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরকে সময় বেঁধে দিয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। আর কাজ তদারকির জন্য গঠন করা হয়েছে ১২ সদস্যের একটি কমিটি। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সরাইলে স্থাপন করা হয়েছে ক্যাম্প অফিস। এই ক্যাম্প অফিসে প্রকৌশলীদের অবস্থান করে সার্বক্ষণিক মেরামত ও নির্মাণকাজ তদারকির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মহাসড়কের কাজ ও সর্বশেষ পরিস্থিতি দেখতে বুধবার (৮ অক্টোবর) আশুগঞ্জ যাবেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।

মহাসড়কটির দুরবস্থা নিরসনে ‘যুদ্ধপরিস্থিতি’ বিবেচনায় নিয়ে কাজ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

সরকারি চাকরিজীবী ফেরদৌস ভূঁইয়ার অফিস সিলেটে। বাড়ি আশুগঞ্জ। রোববার (৫ অক্টোবর) সকাল ছয়টায় তিনি আশুগঞ্জ থেকে বাসে ওঠেন। মহাসড়ক স্বাভাবিক থাকাকালে সিলেট যেতে তিন ঘণ্টা সময় লাগত। কিন্তুরোববার (৫ অক্টোবর) সরাইল বিশ্বরোড মোড় পার হতেই সোয়া দুই ঘণ্টা লেগে যায় বলে জানান তিনি।

ফেরদৌস ভূঁইয়া বলেন, সপ্তাহের শনি বা রোববার সিলেট যান তিনি। আর আশুগঞ্জ ফেরেন বৃহস্পতিবার রাতে। যাওয়া-আসায় তাঁকে প্রতিনিয়ত একই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। গত এক বছরে ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। এখন আশুগঞ্জ থেকে সিলেট যেতে-আসতে গড়ে ছয় ঘণ্টা করে সময় লাগে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, শারদীয় দুর্গাপূজার ছুটিতে গত বুধবার থেকে টানা ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়া অংশে দীর্ঘ যানজট হয়েছিল। আশুগঞ্জ গোলচত্বর থেকে সরাইল উপজেলার বেড়তলা, সরাইল বিশ্বরোড মোড় ও শাহবাজপুর সেতু হয়ে হবিগঞ্জের মাধবপুর এলাকা পর্যন্ত ৩৪ কিলোমিটার এলাকায় যানজট ছড়িয়ে পড়েছিল।

এই মহাসড়ক দিয়ে সিলেট বিভাগের চার জেলা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মধ্যে দিনে এক হাজারের বেশি বাস চলাচল করে। এর বাইরে চলে বিপুলসংখ্যক ব্যক্তিগত গাড়ি, মাইক্রোবাস ও মালবাহী যানবাহন। এই পথে চলাচলকারীদের মধ্যে পর্যটক আছেন। আছেন বিদেশগামী ও বিদেশ থেকে আসা যাত্রী। মহাসড়কের দুরবস্থার কারণে যাত্রীদের নিয়মিত ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

কমিটি গঠন

ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্পের পরিচালক এ কে এম রেজাউল করিমের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। কমিটিতে সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়, কুমিল্লা জোন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক সার্কেল ও প্রকল্পের কর্মকর্তারা আছেন। তাঁদের সরাইলে স্থাপন করা ক্যাম্প অফিসে অবস্থান করে চলমান কাজের তদারকির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

কমিটির কার্যপরিধির মধ্যে আছে ক্ষতিগ্রস্ত মহাসড়ক দ্রুততম সময়ের মধ্যে মেরামত করে যান চলাচল স্বাভাবিক করা। স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে মহাসড়কে শৃঙ্খলা আনা। কমিটি প্রতিদিন সওজের প্রধান প্রকৌশলীকে কাজের অগ্রগতিসহ বাস্তব পরিস্থিতি অবহিত করবে।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. এহসানুল হক বলেন, মহাসড়কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশটি ভারতীয় ঋণে সম্প্রসারণের কাজ চলছিল। ঠিকাদার সময়মতো কাজ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এ জন্য শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আগামী এক মাসে দৃশ্যমান উন্নতিসহ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজটি শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সওজের তথ্য অনুসারে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ থেকে নরসিংদীর ইটাখোলা পর্যন্ত অংশে দিনে গড়ে ৩০ হাজারের মতো যানবাহন চলাচল করে। ইটাখোলা থেকে সিলেটের শেরপুর অংশে ১০ থেকে ১৫ হাজার যানবাহন চলে। আর সিলেটের শেরপুর থেকে সিলেট শহর পর্যন্ত অংশে চলে গড়ে ২৭ হাজারের মতো যানবাহন। এই মহাসড়কে চলাচল করা যানবাহনের বড় অংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা।

যেভাবে বেহাল

ঢাকার কাঁচপুর থেকে সিলেট পর্যন্ত মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে সওজের একটি প্রকল্প চলমান। এর আওতায় ২০৯ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হবে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। এর আওতায় চার লেনের মহাসড়কের দুই পাশে স্থানীয় যানবাহন চলাচলের জন্য আলাদা সড়ক নির্মাণ করা হবে।

তবে এই মহাসড়কের আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে বিশ্বরোড মোড় হয়ে আখাউড়ায় ভারত সীমান্ত পর্যন্ত সড়ক চার লেনে উন্নীত করতে আগে থেকে প্রকল্প চলমান। প্রকল্পটি নেওয়া হয় ২০১৭ সালে। একবার সংশোধনের পর প্রকল্পের খরচ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভারতীয় ঋণ ২ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা। বাকি ২ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা দেবে সরকার। গত জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অর্ধেক কাজ হয়েছে। প্রকল্পটির কাজ তিনটি প্যাকেজে (ভাগে) বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সব কটির ঠিকাদার ভারতের এফকনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড।

সওজ সূত্র বলছে, করোনা মহামারির সময় ভারতীয় ঠিকাদার তেমন একটা কাজ করেনি। ২০২২ সালে প্রকল্পটির কাজ পুরোদমে শুরু হয়। স্থানীয় প্রকৌশলী ও শ্রমিকদের পাশাপাশি তিন শর মতো ভারতীয় নাগরিক এই প্রকল্পে কাজ করতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতীয়রা চলে যান। এ কারণে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরে ঠিকাদার কাজ শুরু করলেও বাড়তি কাজের টাকা (ভ্যারিয়েশন) দাবি করে। এ সময় বিদ্যমান মহাসড়কটি ঠিকমতো মেরামত করা হয়নি। এ কারণেই মূলত যানজট ও ভোগান্তির সূত্রপাত।

সওজের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সম্প্রসারণকাজ চলার কারণে পুরো মহাসড়কেই যানবাহনের গতি কমেছে। তবে আশুগঞ্জ অংশে মহাসড়ক এতটাই বেহাল যে তা যান চলাচল একেবারে স্থবির করে দিয়েছে। ভারতীয় ঠিকাদার কাজ শুরুর পর থেকে ভোগান্তি চলছে। কারণ, তারা বিদ্যমান মহাসড়কটি ঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করেনি।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ধরখার থেকে আখাউড়া সীমান্ত পর্যন্ত অংশের প্রায় সাড়ে ১১ কিলোমিটার কাজে ভারতীয় ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ, ভারতের সঙ্গে এখন সীমান্ত বাণিজ্য সীমিত। তাই এটি অগ্রাধিকারে নেই। সরাইল থেকে ধরখার পর্যন্ত প্রায় ৩২ কিলোমিটার অংশও বেহাল। তবে এই অংশের কাজ অব্যাহত রাখা হবে।

আশুগঞ্জ থেকে সরাইল পর্যন্ত মহাসড়কের অংশ। এই অংশে আগে পরিকল্পনা ছিল মূল সড়কের পাশে স্থানীয় যানবাহন চলাচলের জন্য দুই পাশে সাড়ে তিন মিটার চওড়া সড়ক নির্মাণ করা হবে। পরে তা সম্প্রসারণ করে সাড়ে ৫ মিটার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর জন্য প্রায় ১৬৪ কোটি টাকা বাড়তি অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই অর্থ থেকে এখন সম্প্রসারণ ও বিদ্যমান সড়ক মেরামত করা হবে।

এদিকে সড়ক বিভাগের অস্থায়ী ভোগান্তিমূলক কাজের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবহন যাত্রী চালকরা।

স্থানীয় বাসিন্দা রুকন উদ্দিন লস্কর জানান, একজন রাষ্ট্রীয় অতিথি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করবেন, তার আগমনকে কেন্দ্র করে অস্থায়ীভাবে সড়কটি মেরামতে এমন আয়োজন দুঃখজনক। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রের অর্থ অপচয়ের একটি বিষয় জড়িত রয়েছে।

বাসচালক আলী আকবর জানান, ইউটার্নটি বন্ধ করার কারণে, মহাসড়কে যানজটের তীব্রতা আরও বেড়েছে। এভাবে অপরিকল্পিতভাবে কাজ করা ঠিক নয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক ও জনপদ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রোকন উদ্দিন খন্দকার জানান, অস্থায়ী কাজ কত মিটার করা হচ্ছে বা এর ব্যয় কত এই মুহূর্তে সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যয়ের বিষয়টি নির্ধারণ করা হবে।

এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া খাটিহাতা হাইওয়ে থানার ও জাহাঙ্গীর আলম জানান, যানজট নিরসনে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন, হাইওয়ে পুলিশ সদস্যরা। তবে সংস্কার কাজের জন্য ভোগান্তির মাত্রা আরও বেড়েছে। ভোগান্তি লাঘবে স্থায়ীভাবে কাজ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

জনপ্রিয় খবর

আবহাওয়া

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে সাড়ে ১১ কিলোমিটার সড়কের নাজুক পরিস্থিতি, দুর্ভোগের চলাচলকারীরা

প্রকাশের সময় : ০২:২৬:৫২ অপরাহ্ন, সোমবার, ৬ অক্টোবর ২০২৫

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রতিনিধি : 

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নির্মাণাধীন চার লেন মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ থেকে সরাইল বিশ্বরোড পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার অংশে নাজুক পরিস্থিতি। এতে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন এই মহাসড়কে চলাচলরত পরিবহন যাত্রী ও চালকরা।

এতে মহাসড়কে চলাচলতরত যানবাহনগুলো স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারছে না। একইসঙ্গে সংস্কার কাজের জন্য নির্মাণসামগ্রী রেখে ঢাকা থেকে কুমিল্লা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়াগামী ইউটার্নটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে মহাসড়কের বিশ্বরোড অংশে সকাল থেকে তীব্র যানজটের বেধেছে।

এই ভোগান্তি লাঘবে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরকে সময় বেঁধে দিয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। আর কাজ তদারকির জন্য গঠন করা হয়েছে ১২ সদস্যের একটি কমিটি। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সরাইলে স্থাপন করা হয়েছে ক্যাম্প অফিস। এই ক্যাম্প অফিসে প্রকৌশলীদের অবস্থান করে সার্বক্ষণিক মেরামত ও নির্মাণকাজ তদারকির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মহাসড়কের কাজ ও সর্বশেষ পরিস্থিতি দেখতে বুধবার (৮ অক্টোবর) আশুগঞ্জ যাবেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।

মহাসড়কটির দুরবস্থা নিরসনে ‘যুদ্ধপরিস্থিতি’ বিবেচনায় নিয়ে কাজ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

সরকারি চাকরিজীবী ফেরদৌস ভূঁইয়ার অফিস সিলেটে। বাড়ি আশুগঞ্জ। রোববার (৫ অক্টোবর) সকাল ছয়টায় তিনি আশুগঞ্জ থেকে বাসে ওঠেন। মহাসড়ক স্বাভাবিক থাকাকালে সিলেট যেতে তিন ঘণ্টা সময় লাগত। কিন্তুরোববার (৫ অক্টোবর) সরাইল বিশ্বরোড মোড় পার হতেই সোয়া দুই ঘণ্টা লেগে যায় বলে জানান তিনি।

ফেরদৌস ভূঁইয়া বলেন, সপ্তাহের শনি বা রোববার সিলেট যান তিনি। আর আশুগঞ্জ ফেরেন বৃহস্পতিবার রাতে। যাওয়া-আসায় তাঁকে প্রতিনিয়ত একই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। গত এক বছরে ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। এখন আশুগঞ্জ থেকে সিলেট যেতে-আসতে গড়ে ছয় ঘণ্টা করে সময় লাগে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, শারদীয় দুর্গাপূজার ছুটিতে গত বুধবার থেকে টানা ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়া অংশে দীর্ঘ যানজট হয়েছিল। আশুগঞ্জ গোলচত্বর থেকে সরাইল উপজেলার বেড়তলা, সরাইল বিশ্বরোড মোড় ও শাহবাজপুর সেতু হয়ে হবিগঞ্জের মাধবপুর এলাকা পর্যন্ত ৩৪ কিলোমিটার এলাকায় যানজট ছড়িয়ে পড়েছিল।

এই মহাসড়ক দিয়ে সিলেট বিভাগের চার জেলা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মধ্যে দিনে এক হাজারের বেশি বাস চলাচল করে। এর বাইরে চলে বিপুলসংখ্যক ব্যক্তিগত গাড়ি, মাইক্রোবাস ও মালবাহী যানবাহন। এই পথে চলাচলকারীদের মধ্যে পর্যটক আছেন। আছেন বিদেশগামী ও বিদেশ থেকে আসা যাত্রী। মহাসড়কের দুরবস্থার কারণে যাত্রীদের নিয়মিত ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

কমিটি গঠন

ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্পের পরিচালক এ কে এম রেজাউল করিমের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। কমিটিতে সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়, কুমিল্লা জোন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক সার্কেল ও প্রকল্পের কর্মকর্তারা আছেন। তাঁদের সরাইলে স্থাপন করা ক্যাম্প অফিসে অবস্থান করে চলমান কাজের তদারকির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

কমিটির কার্যপরিধির মধ্যে আছে ক্ষতিগ্রস্ত মহাসড়ক দ্রুততম সময়ের মধ্যে মেরামত করে যান চলাচল স্বাভাবিক করা। স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে মহাসড়কে শৃঙ্খলা আনা। কমিটি প্রতিদিন সওজের প্রধান প্রকৌশলীকে কাজের অগ্রগতিসহ বাস্তব পরিস্থিতি অবহিত করবে।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. এহসানুল হক বলেন, মহাসড়কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশটি ভারতীয় ঋণে সম্প্রসারণের কাজ চলছিল। ঠিকাদার সময়মতো কাজ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এ জন্য শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আগামী এক মাসে দৃশ্যমান উন্নতিসহ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজটি শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সওজের তথ্য অনুসারে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ থেকে নরসিংদীর ইটাখোলা পর্যন্ত অংশে দিনে গড়ে ৩০ হাজারের মতো যানবাহন চলাচল করে। ইটাখোলা থেকে সিলেটের শেরপুর অংশে ১০ থেকে ১৫ হাজার যানবাহন চলে। আর সিলেটের শেরপুর থেকে সিলেট শহর পর্যন্ত অংশে চলে গড়ে ২৭ হাজারের মতো যানবাহন। এই মহাসড়কে চলাচল করা যানবাহনের বড় অংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা।

যেভাবে বেহাল

ঢাকার কাঁচপুর থেকে সিলেট পর্যন্ত মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে সওজের একটি প্রকল্প চলমান। এর আওতায় ২০৯ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হবে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। এর আওতায় চার লেনের মহাসড়কের দুই পাশে স্থানীয় যানবাহন চলাচলের জন্য আলাদা সড়ক নির্মাণ করা হবে।

তবে এই মহাসড়কের আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে বিশ্বরোড মোড় হয়ে আখাউড়ায় ভারত সীমান্ত পর্যন্ত সড়ক চার লেনে উন্নীত করতে আগে থেকে প্রকল্প চলমান। প্রকল্পটি নেওয়া হয় ২০১৭ সালে। একবার সংশোধনের পর প্রকল্পের খরচ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভারতীয় ঋণ ২ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা। বাকি ২ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা দেবে সরকার। গত জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অর্ধেক কাজ হয়েছে। প্রকল্পটির কাজ তিনটি প্যাকেজে (ভাগে) বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সব কটির ঠিকাদার ভারতের এফকনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড।

সওজ সূত্র বলছে, করোনা মহামারির সময় ভারতীয় ঠিকাদার তেমন একটা কাজ করেনি। ২০২২ সালে প্রকল্পটির কাজ পুরোদমে শুরু হয়। স্থানীয় প্রকৌশলী ও শ্রমিকদের পাশাপাশি তিন শর মতো ভারতীয় নাগরিক এই প্রকল্পে কাজ করতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতীয়রা চলে যান। এ কারণে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরে ঠিকাদার কাজ শুরু করলেও বাড়তি কাজের টাকা (ভ্যারিয়েশন) দাবি করে। এ সময় বিদ্যমান মহাসড়কটি ঠিকমতো মেরামত করা হয়নি। এ কারণেই মূলত যানজট ও ভোগান্তির সূত্রপাত।

সওজের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সম্প্রসারণকাজ চলার কারণে পুরো মহাসড়কেই যানবাহনের গতি কমেছে। তবে আশুগঞ্জ অংশে মহাসড়ক এতটাই বেহাল যে তা যান চলাচল একেবারে স্থবির করে দিয়েছে। ভারতীয় ঠিকাদার কাজ শুরুর পর থেকে ভোগান্তি চলছে। কারণ, তারা বিদ্যমান মহাসড়কটি ঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করেনি।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ধরখার থেকে আখাউড়া সীমান্ত পর্যন্ত অংশের প্রায় সাড়ে ১১ কিলোমিটার কাজে ভারতীয় ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ, ভারতের সঙ্গে এখন সীমান্ত বাণিজ্য সীমিত। তাই এটি অগ্রাধিকারে নেই। সরাইল থেকে ধরখার পর্যন্ত প্রায় ৩২ কিলোমিটার অংশও বেহাল। তবে এই অংশের কাজ অব্যাহত রাখা হবে।

আশুগঞ্জ থেকে সরাইল পর্যন্ত মহাসড়কের অংশ। এই অংশে আগে পরিকল্পনা ছিল মূল সড়কের পাশে স্থানীয় যানবাহন চলাচলের জন্য দুই পাশে সাড়ে তিন মিটার চওড়া সড়ক নির্মাণ করা হবে। পরে তা সম্প্রসারণ করে সাড়ে ৫ মিটার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর জন্য প্রায় ১৬৪ কোটি টাকা বাড়তি অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই অর্থ থেকে এখন সম্প্রসারণ ও বিদ্যমান সড়ক মেরামত করা হবে।

এদিকে সড়ক বিভাগের অস্থায়ী ভোগান্তিমূলক কাজের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবহন যাত্রী চালকরা।

স্থানীয় বাসিন্দা রুকন উদ্দিন লস্কর জানান, একজন রাষ্ট্রীয় অতিথি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করবেন, তার আগমনকে কেন্দ্র করে অস্থায়ীভাবে সড়কটি মেরামতে এমন আয়োজন দুঃখজনক। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রের অর্থ অপচয়ের একটি বিষয় জড়িত রয়েছে।

বাসচালক আলী আকবর জানান, ইউটার্নটি বন্ধ করার কারণে, মহাসড়কে যানজটের তীব্রতা আরও বেড়েছে। এভাবে অপরিকল্পিতভাবে কাজ করা ঠিক নয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক ও জনপদ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রোকন উদ্দিন খন্দকার জানান, অস্থায়ী কাজ কত মিটার করা হচ্ছে বা এর ব্যয় কত এই মুহূর্তে সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যয়ের বিষয়টি নির্ধারণ করা হবে।

এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া খাটিহাতা হাইওয়ে থানার ও জাহাঙ্গীর আলম জানান, যানজট নিরসনে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন, হাইওয়ে পুলিশ সদস্যরা। তবে সংস্কার কাজের জন্য ভোগান্তির মাত্রা আরও বেড়েছে। ভোগান্তি লাঘবে স্থায়ীভাবে কাজ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।