নিজস্ব প্রতিবেদক :
শুধু শেখ হাসিনা নয় বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার দোসরদের চিরতরে নিষিদ্ধ করতে হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) জুলাই আগস্টের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে ৪৭ তম সাক্ষী নাহিদ ইসলামের জেরা শেষ করে শেখ হাসিনার স্টেট ডিফেন্স। পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নে জবাবে এ কথা বলেন তিনি। এদিন ৪৭ নম্বর সাক্ষী হিসেবে তাকে জেরা করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন।
তিনি বলেন, এবার দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের সুযোগ এসেছে ট্রাইব্যুনালের সামনে। শুধু শেখ হাসিনা নয় বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার দোসরদের চিরতরে নিষিদ্ধ করতে হবে। এসময় দ্রুততম সময়ের মধ্যে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কে বিচারের আওতায় আনার দাবী করেন তিনি।
নাহিদ ইসলাম বলেন, নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। আওয়ামী লীগ ও ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচারের আওতায় এনে রাজনৈতিক ও আইনি সমাধান করতে হবে। কেননা এসব অপরাধ কোনো ব্যক্তিসংঘঠিত অপরাধ নয়।
তিনি বলেন, আমরা ট্র্যাইব্যুনালের কাছে আবেদন জানাবো। ট্র্যাইব্যুনালের কাছে এখন যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ এসেছে। শেখ হাসিনা যেহেতু দলীয় প্রধান ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে ক্ষমতায় টিকে থাকতে জনগণকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাই জনগণই প্রতিরোধ করে তাকে উৎখাত করেছে। ফলে রাজনৈতিকভাবে এটা আওয়ামী লীগের সংঘটিত অপরাধ। এজন্য দল হিসেবে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচারের আওতায় আনা উচিত। এছাড়া গত বছরের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ পৃথিবীর ইতিহাসে লেখা হয়ে থাকবে বলেও মন্তব্য করেন এই সাক্ষী।
এদিকে, জেরার সময় নাহিদকে প্রশ্ন করেন আমির হোসেন বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট আপনার ওপর চলা অত্যাচারের জন্য কেনো মামলা করেছেন কি-না।
জবাবে নাহিদ বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে যেসব অন্যায় হয়েছে, সেসব সমগ্র জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘঠিত অন্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। এসব অন্যায় শুধু ব্যক্তিগতভাবে আমার বিরুদ্ধে করা হয়েছিল বলে আমি মনে করিনি। সেজন্য ব্যক্তিগতভাবে কোনো মামলাও করিনি। তবে গুমের ঘটনায় গুম কমিশনে আলাদা অভিযোগ করেছি।
নাহিদ ইসলাম বলেন, এটা সত্য নয় যে ৩ আগস্ট সরকার পতনের এক দফা কর্মসূচি তাঁদের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার ফলশ্রুতি। এও সত্য নয় যে তাঁদের আন্দোলনের পেছনে দেশি-বিদেশি শক্তির হাত ছিল। দেশি-বিদেশি শক্তির ইন্ধন ছিল বিধায় তাঁরা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, এ কথাও সত্য নয়।
এ সময় প্রসিকিউশনের (রাষ্ট্রপক্ষ) পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়। প্রসিকিউশনের পক্ষে প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম বলেন, সরকার পরিবর্তনকে কোনো চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। তখন ট্রাইব্যুনাল বলেন, এর সঙ্গে এটা প্রাসঙ্গিক।
পরে জেরার জবাবে নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, ‘এটা সত্য নয় যে শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পদত্যাগ করেন নাই। এটাও সত্য নয় যে শেখ হাসিনা বাধ্য হয়ে ভারতে চলে যান নাই।’
এদিন বেলা ১১টার পর দ্বিতীয় দিনের মতো ট্রাইব্যুনালে নাহিদের জেরা শুরু হয়। দুপুর সাড়ে ১২টায় জেরা শেষে তিনি প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ ৪৭তম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেয়ার পর আজ নাহিদ ইসলামের জেরা শেষ হয়।
মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এস এইচ তামিম শুনানি করেন। সাথে অপর প্রসিকিউটররাও শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন।
এই মামলায় পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। এই মামলায় গ্রেফতার হয়ে পরে রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী জায়েদ বিন আমজাদ।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
একপর্যায়ে এই মামলায় দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদঘাটনে (অ্যাপ্রোভার) রাজসাক্ষী হতে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের আবেদন মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল। পরবর্তীতে এই মামলার ৩৬তম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন রাজসাক্ষী পুলিশের চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
এ মামলাটি ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরো দু’টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। অন্যটি রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার।
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকার, এর দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে বলে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে। দু’টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসব অপরাধের বিচার কাজ চলছে।