স্পোর্টস ডেস্ক :
শেষ ওভারের প্রথম বলটি যখন পুল করে বাউন্ডারিতে পাঠালেন জাকের আলি, উল্লাসে মেতে উঠলেন গ্যালারির বাংলাদেশ সমর্থকেরা। ডাগ আউটে থাকা ক্রিকেটাররাও লাফিয়ে উঠলেন খুশিতে। ম্যাচ তখন কার্যত শেষ, দুই দলের স্কোর সমান। কিন্তু শেষ হয়েও যেন হয় না শেষ! দাসুন শানাকার পরের তিন বলেই বিদায় দুই ব্যাটসম্যানের, রান নেই মাঝের বলেও! নন-স্ট্রাইকে থাকা শামীম হোসেন যেভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে ছুড়ে মারলেন ব্যাট, তাতেও শঙ্কা জাগল আরও। বাংলাদেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে না তো!
শেষ পর্যন্ত অবশ্য আর নাটকীয় কিছু হলো না। পঞ্চম বলে নাসুম আহমেদের ব্যাটে বল লাগতেই ছুটলেন দুই ব্যাটসম্যান। ফিল্ডার সরাসরি থ্রো লাগাতে পারলে বিপদ হতে পারত যদিও। তবে তখন আর সেসব ভাবে কে! জয়ের উচ্ছ্বাসই তখন সবচেয়ে বড় সত্যি।
শেষে এসে একটু গুলিয়ে ফেললেও ব্যাটে-বল দাপুটে পারফরম্যান্সে দারুণ জয়ের মঞ্চ আগেই সাজিয়ে রেখেছিল বাংলাদেশ। সেই পথ ধরেই শ্রীলঙ্কাকে চার উইকেটে হারিয়ে এশিয়া কাপের সুপার ফোর অভিযান শুরু করল লিটন কুমার দাসের দল।
দুর্দান্ত বোলিং পারফরম্যান্সে জয়ের ভিত গড়ে দেন মুস্তাফিজুর রহমান ও শেখ মেহেদি হাসান। রান তাড়ায় স্ট্রোকসমৃদ্ধ দুটি ফিফটি উপহার দিয়ে দলকে এগিয়ে নেন সাইফ হাসান ও তাওহিদ হৃদয়। বিফলে যায় দাসুন শানাকার অলরাউন্ড পারফরম্যান্স।
দুবাইয়ে শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) ছয়টি ছক্কায় শানাকার ৩৭ বলে ৬৪ রানের ইনিংসে শ্রীলঙ্কা ২০ ওভারে তোলে ১৬৮ রান। পরে বল হাতে শেষ ওভারে দুটি উইকেট নেন শানাকা। তবে বাংলাদেশ জিতে যায় ১ বল বাকি রেখে। অসাধারণ বোলিংয়ে চার ওভারেরে স্রেফ ২০ রান দিয়ে তিনটি উইকেট নেন মুস্তাফিজ। ২৫ রান দিয়ে দুটি নেন মেহেদি।
রান তাড়ায় ওপেনিংয়ে চার ছক্কায় ৪৫ বলে ৬১ রানের ইনিংস খেলেন সাইফ। তার টি-টোয়েন্টি ব্যাটিংয়ের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল অনেক। এই ম্যাচে দেখিয়ে দিলেন, তিনিও পারেন! মায়ের দেশের বিপক্ষে ম্যাচ-সেরা তিনিই।
যার ফর্ম নিয়ে প্রশ্ন ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই, সেই হৃদয়ও জ্বলে উঠে উপহার দেন ৩৭ বলে ৫৮ রানের ইনিংস।
দলের দারুণ জয়ের দিনে দুটি মাইলফলকের দেখাও পেয়েছেন দুজন। ১৪৯ উইকেট নিয়ে সাকিব আল হাসানের সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি এখন মুস্তাফিজ। রানের তালিকায় সাকিবকে (২৫৫১) ছাড়িয়ে এখন সবার ওপরে লিটন (২৫৫৬)।
টস হেরে ব্যাটিংয়ে নামা শ্রীলঙ্কার শুরুটা করে দারুণ। বাঁহাতি পেসের সামনে লঙ্কান ব্যাটসম্যানদের দুর্বলতার কারণে যাকে একাদশে এনেছিল বাংলাদেশ, সেই শরিফুল ইসলামের ওপরই ঝড় বইয়ে দেন কুসাল মেন্ডিস ও পাথুম নিসাঙ্কা। তার প্রথম ওভারে ফ্লিক করে ছক্কা মারেন মেন্ডিস, পরের ওভারে টানা তিনটি চার মারেন নিসাঙ্কা। মেন্ডিসের ব্যাটে চার ও ছক্কা হজম করলেও নাসুম আহমেদ প্রথম দুই ওভারে রান দেন ১৩।
পঞ্চম ওভারে আক্রমণে আসা তাসকিনকে ছক্কায় স্বাগত জানান নিসাঙ্কা। তবে ওভারের শেষ বলে তাকে ফিরিয়েই হুঙ্কার ছুড়েন অভিজ্ঞ পেসার। টুর্নামেন্টের সফলতম ব্যাটসম্যান ফেরেন ১৫ বলে ২২ রান করে।
পাঁচ ওভারে ৪৪ রান তোলা শ্রীলঙ্কাকে এরপর চেপে ধরে বাংলাদেশ। শেখ মেহেদি হাসানকে ছক্কায় দলের পঞ্চাশ পূর্ণ করেন মেন্ডিস। পরের ওভারে তাকে (২৫ বলে ৩৪) ফিরিয়ে শোধ তোলেন অফ স্পিনার।
পাওয়ার প্লে শেষে টানা তিন ওভারে আসেনি বাউন্ডারি। কামিল মিশারা (১১ বলে ৫) কেনো উপায় না পেয়ে মেহেদিকে রিভার্স ল্যাপ খেলার চেষ্টায় বোল্ড হয়ে যান। অভিজ্ঞ কুসাল পেরেরা ১৬ বল খেলে করতে পারেন ১৬।
বাঁহাতি ব্যাটসম্যানে ঠাসা ব্যাটিং লাইন আপে মেহেদির অফ স্পিন সামাল দিতেই মূলত পাঁচে নামানো হয় দাসুন শানাকাকে। প্রথম বলেই বাউন্ডারি দিয়ে শুরু করেন তিনি, একটু পরই শরিফুলকে গ্যালারিতে আছড়ে ফেলে ঝড়ের বার্তা ছড়িয়ে দেন। নাসুমের শেষ ওভারে একটি চারের পর ছক্কা মারেন দুটি, এর একটি ১০১ মিটার লম্বা!
তার সঙ্গে চারিথ আসালাঙ্কার জুটিতেই মূলত গতি পায় লঙ্কান ইনিংস। সাবেক ও বর্তমান অধিনায়কের জুটিতে ৫৭ রান আসে ২৭ বলেই। শ্রীলঙ্কার রান এক পর্যায়ে ১৭৫ ছাড়িয়ে যাবে বলেই মনে হচ্ছিল। তবে ম্যাচজুড়ে দুর্দান্ত বোলিং করা মুস্তাফিজ শেষেও রাশ টেনে ধরেন। তার শেষ দুই ওভার থেকে রান ওঠে মাত্র ১১।
এর মধ্যেই ৩৮ রানে শানাকার কঠিন একটি ক্যাচ নিতে পারেননি শামীম হোসেন। আসালাঙ্কার ক্যাচ দুই দফায় ফেলেন তাওহিদ হৃদয়। এর দ্বিতীয়টিতে অবশ্য তার দারুণ থ্রোয়ে রান আউট হয়ে ফেরেন লঙ্কান দলপতি (১২ বলে ২১)।
আরেক প্রান্তে শরিফুলের শেষ দুটি ডেলিভারি ছক্কায় উড়িয়ে দেন শানাকা। শেষ ওভারের প্রথম বলে তাসকিনকে চার মারলেও পরের টানা চার ডেলিভারি তিনি ব্যাটেই লাগাতে পারেননি। তবে শেষ ডেলিভারি আবার পাঠিয়ে দেন গ্যালারিতে। টি-টোয়েন্টিতে তার সবশেষ ফিফটি ছিল ২১ ইনিংস আগে, সেই ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে।
রান তাড়ায় প্রথম ওভারেই ধাক্কা খায় বাংলাদেশ। নুয়ান থুসারাকে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে খেলে বোল্ড হন তানজিদ হাসান। এই সংস্করণে ছয় ম্যাচে চারবার এই স্লিঙ্গিং পেসারের কাছে উইকেট হারালেন বাঁহাতি ওপেনার, এর তিনবারই বোল্ড।
ম্যাচের প্রথম বাউন্ডারি আসে লিটনের ব্যাট থেকে। তবে এরপরই পাল্টা আক্রমণে চমকে দেন সাইফ। বাংলাদেশেক নানা সময়ে ভোগানো থুসারাকে একটি ছক্কা মারেন তিনি ডাউন দা উইকেটে, আরেকটি চোখধাঁধানো ফ্লিক শটে। দুনিথ ওয়েলালাগেকে উড়িয়ে দেন মাথার ওপর দিয়ে।
সাইফকে দারুণ সঙ্গ দেন লিটন দাস। দুজনের জুটির ফিফটি আসে ২৮ বলেই। পাওয়ার প্লেতে বাংলাদেশ তোলে ৫৯ রান। এরপরই ‘ট্রাম্প কার্ড’ ব্যবহার করে শ্রীলঙ্কা। তাতে কাজও হয়। ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গার প্রথম ওভারেই সুইপ খেলে সীমানায় ধরা পড়েন লিটন (১৬ বলে ২৩)।
তবে হাসারাঙ্গা একাই তো আর সব করে ফেলতে পারবেন না! অন্য বোলারদের কাজে লাগিয়ে আরেকটি অর্ধশত রানের জুটি গড়ে তোলেন সাইফ ও হৃদয়। সাইফ ফিফটি পূরণ করেন ৩৬ বল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার আগের ফিফটি ছিল এশিয়ান গেমসে মালেয়েশিয়ার বিপক্ষে ৫২ বলে ৫০। হাসারাঙ্গাকে স্লগ খেলতে গিয়ে শেষ হয় সাইফের ইনিংস।
তবে ওয়ালালাগের বল গ্যালারির দোতলায় পাঠিয়ে ততক্ষণে জেগে উঠেছেন হৃদয়। এরপর সামনে যখন পেলেন অনিয়মিত স্পিনার কামিন্দু মেন্ডিসকে, নিজের করণীয় বুঝে নিলেন দ্রুতই। দুটি চার ও একটি ছক্কায় ওভার থেকে নিলেন ১৬ রান। বাংলাদেশের অনায়াস জয় তখন সময়ের ব্যাপার। ১৯তম ওভারে চামিরার একটি ফুল টসে এলবিডব্লিউ হয়ে যান হৃদয়। নিজের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে মাঠ ছাড়েন তিনি।
জাকের আলি ক্রিজে গিয়ে প্রথম বলটিই পাঠিয়ে দেন বাউন্ডারিতে। শেষ ওভারে প্রয়োজন পড়ে পাঁচ রানের। সেখানেও প্রথম বলে জাকেরের চার। এরপরই একটু বিপত্তি।
শানাকার স্লোয়ার হাঁকাতে গিয়ে বোল্ড হয়ে যান জাকের। পরের বলে রান নিতে পারেননি নতুন ব্যাটসম্যান শেখ মেহেদি। চতুর্থ বলে তিনি আউট হয়ে যান শর্ট ডেলিভারিতে। এরপর আর ভুল হয়নি কোনো। গ্রুপ পর্বে যে দলের কাছে হেরেছিল বাংলাদেশ, তাদেরকে হারিয়েই শুরু হলো সুপার ফোর যাত্রা।