Dhaka রবিবার, ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

৭১’র মুক্তিযোদ্ধাদের মতোই ২৪’র বীর শহিদদেরও জাতি ভুলবে না : তারেক রহমান

নিজস্ব প্রতিবেদক : 

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে বলে মন্তব্য করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, যেভাবে জাতি ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধাদের ভুলে যায়নি, ঠিক একইভাবে ২৪’র বীর শহিদদেরও কখনো ভুলবে না।

মঙ্গলবার (১ জুলাই) সন্ধ্যায় বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে দলের ৩৬ দিনব্যাপী কর্মসূচির উদ্বোধনকালে তিনি এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, একটি সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। জনগণের সরাসরি ভোটে জবাবদিহিমূলক ইনসাফভিত্তিক, গণতান্ত্রিক ও মানবিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার এখনই সময়।

তারেক রহমান বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট পলায়নের পরই আমার প্রথম বক্তব্যে বলেছিলাম- তার মধ্যে ছিল- গণঅভ্যুত্থানে যারা তাদের সন্তান হারিয়েছেন সেই মায়েদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। অনেকেই প্রিয়তম স্বামী ও প্রিয়তম ভাইকে হারিয়েছেন। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে ৫ আগস্ট আরেকটি বিজয় দেখেছে বাংলাদেশ। একজন শহীদ শুধু আপনাদের স্বজন নয়, তারা দেশের গৌরব ও মুক্তিকামী জনতার। তাদের জানাই শ্রদ্ধা।

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের মুক্তিযোদ্ধাদের যেমন মানুষ ভোলেনি। তেমনই চব্বিশের যোদ্ধাদেরও জাতি ভুলবে না। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে বিভিন্ন স্থাপনা শহীদদের নামে নামকরণের চিন্তা আমাদের আছে। দেশ ও জনগণের স্বার্থে যারা আত্মত্যাগ করেছেন তাদের জন্য কিছু ভাবনা তুলে ধরছি। আমরা দেশকে একটি চিরস্থায়ী ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চাই, যেখানে জনগণের হাতে থাকবে সব ক্ষমতা। তবেই রাজনৈতিক দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন কমে আসবে বলে বিশ্বাস করি।

তারেক রহমান বলেন, দেড় দশকের আন্দোলনে গুম-খুনের শিকার হয়েছেন বহু মানুষ। অপহরণের তালিকা অনেক দীর্ঘ। শুধু জুলাই আন্দোলনে বিএনপির ৪২২ জনসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অন্তত দেড় হাজার মানুষ শহীদ হয়েছেন। ৩০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। এক হাজারের বেশি পঙ্গু হয়েছেন। শিশু-বাচ্চারও শহীদ হওয়া থেকে বাদ যায়নি। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায় এভাবে শহীদ আবু সাঈদ, ওয়াসিম ও মুগ্ধর মতো অনেকেই জীবন দিয়েছেন। মানুষের প্রশ্ন যে- এভাবেই কি মানুষ জীবন দিতে থাকবে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, একটি দেশের জন্য ৫৪ বছর কম সময় নয়। এই সময়ে মানুষের ত্যাগ আমরা ভুলে যেতে চাই না। বরং যারা দেশ ও জনগণের কল্যাণে রাজনীতি করি তাদের অঙ্গীকার হলো- নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও সুশৃঙ্খল রাজনীতি, ওয়াদা পূরণের রাজনীতি। এ সময় ভবিষ্যতে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সমন্বয় রেখে দেশ গঠনের কিছু পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন তারেক রহমান। রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা স্মরণ করিয়ে তিনি বলেন, দেশ পরিচালনার সুযোগ পেলে আমরা জাতীয় সরকার গঠন করে কাজ করব। জাতীয় স্বার্থে আমরা সবাই এক। জাতীয় ঐক্যে সব দলের এক হওয়া জরুরি নয়। তাঁবেদার অপশক্তি যাতে মাথাচড়া দিতে না পারে সেদিকে জাতীয় ঐক্য অটুট রয়েছে এবং থাকবে ইনশাআল্লাহ।

বিএনপি ক্ষমতায় এলে শহীদদের স্মরণে বিভিন্ন স্থাপনা-সড়কের নামকরণ করবে জানিয়ে তিনি বলেন, জনগণের রায়ে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতা পেলে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থাপনা, সড়ক কিংবা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নামকরণের ইচ্ছে আমাদের আছে।

এসময় শহীদের চেতনায় দেশকে উপলব্ধি করতে সবার প্রতি আহ্বান জানান তারেক রহমান।

বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘দীর্ঘ ১৬ বছর নির্মম অত্যাচার-নির্যাতন, গ্রেফতার, গুম-খুন করে, গণতন্ত্রকে হত্যা করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থাকে চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ শাসকগোষ্ঠী। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে।’

যেকোনো মূল্যে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যেকোনো মূল্যে এই রক্তস্রোত, মায়ের অশ্রুধারা যেন বৃথা না যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। ঐক্য বজায় রাখতে হবে।

খালেদা জিয়া বলেন, দীর্ঘ ১৬ বছর নির্মম অত্যাচার-নির্যাতন, গ্রেফতার, গুম-খুন করে, গণতন্ত্রকে হত্যা করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থাকে চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ শাসকগোষ্ঠী। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। নতুন করে বাংলাদেশকে গড়ার নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা। তাদের এই আত্মত্যাগ জাতি চিরকাল মনে রাখবে।

তিনি বলেন, গুম, খুন, বিচারবিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের যারা শিকার হয়েছেন তাদের তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার নতুন যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তা আমাদের দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে হবে।

এসময় সবাইকে বাংলাদেশ নির্মাণের শহীদ জিয়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়নের আহ্বান জানান বিএনপি চেয়ারপারসন।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘ঐক্যের প্রশ্নে আমাদের কোনো আপস নেই। গণতন্ত্রের প্রশ্নে আমাদের কোনো আপস নেই। পরিষ্কার করে বলতে চাই, আমরা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পরিবর্তনটা চাই।’

মির্জা ফখরুল বলেন, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে আমরা কখনো আপস করিনি, কোনোদিন করবো না। আমাদের দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আমাদেরকে সেই পথে শিখেছেন, আমাদের নেতা দেশের শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আমাদেরকে সেই পথ দেখিয়েছেন। আর এখন আমাদের তরুণ নেতা জনাব তারেক রহমান দীর্ঘ আট-নয় বছর ধরে আমাদেরকে সেই পথে এগিয়ে নিয়ে এসছেন। যেখান থেকে আমরা আরো শক্তিশাল হয়েছি, আরো আমাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে।

তিনি বলেন, গত ১৬ বছর আমাদের অসংখ্য লোক মারা গেছে, জামায়াতে ইসলামীর অসংখ্য মারা গেছে এবং অন্য রাজনৈতিক দলেরও নেতাকর্মী মারা গেছে। এ সময়ে আমাদের অনেক পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে, আমাদের অনেক সন্তান তার বাবাকে হারিয়েছে। আমাদের অনেক স্ত্রী তার স্বামীকে হারিয়েছে। আমাদের অনেক মা তার প্রিয় সন্তানকে হারিয়েছে। আমরা আজকে তাদের কিছু ছেলে মেয়েদেরকে মায়ের ডাক ও অন্যান্য সংগঠনের মাধ্যমে এখানে দেখতে পেয়েছি। আমরা দেখতে পেয়েছি, আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট সরকারের বাহিনী আমাদের ছোট ছোট শিশুসন্তান থেকে শুরু করে আমাদের ছাত্রদেরকে, আমাদের সন্তানদেরকে করে হত্যা করেছে পাখির মতো।

তিনি আরো বলেন, দেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে আমাদের এই ১৬ বছরে। দেশটাকে একটা ফোকলা রাষ্ট্রে পরিণত করে দেয়া হয়েছে। সমস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়েছে। অর্থনীতিকে ধ্বংস করা হয়েছে। ভবিষ্যতকে ধ্বংস করা হয়েছে। নৈতিকতাকে ধ্বংস করা হয়েছে। এবং ভবিষ্যতের একটা ঋণের দেশ এমনভাবে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে যা পরবর্তী সরকারগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ফ্যাসিস্ট পালিয়ে যাওয়ায় একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, সেই সুযোগটা কি? একটা নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ তৈরি করবার। আমি জোর দিয়ে চাই, একটা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে। আমরা পরিবর্তনে বিশ্বাস করি বলেই ২৭ দফা রাষ্ট্র সংস্কারের কর্মসূচি নিয়েছিলাম ২২ সালে, তারও আগে ১৬ সালে ভিশন ২০৩০ দিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া।

‘রিফর্ম বা সংস্কারের কথা তো আমরা বলেছি আগে। এখন অত্যন্ত সুচতুরভাবে একটা প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে যে, বিএনপি সংস্কার মানছে না। আর মানছে না বলেই দেরি হচ্ছে। এটা নিয়ে মিডিয়া ও সামাজিক মিডিয়াতে ক্যাম্পেইন হচ্ছে, যে বিএনপি সংস্কার মানছে না,’ বলেন তিনি।

তিনি বলেন, আমরা একমত হয়েছি একজনের ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকা যাবে। আমরা বলেছি যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট, আমরা বলেছি যে আমরা রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হবে। আমরা বলেছি বিচার ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে একেবারে ইন্ডিপেন্ডেন্ট করতে হবে। আমরা বলেছি যে সংস্কার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়ে আসতে হবে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংস্কার নিয়ে আসতে হবে।

মির্জা ফখরুল বলেন, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করব বলেই তো জনগণের কাছে চলে গেছি সমাবেশ নিয়ে, চ্যালেঞ্জ করব বলেই তো নদী পার হয়ে সরকারের পতন চেয়েছি। ’২২ সালে মিরপুরের একজন ওয়ার্কার মকবুলকে পার্টি অফিসের সামনে গুলি হত্যা করেছে আমার মুখের সামনে। আমি যখন তাকে মর্গে দেখতে চাই, তখন দেখি তার স্ত্রী পরনে একটা ছিড়া শাড়ি।

মির্জা ফখরুল বলেন, বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে একটা অভূতপূর্ব একটি সম্ভাবনার সুযোগ আজকে সৃষ্টি হয়েছে। তাদের রক্তফোঁটা যেন কখনো ব্যর্থ না হয়। আসুন, আজকে আমরা সবাই শপথ গ্রহণ করি।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রুহুল কবির রিজভী এবং সঞ্চালনায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, জাতীয় পার্টি (জাফর) এর মোস্তফা জামাল হায়দার, জামায়াতে ইসলামীর মাওলানা আব্দুল হালিম, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকী, এনডিএমের ববি হাজ্জাজসহ ১২ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ।

অনুষ্ঠানে শহীদ পরিবার ও আহতদের সম্মাননা দেয়া হয় এবং অভ্যুত্থান বিষয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা, পেশাজীবী, বিশিষ্টজন, সাংবাদিক ও সারাদেশ থেকে আগত কয়েক হাজার কর্মী-সমর্থক।

 

 

জনপ্রিয় খবর

আবহাওয়া

৭১’র মুক্তিযোদ্ধাদের মতোই ২৪’র বীর শহিদদেরও জাতি ভুলবে না : তারেক রহমান

প্রকাশের সময় : ০৯:৩৭:৩১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক : 

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে বলে মন্তব্য করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, যেভাবে জাতি ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধাদের ভুলে যায়নি, ঠিক একইভাবে ২৪’র বীর শহিদদেরও কখনো ভুলবে না।

মঙ্গলবার (১ জুলাই) সন্ধ্যায় বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে দলের ৩৬ দিনব্যাপী কর্মসূচির উদ্বোধনকালে তিনি এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, একটি সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। জনগণের সরাসরি ভোটে জবাবদিহিমূলক ইনসাফভিত্তিক, গণতান্ত্রিক ও মানবিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার এখনই সময়।

তারেক রহমান বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট পলায়নের পরই আমার প্রথম বক্তব্যে বলেছিলাম- তার মধ্যে ছিল- গণঅভ্যুত্থানে যারা তাদের সন্তান হারিয়েছেন সেই মায়েদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। অনেকেই প্রিয়তম স্বামী ও প্রিয়তম ভাইকে হারিয়েছেন। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে ৫ আগস্ট আরেকটি বিজয় দেখেছে বাংলাদেশ। একজন শহীদ শুধু আপনাদের স্বজন নয়, তারা দেশের গৌরব ও মুক্তিকামী জনতার। তাদের জানাই শ্রদ্ধা।

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের মুক্তিযোদ্ধাদের যেমন মানুষ ভোলেনি। তেমনই চব্বিশের যোদ্ধাদেরও জাতি ভুলবে না। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে বিভিন্ন স্থাপনা শহীদদের নামে নামকরণের চিন্তা আমাদের আছে। দেশ ও জনগণের স্বার্থে যারা আত্মত্যাগ করেছেন তাদের জন্য কিছু ভাবনা তুলে ধরছি। আমরা দেশকে একটি চিরস্থায়ী ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চাই, যেখানে জনগণের হাতে থাকবে সব ক্ষমতা। তবেই রাজনৈতিক দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন কমে আসবে বলে বিশ্বাস করি।

তারেক রহমান বলেন, দেড় দশকের আন্দোলনে গুম-খুনের শিকার হয়েছেন বহু মানুষ। অপহরণের তালিকা অনেক দীর্ঘ। শুধু জুলাই আন্দোলনে বিএনপির ৪২২ জনসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অন্তত দেড় হাজার মানুষ শহীদ হয়েছেন। ৩০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। এক হাজারের বেশি পঙ্গু হয়েছেন। শিশু-বাচ্চারও শহীদ হওয়া থেকে বাদ যায়নি। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায় এভাবে শহীদ আবু সাঈদ, ওয়াসিম ও মুগ্ধর মতো অনেকেই জীবন দিয়েছেন। মানুষের প্রশ্ন যে- এভাবেই কি মানুষ জীবন দিতে থাকবে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, একটি দেশের জন্য ৫৪ বছর কম সময় নয়। এই সময়ে মানুষের ত্যাগ আমরা ভুলে যেতে চাই না। বরং যারা দেশ ও জনগণের কল্যাণে রাজনীতি করি তাদের অঙ্গীকার হলো- নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও সুশৃঙ্খল রাজনীতি, ওয়াদা পূরণের রাজনীতি। এ সময় ভবিষ্যতে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সমন্বয় রেখে দেশ গঠনের কিছু পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন তারেক রহমান। রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা স্মরণ করিয়ে তিনি বলেন, দেশ পরিচালনার সুযোগ পেলে আমরা জাতীয় সরকার গঠন করে কাজ করব। জাতীয় স্বার্থে আমরা সবাই এক। জাতীয় ঐক্যে সব দলের এক হওয়া জরুরি নয়। তাঁবেদার অপশক্তি যাতে মাথাচড়া দিতে না পারে সেদিকে জাতীয় ঐক্য অটুট রয়েছে এবং থাকবে ইনশাআল্লাহ।

বিএনপি ক্ষমতায় এলে শহীদদের স্মরণে বিভিন্ন স্থাপনা-সড়কের নামকরণ করবে জানিয়ে তিনি বলেন, জনগণের রায়ে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতা পেলে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থাপনা, সড়ক কিংবা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নামকরণের ইচ্ছে আমাদের আছে।

এসময় শহীদের চেতনায় দেশকে উপলব্ধি করতে সবার প্রতি আহ্বান জানান তারেক রহমান।

বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘দীর্ঘ ১৬ বছর নির্মম অত্যাচার-নির্যাতন, গ্রেফতার, গুম-খুন করে, গণতন্ত্রকে হত্যা করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থাকে চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ শাসকগোষ্ঠী। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে।’

যেকোনো মূল্যে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যেকোনো মূল্যে এই রক্তস্রোত, মায়ের অশ্রুধারা যেন বৃথা না যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। ঐক্য বজায় রাখতে হবে।

খালেদা জিয়া বলেন, দীর্ঘ ১৬ বছর নির্মম অত্যাচার-নির্যাতন, গ্রেফতার, গুম-খুন করে, গণতন্ত্রকে হত্যা করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থাকে চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ শাসকগোষ্ঠী। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। নতুন করে বাংলাদেশকে গড়ার নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা। তাদের এই আত্মত্যাগ জাতি চিরকাল মনে রাখবে।

তিনি বলেন, গুম, খুন, বিচারবিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের যারা শিকার হয়েছেন তাদের তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার নতুন যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তা আমাদের দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে হবে।

এসময় সবাইকে বাংলাদেশ নির্মাণের শহীদ জিয়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়নের আহ্বান জানান বিএনপি চেয়ারপারসন।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘ঐক্যের প্রশ্নে আমাদের কোনো আপস নেই। গণতন্ত্রের প্রশ্নে আমাদের কোনো আপস নেই। পরিষ্কার করে বলতে চাই, আমরা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পরিবর্তনটা চাই।’

মির্জা ফখরুল বলেন, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে আমরা কখনো আপস করিনি, কোনোদিন করবো না। আমাদের দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আমাদেরকে সেই পথে শিখেছেন, আমাদের নেতা দেশের শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আমাদেরকে সেই পথ দেখিয়েছেন। আর এখন আমাদের তরুণ নেতা জনাব তারেক রহমান দীর্ঘ আট-নয় বছর ধরে আমাদেরকে সেই পথে এগিয়ে নিয়ে এসছেন। যেখান থেকে আমরা আরো শক্তিশাল হয়েছি, আরো আমাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে।

তিনি বলেন, গত ১৬ বছর আমাদের অসংখ্য লোক মারা গেছে, জামায়াতে ইসলামীর অসংখ্য মারা গেছে এবং অন্য রাজনৈতিক দলেরও নেতাকর্মী মারা গেছে। এ সময়ে আমাদের অনেক পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে, আমাদের অনেক সন্তান তার বাবাকে হারিয়েছে। আমাদের অনেক স্ত্রী তার স্বামীকে হারিয়েছে। আমাদের অনেক মা তার প্রিয় সন্তানকে হারিয়েছে। আমরা আজকে তাদের কিছু ছেলে মেয়েদেরকে মায়ের ডাক ও অন্যান্য সংগঠনের মাধ্যমে এখানে দেখতে পেয়েছি। আমরা দেখতে পেয়েছি, আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট সরকারের বাহিনী আমাদের ছোট ছোট শিশুসন্তান থেকে শুরু করে আমাদের ছাত্রদেরকে, আমাদের সন্তানদেরকে করে হত্যা করেছে পাখির মতো।

তিনি আরো বলেন, দেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে আমাদের এই ১৬ বছরে। দেশটাকে একটা ফোকলা রাষ্ট্রে পরিণত করে দেয়া হয়েছে। সমস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়েছে। অর্থনীতিকে ধ্বংস করা হয়েছে। ভবিষ্যতকে ধ্বংস করা হয়েছে। নৈতিকতাকে ধ্বংস করা হয়েছে। এবং ভবিষ্যতের একটা ঋণের দেশ এমনভাবে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে যা পরবর্তী সরকারগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ফ্যাসিস্ট পালিয়ে যাওয়ায় একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, সেই সুযোগটা কি? একটা নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ তৈরি করবার। আমি জোর দিয়ে চাই, একটা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে। আমরা পরিবর্তনে বিশ্বাস করি বলেই ২৭ দফা রাষ্ট্র সংস্কারের কর্মসূচি নিয়েছিলাম ২২ সালে, তারও আগে ১৬ সালে ভিশন ২০৩০ দিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া।

‘রিফর্ম বা সংস্কারের কথা তো আমরা বলেছি আগে। এখন অত্যন্ত সুচতুরভাবে একটা প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে যে, বিএনপি সংস্কার মানছে না। আর মানছে না বলেই দেরি হচ্ছে। এটা নিয়ে মিডিয়া ও সামাজিক মিডিয়াতে ক্যাম্পেইন হচ্ছে, যে বিএনপি সংস্কার মানছে না,’ বলেন তিনি।

তিনি বলেন, আমরা একমত হয়েছি একজনের ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকা যাবে। আমরা বলেছি যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট, আমরা বলেছি যে আমরা রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হবে। আমরা বলেছি বিচার ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে একেবারে ইন্ডিপেন্ডেন্ট করতে হবে। আমরা বলেছি যে সংস্কার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়ে আসতে হবে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংস্কার নিয়ে আসতে হবে।

মির্জা ফখরুল বলেন, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করব বলেই তো জনগণের কাছে চলে গেছি সমাবেশ নিয়ে, চ্যালেঞ্জ করব বলেই তো নদী পার হয়ে সরকারের পতন চেয়েছি। ’২২ সালে মিরপুরের একজন ওয়ার্কার মকবুলকে পার্টি অফিসের সামনে গুলি হত্যা করেছে আমার মুখের সামনে। আমি যখন তাকে মর্গে দেখতে চাই, তখন দেখি তার স্ত্রী পরনে একটা ছিড়া শাড়ি।

মির্জা ফখরুল বলেন, বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে একটা অভূতপূর্ব একটি সম্ভাবনার সুযোগ আজকে সৃষ্টি হয়েছে। তাদের রক্তফোঁটা যেন কখনো ব্যর্থ না হয়। আসুন, আজকে আমরা সবাই শপথ গ্রহণ করি।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রুহুল কবির রিজভী এবং সঞ্চালনায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, জাতীয় পার্টি (জাফর) এর মোস্তফা জামাল হায়দার, জামায়াতে ইসলামীর মাওলানা আব্দুল হালিম, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকী, এনডিএমের ববি হাজ্জাজসহ ১২ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ।

অনুষ্ঠানে শহীদ পরিবার ও আহতদের সম্মাননা দেয়া হয় এবং অভ্যুত্থান বিষয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা, পেশাজীবী, বিশিষ্টজন, সাংবাদিক ও সারাদেশ থেকে আগত কয়েক হাজার কর্মী-সমর্থক।