নিজস্ব প্রতিবেদক :
বিশ্বকে বদলে দেওয়ার মতো দুর্দান্ত সব আইডিয়া বাংলাদেশের কাছে আছে বলে জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশে ব্যবসার ভালো সুযোগ রয়েছে। এ ব্যবসা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, সারা পৃথিবীর জন্য সুযোগ তৈরি করতে পারে।
বুধবার (৯ এপ্রিল) রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন-২০২৫ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, একসময় ক্ষুদ্রঋণ বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র গ্রামে শুরু হলেও এখন এটি আমেরিকার সবচেয়ে বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।
বক্তব্যের একপর্যায়ে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন প্রধান উপদেষ্টা। কয়েক সেকেন্ডের জন্য তার কণ্ঠ রোধ হয়ে যায়।
দুনিয়া বদলাতে চাইলে ব্যবসা সবচেয়ে শক্তিশালী কাঠামো বলে মন্তব্য করে ড. ইউনূস বলেন, সবাই মিলে উপার্জন করে মানুষের ভাগ্য বদল করাটা স্বর্গীয় অনুভূতি। কার্বন নিঃসরণ বাদ দিয়ে আমরা নতুন সভ্যতা গড়তে পারি। বর্তমান সভ্যতা আত্মবিধ্বংসী।
তিনি বলেন, তরুণ প্রজন্ম সম্মিলিতভাবে পৃথিবীকে বদলে দেবে। তারা সরকারের অপেক্ষায় বসে থাকবে না। সেই নতুন বিশ্ব গড়তে এখন থেকেই উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশে ব্যবসা করা শুধু এ দেশেই বিনিয়োগ নয়, বরং এর অর্থ বিশ্বব্যাপী সামাজিক ব্যবসার অংশ হওয়া।
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নতির ফ্রেমওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমেই সম্ভব দারিদ্র্য বিমোচন। আর সামাজিক ব্যবসার আদর্শ স্থান বাংলাদেশ।
প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের বিবরণ তুলে ধরে বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে বলেন, আপনি যে দেশেই বসবাস করেন না কেন, আপনার ভেতর ছোট একটি ১৯৭৪ বসবাস করে। আপনারা সেটা (অভাব) দেখতে চান না, লুকিয়ে রাখেন মানুষকে অর্থ সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে। আমি সবসময় বলে আসছি, জনগণের অর্থ গরীব মানুষকে দেওয়ার মধ্যে কোনও সমাধান নেই। সমাধান আছে অবকাঠামো তৈরির মাধ্যমে, মানুষের শক্তিকে বের করে নিয়ে আসার মধ্যে। ক্ষুদ্র ঋণ একটি সামান্য উদ্যোগ। একটা উন্মত্ত পরিকল্পনা তৈরি করা হলো সরকারের টেলিফোনের লাইসেন্স ইস্যু করার মাধ্যমে। আমাদের টেলিফোনের প্রয়োজন ছিল না। বেশিরভাগই কাজ করে না। টেলিফোন কোম্পানির জন্য লাইসেন্স লাগবে কেন তাহলে? সরকার জিজ্ঞেস করে টেলিফোন কোম্পানি দিয়ে কী করবেন। আমি বললাম যে গরীব নারীদেরকে দিবো। আমরা লাইসেন্স পেলাম। গ্রামীণ ব্যাংকের পর গ্রামীণফোন প্রতিষ্ঠিত হলো।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমাদের জ্ঞান না থাকায় কেউ অংশীদার হতে চাইতো না। কারণ বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের কোনও জায়গা ছিল না, কোনও বাজার ছিল না। তাই আমরা অনেক আন্তর্জাতিক দুয়ারে ঠকঠক করলাম। কেউ সাড়া দিল না। অবশেষে আমি ব্যক্তিগতভাবে নরওয়ের একজনকে চিনতাম যিনি টেলিনরের চেয়ারম্যান ছিলেন। আমি তাকে বোঝালাম এবং সাহায্য চাইলাম। আমি বোঝালাম যে কেন বাজারে মোবাইল ফোন আনতে চাই এবং নারীদের দিতে চাই। উনি গুরুত্ব সহকারে নিলেন কিন্তু তার কোম্পানির বোর্ড তার সঙ্গে রাজি হলো না। তারা বাংলাদেশকে কোনোভাবেই চিনতে পারলো না, নাম কখন শুনেনি নাকি। যতবারই টেলিনরের বোর্ড প্রত্যাখ্যান করে তিনি বারবার সেটা নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করেন। অবশেষে তিনি রাজি করাতে পারেন। তখনকার সমীক্ষা বলে, ২ লাখ মোবাইল গ্রাহক পাওয়া যাবে। আমি বললাম— কী বলেন! এর চেয়ে ১০ গুণ পাওয়া যাবে। এটি এখন দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল ফোন কোম্পানি।
শুরুর দিকে শুধু গ্রামীণ ব্যাংকের গরীব নারীরা ফোন নিতে পারতো উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ফোন কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তারা জানতো না। আমরা প্রশিক্ষণ দিলাম। শিগগিরই লাখ খানেক নারী সারা দেশে ফোন সেবা দেওয়া শুরু করলো। এটি এতটাই জনপ্রিয় হলো যে সবাই ফোন নেওয়া শুরু করলো। পুরো কোম্পানির সার্বিক চিত্র পাল্টে দিলো। ঠিক তখন অন্যান্য দেশে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো ব্যবসা সম্প্রসারণ শুরু করলো, তাদের ফোকাস ছিল শহরগুলো। সংবাদপত্রে আমাদের খবর তুলে ধরা হলো, তাদের না। তখন থেকেই বিশ্ব জানল গ্রামে কীভাবে মোবাইল ফোন গেলো। টেলিফোন শিল্প বৈশ্বিকভাবে পাল্টে গেলো। এগুলো বলার কারণ হচ্ছে— পৃথিবীকে বদলাতে উন্মত্ত বুদ্ধিতে বাংলাদেশ ভরপুর।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের (বিডা) আয়োজনে চার দিনব্যাপী এ বিনিয়োগ সম্মেলন গত ৭ এপ্রিল শুরু হলেও আজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন ঘোষণা করেন ড. ইউনূস।
এদিন বিনিয়োগে অবদান রাখার জন্য চার ক্যাটাগরিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কার তুলে দেন তিনি। পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ওয়ালটন (দেশি বিনিয়োগকারী) বিকাশ (বিদেশি বিনিয়োগকারী), স্কয়ার ফার্মাসিটিক্যালস ও ফেব্রিকস। এছাড়া বিশেষ ক্যাটাগরিতে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হয় কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনের চেয়ারম্যান কিহাক সাংকে।
চার দিনব্যাপী এই সম্মেলনে চীন, কোরিয়া, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন। সম্মেলনের প্রথম দুই দিনে বেশ কয়েকটি সেক্টরে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তারা। পাশাপাশি, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা দিতে ঋণ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কয়েকটি বিদেশি ব্যাংক।