এত দিন মোটরযানের জন্য প্রথম পক্ষ বা কম্প্রেহেনসিভ বীমা এবং- তৃতীয় পক্ষ বা থার্ড পার্টি ইনস্যুরেন্স নামে দুই ধরনের বীমা পলিসি ছিল। প্রথম পক্ষ পলিসির আওতায় সড়কে কোনো গাড়ি দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে ওই গাড়ির মালিককে ক্ষতিপূরণ দেয় বীমা কম্পানি।
যানবাহনের ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের সেই বীমা বা থার্ড পার্টি ইনস্যুরেন্স গত মাসেই বাতিল করেছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। এখন বীমা ছাড়াই পথে চলছে গাড়ি।
এই খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, এখন প্রথম পক্ষ বীমা বা কম্প্রিহেনসিভ ইনস্যুরেন্স পলিসি বাধ্যতামূলক করা উচিত। এতে কম্পানি ও মালিক উভয়েই লাভবান হবেন।
বীমার শর্ত থাকলে, গাড়ির চালক বা যাত্রী শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কম্পানি থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। আর তৃতীয় পক্ষ পলিসিতে রাস্তায় চলতে গিয়ে একটি গাড়ি অন্য গাড়ির ক্ষতি বা কোনো ব্যক্তিকে আহত কিংবা নিহত করলে ক্ষতিগ্রস্তকে ক্ষতিপূরণ দিত বীমা কম্পানিগুলো। কম্প্রিহেনসিভ বীমা চালু থাকলেও গেল ডিসেম্বরে তৃতীয় পক্ষের এই পলিসিটিই বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে আইডিআরএ।
আইডিআরএ ও বীমা খাতের অন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, যেহেতু তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে, সেহেতু মোটরযান মালিকদের কম্প্রিহেনসিভ পলিসি বাধ্যতামূলক করা হতে পারে। কারণ এই মুহূর্তে সড়কে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেই ক্ষতিপূরণ কিভাবে দেওয়া হবে, সে বিষয়ে এখনো সবাই সঠিকভাবে অবগত নয়।
আইডিআরএর সূত্র বলছে, মোটরযান মালিকদের কম্প্রিহেনসিভ পলিসিটি বাধ্যবাধকতার মধ্যে আনা উচিত। এতে মালিক ও সড়কে ক্ষতিগ্রস্ত দুইই উপকৃত হবে। কারণ আইনি কারণে এটা করা হলেও বাস্তবে তেমন একটা কাজে আসে না।
কারণ তৃতীয় পক্ষের বীমা পলিসির জন্য মোটরযান মালিককে বছরে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকার মতো প্রিমিয়াম জমা দেওয়া লাগত, যা অত্যন্ত কম। আবার সড়কে কেউ মারা গেলে ২০ হাজার টাকা ও আহত হলে ১০ হাজার টাকা দেওয়ার বিধান ছিল, যা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য।
দেশে বিভিন্ন গাড়ি কম্পানির প্রথম পক্ষ বা কম্প্রিহেনসিভ প্রিমিয়াম প্রায় ৬০ হাজার থেকে এক লাখ ২৫ হাজারের মতো। বাসের প্রথম পক্ষ ইনস্যুরেন্স সর্বোচ্চ প্রিমিয়াম চার লাখ ৬৭ হাজার ২২৭ টাকা আর ট্রাকের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ প্রিমিয়াম ৯৯ হাজার ৩৫৮ টাকা।
আইডিআরএর চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেন বলেন, তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য যে প্রিমিয়াম দেওয়া হতো, তা অত্যন্ত সীমিত। সড়ক পরিবহন আইনে যাত্রীর বীমা ঐচ্ছিক হিসেবে রাখা হয়েছে। ফলে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন অনুযায়ী, তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমাটি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। তবে কম্প্রিহেনসিভ বীমা চালু থাকবে, সামনে এটা নিয়ে আরো কাজ করার পরিকল্পনা আছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী মনে করছেন, তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি মোকাবেলার বিষয়টি কম্প্রিহেনসিভ পলিসির আওতায় আনা দরকার। তিনি বলেন, সড়ক আইনে বীমা করার নিয়মটি সঠিকভাবে প্রাধান্য পায়নি। ফলে আইনের মধ্যেই এটি অন্তর্ভুক্ত করে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে হবে। এটিই ছিল জনগণের প্রত্যাশা। কম্প্রিহেনসিভ পলিসির মধ্যেই ক্ষতিপূরণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে আইন সংশোধন করার দাবি জানাচ্ছি। তিনি বলেন, মালিক ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে প্রিমিয়াম কত হবে, তা নির্ধারণ করতে হবে।
রিপাবলিক ইনস্যুরেন্স কম্পানি লিমিটেডের সহসভাপতি মানসুর আলম শিকদার বলেন, দেশের মোট কম্পানিগুলো প্রতিবছর তৃতীয় পক্ষ ইনস্যুরেন্স থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা প্রিমিয়াম জমা নিলেও ক্ষতিপূরণের হিসাব নেই বললেই চলে। ফলে কম্প্রিহেনসিভ করা হলে বছর শেষে গ্রাহকের একটু বড় অঙ্কের প্রিমিয়াম জমা দিলেও ক্ষতিপূরণ হিসেবে ভালো একটা অর্থ পাওয়ার সম্ভবনা থাকে।
আইডিআরএর সূত্র জানায়, তৃতীয় পক্ষের বীমা এত দিন বাধ্যতামূলক থাকলেও মানুষ এটির সুবিধা সম্পর্কে খুব বেশি অবগত ছিল না। সড়কে ট্রাফিক পুলিশের মামলা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যই মোটরযানের মালিকরা একটা তৃতীয় পক্ষ বীমা পলিসি করতেন।
বীমা খাতের সঙ্গে ২০ বছর ধরে জড়িত এমন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রকৃতপক্ষে তৃতীয় পক্ষ পলিসি দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি লাভবান হতে পারত না। কারণ সেই ১৯৮৩ সালের বীমা আইন অনুযায়ী, কেউ আহত হলে ১০ হাজার টাকা ও নিহত হলে ২০ হাজার টাকা দেওয়ার বিধান ছিল, যা অত্যন্ত কম। আবার গ্রাহক প্রতিবছর অল্প পরিমাণে প্রিমিয়াম জমা দিত। ফলে কম্প্রিহেনসিভ বীমা পলিসি বাধ্যবাধকতার নিয়ম করা হলে একটি নিয়মের মধ্যে আসবে বলে মনে করছি। কম্প্রিহেনসিভ প্রিমিয়াম তুলনামূলকভাবে বেশি। তাই সেটা যেন গ্রাহকের জন্য বেশি না হয়ে যায়, সেদিকে খেয়াল রাখাও জরুরি।