নিজস্ব প্রতিবেদক :
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার সারা জাতির ওপর জুলুম করেছে। এখনো সেই জুলুমের ভার এই জাতিকে বহন করতে হচ্ছে। তাদের আমলে গড়া সিন্ডিকেট এখনো এই সরকার ভাঙতে পারেনি। জাতি যে প্রত্যাশা করেছে সেটা তারা পূরণ করতে পারেনি। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে সরকারকে এগিয়ে যেতে হবে।
শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের উদ্যোগে আয়োজিত রুকন সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
শফিকুর রহমান বলেন, কীভাবে একটি দেশের শাসক নিজের গদি টিকিয়ে রাখতে গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়! গুলি চালালেই গদি রক্ষা হয় না। তারা মনে করেছে আমরাই সব। যেভাবে ফেরাউন বলেছিল ‘আমিই তোমাদের রব’। তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করেছিল। তারা শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লেলিয়ে দেয়নি বরং হেলমেট বাহিনীকেও ব্যবহার করেছিল। আমরা আর একটি সন্তানও হারাতে চাই না। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশের সূর্য সন্তানদের হত্যা করা হয়েছে। ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে। আমরা এমন হত্যাকাণ্ড আর চাই না। আমাদের আর পেছনে তাকানোর সময় নেই।
যে চেতনার ভিত্তিতে বিপ্লব এসেছে তার বেশিরভাগ অপূর্ণ রয়ে গেছে উল্লেখ করে জামায়াত আমির বলেন, যারা দেশের দায়িত্বে আছেন তাদের দেশের জনগণ ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে এই দায়িত্ব দিয়েছে। আমরা তাদেরকে বলব ১৮ কোটি মানুষকে আপনাদের সম্মান করতে হবে। এই বিপ্লবের চেতনাকে ধারণ করে সমস্ত জঞ্জালকে পরিষ্কার করার জন্য জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে আপনাদের এগিয়ে যেতে হবে। এর কোনো বেশকম জনগণ দেখতে চায় না।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, দেশবাসীর কাছে আমরা আহ্বান জানাতে চাই – আমরা এমন একটি দেশ চাই যেই দেশের টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, জাফলং থেকে সুন্দরবন আমার দেশের একজন মা, একজন বোন, একজন ঔরসজাত মেয়ে একাকী রাস্তা অতিক্রম করবে কিন্তু কোনো জালিমের চক্ষু তার দিকে তাকানোর সাহস পাবে না। আজকে সে দেশটি আমাদের নেই। ওই জায়গা তৈরি করতে চাই। আমরা মায়ের জাতিকে ওই জায়গায় নিতে চাই যেখানে একজন মা একজন বোন, একজন মেয়ে বলবে আমি এই দেশের গর্বিত নাগরিক। আমি ইজ্জত নিয়ে এ দেশে আছি। আমি আমার ইজ্জত ও অধিকার ফিরে পেয়েছি। আমরা একটি বৈষম্যহীন সমাজ চাই। সমাজের কোনো স্তরে আমরা বৈষম্য মানব না। তারপরেও কিছু বৈষম্য থেকে যায়। যার যেটুকু মর্যাদা দিয়ে আল্লাহ তৈরি করেছেন তার সেটুকু মর্যাদা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। মানুষের মধ্যে দল ও ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য চাই না। রাষ্ট্র সবার। এজন্য রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা, শান্তি, নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বও সবার। আমরা এ দেশে কোনো মেজরিটি, মাইনোরিটি মানি না। আল্লাহ আমাদের এই অধিকার দেননি। দ্বীন নিয়ে বাড়াবাড়ি চলবে না।
তিনি বলেন, তারা (আওয়ামী সরকার) মানুষকে উপহাস করে আনন্দ পেত। আল্লাহ তায়ালা তাদের পাওনা কিছুটা পাইয়ে দিয়েছেন। বাকি আরও কিছু পাওনা এ দেশের মানুষ দেখতে চায়। আর মূল পাওনা হবে কেয়ামতের ময়দানে। আমরাও যদি কোনো অন্যায় অপকর্ম করি তাহলে আমাদেরও কৃতকর্মের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
জামায়াত আমির বলেন, একটি শিশু জন্মের সঙ্গে সঙ্গে যেন পর্যাপ্ত খাবার পায়, চিকিৎসা পায়, বড় হলে যেন শিক্ষা পায়। শিক্ষা লাভ করার পরে সে যেন হাতের মধ্যে কাজ পায়। আমরা আর শিক্ষিত বেকার শুনতে চাই না। শিক্ষিত হলে বেকার হবে কেনো? আমরা যুবকদের হাতকে কর্মীর হাতে রূপান্তর করতে চাই। আমরা চাঁদাবাজ আর লুটেরার হাতে পরিণত করতে চাই না। খুনির হাতে পরিণত করতে চাই না। তাদের হাতের অবৈধ অস্ত্র তুলে দিতে চাই না। তারা এই জাতিকে তাদের স্বপ্নের মতো গড়ে তুলবে। আমরা এই যুবকদের স্যালুট জানাই। তোমাদের কাজ এখনো শেষ হয়নি।
যারা রাষ্ট্রের সঙ্গে বেইমানে করে তারা কখন বিজয়ী হয় না মন্তব্য করে তিনি বলেন, যারা অপকর্ম করেছে তারাই দেশ থেকে পালায়, তারাই পালিয়েছে। আমরা এদেশকে আর খুনির হাতে তুলে দিতে চাই না। লুটেরাদের হাতে তুলে দিতে চাই না। চাঁদাবাজদের হাতে তুলে দিতে চাই না। মানুষ যেন সম্মানের সঙ্গে বসবাস করতে পারে সে সমাজ চাই। সেই সমাজে যেন একটি শিশু জন্মের পরেই তার সঠিক খাবার পায় সেটিও নিশ্চিত করা হবে।
ডা. শফিকুর রহমান আরও বলেন, আবু সাইদ- মুগ্ধ শেষ হয়নি যুদ্ধ। এই দেশে বিপ্লবীদের জয় হবে। গত ১৫ বছর আমরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত তারপরেও আমরা ব্যক্তিগতভাবে কোনো প্রতিশোধ নিইনি। সদস্যদের উদ্দেশ্য তিনি বলেন, গত ১৫ বছর স্বৈরাচার সরকার আমাদের ঘরে থাকতে দেয়নি। আপনারা আমাদের সহযোগিতা করেছেন। কঠিন দিনগুলো আপনারা ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন। সম্মেলন থেকে মানবিক সমাজ গড়তে দেশের সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বানও জানান জামায়াতের আমির।
সাভারের সিআরপিতে চিকিৎসারতদের জিন্দা শহীদ বলে অঝোরে কাঁদেন জামায়াতের আমির। তিনি বলেন, আমি জানতে পারলাম সাভারের সিআরপি হাসপাতালে জীবন্ত শহীদ ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এখনো তাদের দেখতে কেউ যায়নি। আমি ভীষণভাবে লজ্জিত হলাম, অনুতপ্ত হলাম। আমাদেরও খেয়ালের বাইরে ছিল। গতকাল রাতে সেখানে গেলাম, তাদের দেখলাম। তারা জিন্দা শহীদ!
জুলাইয়ের বিপ্লবে আহতদের স্মরণ করে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বলেন, কাতারে কাতারে তারা বিছানায় পড়ে আছে। তরতাজা যুবক। জাতির মুক্তির আন্দোলনে যুবকদের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে এসেছিল। জালিমের বুলেট তাদের বিদ্ধ করে দিয়েছে। মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে, স্পাইনাল কর্ডকে আহত করে ফেলেছে। কারো দুটি হাত, দুটি পা সবকিছুই অবশ হয়ে গেছে, যেন মৃত একটি মানুষের দেহে শ্বাস প্রশ্বাস চলছে। কারো নিচের দুই অঙ্গ অবশ।
তিনি বলেন, আমি যখন তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছেন। তারা হাশিমুখে বলেছে, ভালো আছি। আমি অবাক হয়ে গেলাম। এত কষ্ট এত ব্যথা তাদের। একটা মানুষ জালিমদের আক্রমণে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েছে। এরপর হাসতে হাসতে বলছে, আমরা ভালো আছি। তাদের জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে হাসতে পারো ভাই? তারা বলছে, আল্লাহ তাআলা তৌফিক দিয়েছেন, এই জন্যই হাসি। এর কারণ কী বলব, আল্লাহ তো জীবন একটাই দিয়েছেন। এই জীবনটা যে জাতির জন্য আল্লাহর সামনে পেশ করতে পেরেছি, তাই আমি হাসি। আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। এই হাসি সত্যিকারের হাসি।
‘আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি’ উল্লেখ করে জামায়াতের আমির বলেন, ওরা হাসছে, আর আমি কাঁদি। কেমন করে একটা দেশের শাসক তার দেশের গোটা যুবসমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেল! ১৮ কোটি মানুষের বিরুদ্ধে চলে গেল। হুকুম করলো গুলি করো, আমার গদি রক্ষা করো। এভাবে রক্ষা হয় না। তারা মনে করেছে তারাই সব। তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করেছিল। আল্লাহর ভয় মন থেকে উঠে গিয়েছিল। পাষাণ হয়েছিল, তাই গুলির নির্দেশ দিতে পেরেছিল। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া হয়নি। হেলমেট, মুগুর বাহিনীকেও অস্ত্র হাতে তারা নামিয়ে দিয়েছে।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, গণমাধ্যমে দেখেছেন ৭-৮ বছরের শিশু পথে নেমে এসেছিল সেদিন হাতে ইট নিয়ে। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, কেনো নেমে এসেছে, সে বলেছিল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে নেমে এসেছি। আমার ভাইদের তারা গুলি করে হত্যা করেছে। গুলি করে হত্যা করা হলে আমি শহীদ হয়ে যাব, মা বাবাকে বলে এসেছি, আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি শহীদ হয়ে গেলে শহীদের সাথে দাফন করে দেবে। ৭-৮ বছরের শিশু স্বৈরাচারকে চিনতে পারল, তারা নিজেদের চিনতে পারল না। ইজ্জত-ক্ষমতা দেওয়ার মালিক আল্লাহ, তা কেড়ে নেওয়ার মালিকও আল্লাহ। আল্লাহ তাআলা যারা জুলুম করে, তাদের একটি সীমা পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ দেন। এরপর আল্লার দৃষ্টিতে যখন সীমা অতিক্রম করে তখন তিনি ধরেন।
শাখা জামায়াতের সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মাসুদের সঞ্চালনায় সম্মেলনে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির মো. নুরুল ইসলাম বুলবুলের সভাপতিত্বে সম্মেলনে দলের নায়েবে আমির আব্দুলাহ মোহাম্মদ তাহের, অধ্যাপক মজিবুর রহমানসহ অন্যান্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
নিজস্ব প্রতিবেদক 
























