চলতি বছরের ১০ মাসে সারাদেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১০২৬জন নিহত হয়েছে। জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ১০১১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ঘটেছে। এই সময়ে আহত হয়েছে ৪১৭ জন। নিহতদের মধ্যে ৭২৪ জন ১৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী। ৩৭ জন শিক্ষক এবং ৩০৮ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে।
এ ছাড়া মোটরসাইকেলের ধাক্কায় ১২৪ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ১২.০৮ শতাংশ।
বৃহস্পতিবার (১২ নভেম্বর) গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানায় রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। ৭টি জাতীয় দৈনিক, ৫টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে সংস্থাটি।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্য যানবাহনের সঙ্গে মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ১৫৬টি (১৫.৪৩%), মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৭৮টি (৩৭.৩৮%), মোটরসাইকেলের পেছনে অন্য যানবাহনের ধাক্কা ও চাপা দেয়ার ঘটনা ৩৫৩টি (৩৪.৯১%) এবং পথচারীকে মোটরসাইকেলের ধাক্কা দেয়ার ঘটনা ১২৪টি (১২.২৬%)। ৩৭৮টি (৩৭.৩৮%) দুর্ঘটনার জন্য মোটরসাইকেল নিজেই এককভাবে দায়ী।
দুর্ঘটনাগুলোর জন্য দায়ী- বাস ১২৩টি (১২.১৬%), ট্রাক ৩০৪টি (৩০.০৬%, কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি ৭৯টি (৭.৮১%), থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-অটোরিকশা-সিএনজি-নসিমন-করিমন-ভটভটি) ৫৭টি (৫.৬৩%), বাই-সাইকেল ৫টি (০.৪৯%)। দুর্ঘটনায় আক্রান্ত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ১০৭৬টি।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ৩৯৮টি (৩৯.৩৬%) জাতীয় মহাসড়কে, ৩৬৯টি (৩৬.৪৯%) আঞ্চলিক সড়কে, ১২৮টি (১২.৬৬%) গ্রামীণ সড়কে এবং ১১৬টি (১১.৪৭%) শহরের সড়কে সংঘটিত হয়েছে।
সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাসমূহ ঘটেছে সকালে ২৫.০২%, দুপুরে ২০.১৭%, বিকালে ২৯.৩৭%, সন্ধ্যায় ১০.০৪% এবং রাতে ১৫.৩৩%।
আরও পড়ুন : দুই গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ চালকই নিহত
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে সংস্থাটি উল্লেখ করেছে:
১. কিশোর-যুবকদের বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালানো;
২. দেশে অতি উচ্চগতির মোটরসাইকেল ক্রয় ও ব্যবহারে বাধাহীন সংস্কৃতি ও সহজলভ্যতা; ৩. ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা;
৪. দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; ৫. সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির শিথিলতা;
৬. বাস-ট্রাক-পিকআপ-প্রাইভেটকার-মাইক্রোসহ দ্রুতগতির যানবাহনের বেপরোয়া গতি;
৭. চালকদের অদক্ষতা ও অস্থিরতা;
৮. ইজিবাইক-সিএনজি-নসিমন-করিমন ইত্যাদি স্বল্পগতির যানবাহন অপরিকল্পিত ও অদক্ষ হাতে চালানো;
৯. সড়ক-মহাসড়কে ডিভাইডার না থাকা;
১০. সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা না থাকা;
১১. পারিবারিকভাবে সন্তানদের বেপরোয়া আচরণকে প্রশ্রয় দেয়া;
১২. উচ্ছৃঙ্খল যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে কলুষিত রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ইত্যাদি।
দুর্ঘটনা রোধে সুপারিশ:
১. কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে;
২. মাত্রাতিরিক্ত গতিসম্পন্ন মোটরসাইকেল উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে; ৩. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে;
৪. গণপরিবহন চালকদের বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করতে হবে;
৫. বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে;
৬. ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে;
৭. মহাসড়কে মোটরসাইকেলের জন্য আলাদা লেন তৈরি করতে হবে এবং স্বল্পগতির স্থানীয় যানবাহন বন্ধ করতে হবে;
৮. স্বল্পগতির যানবাহনের জন্য মহাসড়কের পাশাপাশি সার্ভিস রোড নির্মাণ করতে হবে; ৯.পর্যায়ক্রমে সকল সড়ক-মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে;
১০. গণপরিবহন উন্নত করে মোটরসাইকেলকে নিরুৎসাহিত করতে হবে;
১১. রেল ও নৌ-পথ সংস্কার এবং বিস্তৃত করে সড়ক পথের উপর থেকে ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের মতো পণ্যবাহী যানবাহনের চাপ কমাতে হবে;
১২. সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে;
১৩. “সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮” এর সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার মাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে। অন্যান্য যানবাহনের দুর্ঘটনার সাথে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা যুক্ত হয়ে পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ পর্যায়ে। এসব দুর্ঘটনা মহাসড়কে বেশি ঘটছে। এর পরই আঞ্চলিক সড়কে। অধিকাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটছে ট্রাক ও বাসের ধাক্কায়।
এজন্য প্রধানত দায়ী ট্রাক ও বাসের অতিরিক্ত গতি এবং চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা। কম বয়সী মোটরসাইকেল চালকরাও ভীষণ অসচেতন ও বেপরোয়া। বর্তমানে দেশে প্রায় ৩১ লাখ মোটরসাইকেল রয়েছে। শুধু রাজধানীতেই চলছে ১০ লাখের বেশি। মোটরসাইকেল ব্যবহারের প্রবণতা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। মোটরসাইকেল চার চাকার যানবাহনের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
প্রসঙ্গত, কিশোর-যুবকরাই সবচেয়ে বেশি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়। তাই গণপরিবহনকে উন্নত করে মোটরসাইকেলের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে হবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ তা-ই করছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার মোটরসাইকেল আমদানী ও উৎপাদনে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে, প্রণোদনা দিয়ে এটিকে সস্তা ও সহজলভ্য পণ্যে পরিণত করছে।
এতে দেশের সর্বত্র কিশোর-যুবকদের হাতে অধিক গতিসম্পন্ন মোটরসাইকেলের ছড়াছড়ি। এগুলো ক্রয় ও ব্যবহারে নিয়ম-কানুন মানার বালাই নেই। নেই তেমন মনিটরিং ব্যবস্থা। গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত না করে মোটরসাইকেল উৎপাদনকে উৎসাহিত করা সরকারের একটি আত্মঘাতি ও অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত।
এখনই মোটরসাইকেল উৎপাদন, ক্রয় ও ব্যবহারের লাগাম টেনে একটি টেকসই গণপরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।