নিজস্ব প্রতিবেদক :
সারা দেশে তীব্র গরমে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। তীব্র গরমে দেশজুড়ে আরো তিন দিনের জন্য সতর্কতামূলক হিট অ্যালার্ট জারি করেছে আবহাওয়া অধিদফতর।
সোমবার (২২ এপ্রিল) সকালে আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ স্বাক্ষরিত এক সতর্কবার্তায় এ তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়েছে, ময়মনসিংহ, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের দু’এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়াস বৃষ্টি বা বজ্রবৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে।
তাপপ্রবাহের বিষয়ে বলা হয়েছে, পাবনা ও চুয়াডাঙ্গা জেলার ওপর দিয়ে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে।
রাজশাহী, টাঙ্গাইল, যশোর ও কুষ্টিয়া জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। শ্রীমঙ্গল ও চাঁদপুর জেলাসহ ঢাকা, রাজশাহী ও খুলনার অবশিষ্টাংশ এবং রংপুর, ময়মনসিংহ ও বরিশাল বিভাগের উপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে।
এতে আরো বলা হয়, সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। এ সময় জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি বিরাজ করতে পারে।
দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ মঙ্গলবারের (২৩ এপ্রিল) তাপমাত্রার বিষয়ে বলা হয়েছে, এ দিন সিলেট বিভাগের দু’এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়াস বৃষ্টি বা বজ্রবৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। এ দিন বিরাজমান তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। এ ছাড়া সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে এবং রাতে প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি বিরাজ করতে পারে।
তৃতীয় দিনের অবহাওয়া সম্পর্কে বলা হয়, এ দিন অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। এ সময় বিরাজমান তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। আর সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা বাড়তে পারে। এ সময় জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি বিরাজ করতে পারে।
আবহাওয়ার সিনপটিক অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে, লঘুচাপের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে।
এর আগে শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) সারাদেশে ৩ দিনের জন্য সতর্কতামূলক হিট অ্যালার্ট জারি করা হয়েছিল। শুক্রবার (১৯ এপিল) থেকে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টা অর্থাৎ রোববার পর্যন্ত তিনদিন হিট অ্যালার্ট জারি করেছিল আবহাওয়া অধিদপ্তর। এরপর আজ থেকে আবারও সারাদেশে ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি করা হলো।
এপ্রিলের এ সময়ে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা থাকে ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে তা ৩৫ থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকছে। রোববার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল যশোরে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর ঢাকার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করে গেছে।
তাপমাত্রাবিষয়ক গবেষক ও ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মালয়েশিয়ার অধ্যাপক শামসুদ্দিন শহিদ বলেন, বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে শুধু তাপমাত্রার তীব্রতা দিয়ে মানুষের কষ্ট ও বিপদ বোঝা যাবে না। কোথাও তাপপ্রবাহ অর্থাৎ তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে না গেলেও বিপজ্জনক আবহাওয়া তৈরি হতে পারে। কোথাও যদি তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে এবং আর্দ্রতা ৪০ শতাংশের বেশি হয় এবং বাতাসের প্রবাহ কম থাকে, তাহলে সেখানে অতি উষ্ণতার বিপদ তৈরি হতে পারে। এপ্রিল মাসজুড়ে বাংলাদেশে এই অতি উষ্ণতার বিপদই তৈরি হচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ‘বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, গত ৬০ বছরে এপ্রিলের উষ্ণতা দ্রুত বেড়ে বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এই মাসের বেশির ভাগ সময়জুড়ে দেশের অর্ধেকের বেশি এলাকায় তাপপ্রবাহ বইছে। অন্য বছরগুলোতে এই সময়ে কয়েক দিন পরপর একাধিক কালবৈশাখী, ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি হয়। এতে তাপমাত্রা কিছুটা হলেও কমে আসে। এবার বৃষ্টি ও বাতাস নেই বললেই চলে। চার দিন ধরে দেশের ৭০ শতাংশ এলাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করে গেছে। আর গতকাল দেশের অন্তত ১২টি জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি ছিল।
পূর্ব এশিয়াসহ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি উঠলে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ঘোষণা করা হয়। আর তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর আর্দ্রতা ৩০-এর ওপরে গেলে একে বিপজ্জনক আবহাওয়া হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে প্রকাশ করা ২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, এপ্রিল মাসে তাপপ্রবাহ সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। প্রতিবেদনে অনুযায়ী, রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা ও বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা থাকছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, এপ্রিল মাসের আবহাওয়া অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও অন্যান্য কারণে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। ফলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই সময়ের জনস্বাস্থ্য, কৃষি ও গবাদিপশুর সুরক্ষার জন্য দ্রুত পরিকল্পনা নিতে হবে।
ঢাকার হাসপাতালগুলোতে সারাদেশ থেকে রোগীদের ভিড় দেখা যাচ্ছে। সর্দি-কাশি থেকে শুরু করে জ্বর, বমি, ডায়রিয়া, মাথাব্যথা, গলা ব্যথা এবং শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মো. কামরুজুম্মন মিলন চরম তাপপ্রবাহকে মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী তাপপ্রবাহ এবং বন্যা, অতিবৃষ্টি এবং চরম ঠান্ডা আবহাওয়াসহ অস্বাভাবিক অন্যান্য দুর্যোগের ঘটনা ঘটায়।