নিজস্ব প্রতিবেদক :
অর্থ খরচ করে সরকার বিদেশ থেকে পর্যবেক্ষক আনবে না। আর অর্থ খরচ করে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক নিয়ে আসার মতো পর্যায়ে বাংলাদেশ নেই বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।
সোমবার (১৬ অক্টোবর) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সফররত যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি আফরিন আখতারের সঙ্গে বৈঠক শেষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
ইইউ এর মতো মার্কিন পর্যবেক্ষক আসলে তাদের খরচও সরকারকে বহন করবে কিনা জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আমাদের ব্যয় বহন করার কোনও উদাহরণ নেই। বর্তমানে এমন কোনও পরিস্থিতি নেই যে বিদেশিদেরকে পয়সা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করাতে হবে। লজিস্টিক সহায়তা যেটি লাগে সেটি আগেও করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে, সেটি অন্য বিষয়। কিন্তু পয়সা দিয়ে নিয়ে আসতে হবে নির্বাচন দেখাতে, আমার মনে হয় না আমরা সেই পর্যায়ে আছি।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) ব্যক্তিকেন্দ্রিক নিষেধাজ্ঞাগুলো তুলে নিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করেছে বলে জানিয়ে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, র্যাবের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি তাদের সামনে তুলেছিলাম। র্যাবের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ব্যাপারে আমাদের যে প্রচেষ্টা সেটি অব্যাহত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্টে আমরা প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। আমরা আশা করছি, যত দ্রুত সম্ভব নিষেধাজ্ঞাগুলো, বিশেষ করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক যে নিষেধাজ্ঞা আছে সেগুলো আগে তুলে নেওয়া। কারণ বড় আকারে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক যে নিষেধাজ্ঞা সেগুলো সময় লাগবে। এখন কেস বাই কেস তুলে নিলে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা আরও বাড়বে। সংঘাতমুক্ত যে নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে সেখানেও হয়তো ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার অনুরোধ সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাদের যে আইনি প্রক্রিয়া আছে, সেটা অনুসরণ করেই আমরা এগোচ্ছি। তারা যদি বলে প্রতিষ্ঠানের জন্য তাদের এ সংস্কারগুলো দরকার, সেটা সময় লাগবে, দেরি হবে। যে কারণে আমরা বলছি, যেটা আগে হয়, যদি মনে করা হয় ব্যক্তির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে সেটা সহজ হবে, হয়তো ইনস্টিটিউশন পরে লাগবে। অর্থাৎ যেটা আগে আসে, সেটা করা হবে।
র্যাবের কোনো সংস্কার করা হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া। এটা র্যাবও জিজ্ঞাসা করতে পারে। আমাদের যেটা জানা আছে, সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তারাও জানেন। যে কোনো সংস্থায় একটা অব্যাহত সংস্কার হতে থাকে।
নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা বা বিনিয়োগকেন্দ্রিক কোনো চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না জানিয়ে সচিব বলেন, আসন্ন নির্বাচন নিয়েও তার সঙ্গে কথা হয়েছে। সম্প্রতি এনডিআই ও আইআরআই প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসেছিল। তারা পরামর্শ দিয়েছিল সে ব্যাপারে মার্কিন অবস্থানও একই রকম বলে তিনি জানিয়েছেন। তারা চাচ্ছে যে আগামী নির্বাচনটা অবাধ ও সুষ্ঠু হোক। সেটা যাতে সংঘাতমুক্ত হয় এ ব্যাপারে তাদের যে অবস্থান আছে সেটি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। আমরা বলেছি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরে এনডিআই ও আইআরআই প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করেছেন। সেখানে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী সরকারের অবস্থানও পুনর্ব্যক্ত করেছেন। সরকারের যে কমিটমেন্ট আছে নির্বাচন করার সেটাও বলেছেন। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের যে ইতিহাসের পটভূমি আছে বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সেখানে প্রধানমন্ত্রী সরকারের অবস্থান তাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন। এ ব্যাপারে আমাদের নতুন কিছু বলার ছিল না। আমরা বলেছি, এনডিআই ও আইআরআই যদি তাদের পর্যবেক্ষক পাঠায় তাহলে নির্বাচন কমিশন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমাদের যতটুকু করা দরকার সেটা করতে প্রস্তুত।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আমাদের আলোচনা হয়েছে। আমরা তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছি। সম্প্রতি নিউইয়র্কে সাইট লাইনে যে বৈঠক হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র থেকেও একটি প্রতিনিধিদল অংশ নিয়েছিল। তারা ঘোষণা দিয়েছিল রোহিঙ্গা হিউমেরিটিয়ান অ্যাকশন। এছাড়া রোহিঙ্গাদের বিষয়ে তাদের আপডেট জানিয়েছি। রোহিঙ্গা সংকট সমস্যা সমাধানে মূল বিষয় হচ্ছে তাদের নিজেদের দেশে ফেরানো। সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তবে এ ব্যাপারে তাদের কিছু কনসার্ন আছে। আগেও তারা বলেছে, এটা সেভ অ্যান্ড সিকিউট হতে হবে, একটি স্থায়ী হতে হবে, নইলে বারে বারে এটি হয়। এক্ষেত্রে তারা অতীতের উদাহরণও দিয়েছেন। রাখাইনে যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সেটিও ধারণার মধ্যে রাখতে হবে।।
তিনি আরো বলেন, আমরা তাদের আশ্বাস দিয়েছি যে আমরা আমাদের আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরাও এমন কোনো পদক্ষেপ নেবো না যাতে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় বা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক কোনো কিছু আমরা করবো না। মিয়ানমার এবং চাইনিজদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা অব্যক্ত রাখবো আগামী দিনগুলোতে। যাতে আমরা শিগগির এটা শুরু করতে পারি। এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থান আমরা স্পষ্ট করেছি তাদের কাছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারির সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে আলাপ হয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্রসচিব। তিনি বলেন, আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এনডিআই এবং আইআরআইয়ের প্রতিনিধিদল যে পরামর্শ দিয়েছেন, সে ব্যাপারে মার্কিন অবস্থানও একই রকম। তারা চাইছে আগামী নির্বাচনটা অবাধ ও সুষ্ঠু হোক।
এনডিআই এবং আইআরআই বাংলাদেশে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাতে চাইলে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রস্তুত আছে বলেও জানান মাসুদ বিন মোমেন।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ওরা (যুক্তরাষ্ট্র) বলেছে, এনডিআই এবং আইআরআইয়ের যে পরামর্শগুলো সেগুলোর সঙ্গে তাদের এনডোর্সমেন্ট এবং অ্যালাইনমেন্ট আছে। তারা যে পরামর্শ দিয়েছে, তার ব্যাপারে আমরা কি করছি এটা তোৃ।
নির্বাচনে সহিংসতা প্রসঙ্গে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, সহিংসতা এক হাতে হয় না। অন্তত দুটি পার্টি লাগে। আর আমাদের অতীতের যে রেকর্ড আছে সেটা তো ভালো না। সেই কারণে হয়তো তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) শঙ্কা। সহিংসতা মুক্ত করার জায়গায় জনগণ, রাজনৈতিক দলগুলো সবার আছে।
কূটনীতিকদের বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, সন্তোষ বা অসন্তোষ বলে কিছু নেই। তারা যদি অযাচিতভাবে এ বিষয়ে কথা বলে এবং সেটা যদি আমরা মনে করি, ইন্টারফেয়ারেন্স ইন আওয়ার ডমিস্টিক অ্যাফেয়ার্স; তখন আমরা ভিয়েনা কনভেনশনের কথা বলেছি। কিন্তু আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে বা অংশীদার হিসেবে যদি তাদের কোনো জিজ্ঞাসু থাকে বা কোনো কমেন্টস থাকে সেটা তো আমরা সবসময় উত্তর দিয়েছি।
তিনি বলেন, আমাদের সমস্যা হলো-কূটনীতিকরা যদি পাবলিক ডোমেনে কোনো কিছু বলে বা করে ডমিস্টিক বা ইন্টারনাল অ্যাফেয়ার্সে হস্তক্ষেপ করে সেটাতে আমাদের আপত্তি আছে। বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে তাদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হতেই পারে। কিন্তু পাবলিক ডোমেনে অযাচিত কথা বলা বা উপদেশ দেওয়া সমস্যা। সেগুলোর ব্যাপারে আমরা কথা বলেছি।
নির্বাচন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষক দল অর্থবহ সংলাপের কথা বলছে। এটা হস্তক্ষেপ কি না প্রশ্ন রাখা হয় পররাষ্ট্রসচিবের কাছে। জবাবে তিনি বলেন, আমরা তো বলছি, সেটা আপনারা যেভাবে দেখেন।
আফরিনের সঙ্গে বৈঠকে নতুন করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়ে আলাপের বিষয়ে জানতে চাইলে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, এটা নিয়ে তারাও কিছু বলেনি। আমরাও যেচে কিছু বলিনি।
নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো ধরনের চুক্তির সম্ভাবনা নেই বলেও জানান পররাষ্ট্রসচিব।
বৈঠকে ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিশেষ করে গাজা ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। মার্কিন প্রশাসনকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে বলেছি আমরা।
পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, জনসমক্ষে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিরা অযাচিত হস্তক্ষেপ করলে আপত্তি আছে সরকারের। বন্ধু হিসেবে কূটনৈতিক চ্যানেলে বললে তা বিবেচনা করবে ঢাকা।
মার্কিন ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, সুষ্ঠু, অবাধ, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের বিষয়ে বারবারই তারা বলছে। আমরাও তাদের আশ্বস্ত করছি সুষ্ঠু, অবাধ, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হবে। এ সময় নির্বাচনী পর্যবেক্ষক আনতে বিদেশিদের পেছনে সরকার কোনো খরচ করবে না বলেও জানান তিনি।
পররাষ্ট্র সচিব আরও বলেন, বৈঠকে র্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার বিষয়ে কথা হয়েছে। আর যেকোনো বাহিনীর সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে আইনশৃঙ্খলা ও পরিবেশের উন্নতি হবে।’
বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিষয়ে আলোচনা হলেও এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন কোনো বাণিজ্যিক চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেও জানান পররাষ্ট্র সচিব।