নিজস্ব প্রতিবেদক :
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আন্দোলন, ভিসানীতি, নিষেধাজ্ঞা বা বিদেশিদের ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই বলে দৃঢ়চিত্তে উচ্চারণ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, নৌকা উজান ঠেলেই সারা জীবন এগিয়ে গেছে জানিয়ে সব বাধা উপেক্ষা করে আগামী দিনেও এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন সরকারপ্রধান।
শনিবার (২ সেপ্টেম্বর) বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পুরোনো বাণিজ্যমেলা মাঠে ঢাকায় দেশের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন পরবর্তী সুধী সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, অনেকে আন্দোলনের কথা বলে। আবার ভিসানীতি বা নিষেধাজ্ঞার ভয় দেখায়। আমার স্পষ্ট কথা, দেশ আমাদের, দেশ আমরা স্বাধীন করেছি। এসব ভয় আমাদের দেখিয়ে লাভ নেই। এই দেশ, এই মাটি আমাদের।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকের বাংলাদেশের এত উন্নয়ন কেন হয়েছে? দেশে একটা গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা রয়েছে বলেই সেটা হয়েছে। অনেকে এখন গণতন্ত্র উদ্ধার করবে বলেন। তারা কী গণতন্ত্র দিয়েছে, আমরা জানি। এখন আবার অনেকে আন্দোলনের কথা বলে। ভিসানীতি ও নিষেধাজ্ঞার ভয় দেখায়। এসব ভয় আমাদের দেখিয়ে লাভ নেই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্দোলন সংগ্রাম দেখে অনেকেই একটু ঘাবড়ে যান। তারপর আবার স্যাংশন আসে, ভিসা স্যাংশন ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার স্পষ্ট কথা, এই মাটি আমাদের। আমরা দেশ স্বাধীন করেছি জাতির পিতার নেতৃত্বে। এই সমস্ত ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। বাংলাদেশের মানুষ জানে অধিকার আদায় করতে।
তিনি বলেন, তবে বাংলাদেশ তো ছয় ঋতুর দেশ। ছয় ঋতুর দেশে আমরা তো দেখি কখনো বর্ষা, কখনো ঝড়, কখনো জলোচ্ছ্বাস, কখনো রৌদ্রোজ্জ্বল, আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কিছু দেখে আমাদের অভিজ্ঞতা আছে। তাই আজকে যারা আন্দোলনের নামে রোজই আমাদের ক্ষমতা থেকে ফেলে দিচ্ছে আমি আপনাদেরকে বলতে চাই, যারা এখানে উপস্থিত সবাইকে আমি কবির ভাষায় বলব- ‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয় আড়ালে তার সূর্য হাসে; হারা শশীর হারা হাসি অন্ধকারেই ফিরে আসে’। কাজেই আমাদের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। মেঘের ঘনঘটা আমরা দেখি। আবার তারপর তো সূর্যও উঠে। কাজেই ওই ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। ভয়কে জয় করে বাংলাদেশের জনগণ তার উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় অপ্রতিরোধ্য এগিয়ে যাবে। নৌকা সারাজীবন উজান ঠেলেই এগিয়েছে। উজান ঠেলেই এগিয়ে যাবে।
সরকারপ্রধান আরও বলেন, নৌকা মার্কা ডিজিটাল বাংলাদেশ দিয়েছে। এই নৌকাই স্মার্ট বাংলাদেশ দেবে। আত্মবিশ্বাস রেখে জনগণের কল্যাণে কাজ করলে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব। এটা আমরা দেখেছি। তবে তার জন্য স্থিতিশীলতা দরকার।
সরকারপ্রধান বলেন, ১৯৭৫ সাল থেকে ’৯৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত যারা ক্ষমতায় ছিল তারা দেশকে কিছুই দিতে পারেনি। নিজেদের আখের গুছিয়েছে। এদেশের মানুষের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার সুযোগ তারা দিতে পারেনি। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য তারা গড়তে চায়নি। স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মমর্যাদা নিয়ে বিশ্ব দরবারে দাঁড়াবে বাংলাদেশ, এটা কখনো তারা চায়নি।
তিনি বলেন, ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসি আমরা, এরপর জনগণের সেবা করতে শুরু করি। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য কীভাবে পরিবর্তন করব সেই কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম মাত্র পাঁচ বছর। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট, সবকিছু আমরা উন্নত করেছিলাম। এরপর আবার চক্রান্ত, ২০০১ থেকে ২০০৮। ২৯টা বছর যারা ক্ষমতায় ছিল, কী দিয়েছে বাংলাদেশের মানুষকে তারা। কিছু দিতে পারেনি। তারা শুধু নিজেরা লুট করেছে, আখের গুছিয়েছে।
দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা নিজের একমাত্র কাজ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমার কাজ একটাই, বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা। আমরা যে ওয়াদা করেছি, তা পালন করেছি। কবি সুকান্তের ভাষায় বলতে চাই, আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
বিএনপি উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যাদের জন্ম অগণতান্ত্রিকভাবে তারা নাকি গণতন্ত্র উদ্ধার করব। তাদের সময়ে ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত দেশ অন্ধকারে ছিল। বর্তমানে সে অবস্থা নেই। বর্তমানে বাংলাদেশ আলোর পথের যাত্রী। আমরা যে ওয়াদা করেছি সবগুলো পূরণ করেছি। আগামীতে এ দেশকে বাসযোগ্য করে যাব এ আমার অঙ্গীকার।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্ষমতায় এসে সড়ক, নৌ-পথ ও রেলপথের ব্যাপক উন্নয়ন করছে আওয়ামী লীগ সরকার।
কারো কাছে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে যেতে হবে না উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু তৈরি করেছি আমরা। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখন অন্ধাকার যুগে নেই। সার্বিক উন্নয়নের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ আসার পরেই এদেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন শুরু হয়। আমরা সেভাবেই কাজ করে গেছি। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে সমগ্র উন্নয়ন কাদের স্বার্থে? জনগণের স্বার্থে। জনগণের জন্য আমরা উন্নয়ন করেছি, করে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, জনগণের ভোটে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে ২০০৯ সালের পর থেকে দেশ উন্নত হয়েছে। আজ বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর কাছে উন্নয়নের রোল মডেল। ডিজিটাল বাংলাদেশের পর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সাধারণ মানুষের যখন বয়স হয়ে যাবে। কর্ম অক্ষম হয়ে যাবে, তখন তারা যেন পেনশন পায় সেজন্য পেনশন স্কিম চালু করে দিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিজের খাবার নিজে খাবো, কারও কাছে হাত পাতব না। জাতির পিতা বলেছিলেন, ভিক্ষুক জাতির ইজ্জত থাকে না। আমাদের কারও কাছে হাত পাততে হবে না।
তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেন, কেউ বেকার থাকলে হবে না। কর্মসংস্থান ব্যাংক করে দিয়েছি। সেখান থেকে বিনা জামানতে ঋণ নিয়ে কিছু না কিছু করতে হবে।
তিনি বলেন, ২০১৮ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে। সেই নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছিল। বিএনপির ২০ দলীয় জোট ৩০০ আসনের মধ্যে পেয়েছিল মাত্র ২৯টি। পরে ১টা পেয়ে ৩০টা হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য ছিল ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আর ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী, সেসব উদযাপনকালেই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। আর্থসামাজিক উন্নয়ন করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে আমরা সক্ষম হয়েছি।
সরকারপ্রধান বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এ দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন শুরু করেছে, আমরা সেভাবে কাজ করে যাচ্ছি। যোগাযোগ ব্যবস্থার বিশাল উন্নতি আমরা করেছিলাম। প্রথমবার ক্ষমতায় এসে রূপসা নদীর ওপর সেতু, যমুনা নদীর ওপর সেতু, মেঘনা নদীর ওপর সেতু, ধরলা সেতু, বিভিন্ন সেতু এবং রাস্তায় ঘাটের উন্নতি করেছি। রাস্তা, রেল, নদীপথ এবং বিমান, প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা উন্নতি করেছি। একটা মাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছিল, চট্টগ্রাম ও সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠা করি।
শেখ হাসিনা বলেন, আজকে যোগাযোগ ক্ষেত্রে আমরা ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা- মাওয়া-ভাঙ্গা সড়কসহ ৮৫৪ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেন বা ছয় লেনে আমরা উন্নতি করেছি। ১০৮১০ কিলোমিটার মহাসড়ক প্রশস্ত করা হয়েছে। ১৯৮৯৯ কিলোমিটার মহাসড়ক মজবুত করা হয়েছে। মহাসড়কে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৬০ মিটার সেতু কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত যখন ক্ষমতা ছিল, আমাদের মহাসড়ক কতটুকু ছিল? তখন মহাসড়ক ছিল মাত্র ১৫ হাজার ১৫১ কিলোমিটার। আজকে আমাদের সড়ক-মহাসড়ক ১ লাখ ২২ হাজার ৫৫২ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এটা আমরা সফলভাবে করতে পেরেছি।
তিনি বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে আজ একটা সাময়িক সমস্যা চলছে। আমাদের ওপর অর্থনৈতিক ধাক্কা এসেছে। এজন্য আমি বলেছি, দেশে কোনো অনাবাদি জমি থাকবে না। নিজের ফসল নিজে ফলাবো। নিজের খাবার নিজে উৎপাদন করে খাবো। কারও কাছে হাত পাতবো না। জাতির পিতা বলতেন, ভিক্ষুকের জাতির উন্নতি হয় না।
সরকারপ্রধান বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছি, বাংলাদেশকে দাবায়ে রাখা যায় না। মেট্রোরেল, উড়াল সড়ক উদ্বোধন করলাম। এগুলো সবই জনগণের স্বার্থে। সারাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতি করেছি। আমরা চাই, আমাদের দেশ আরও এগিয়ে যাবে।
তিনি বলেন, জাতির পিতার এই স্বাধীন দেশের একটি মানুষও গৃহহীন ও ভূমিহীন থাকবে না। তাদের ঘরবাড়ি করে দিচ্ছি। বেকারদের কর্মসংস্থান ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ দিয়ে কাজের সুযোগ করে দিচ্ছি। সরকারি চাকুরেদের মতো সবার জন্য সর্বজনীন পেনশন চালু করেছি। শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যতও যেন আলোকিত হয়, আমরা সে উদ্যোগই নিচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাজধানীর সঙ্গে সারা বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের একটি নতুন উপহার আজকে আপনাদের জন্য দিয়ে যাচ্ছি। যেটি যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি নতুন মাইলফলক। আজ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কাওলার দক্ষিণ প্রান্ত থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত অংশের উদ্বোধন করা হয়েছে। আপনাদের জন্য এই উপহার দিচ্ছি।
তিনি বলেন, এটি ঢাকার যানজট নিরসনে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এর মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্রুত উন্নতি হবে। মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হবে না। বিশেষ করে এয়ারপোর্ট, কুড়িল, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, ফার্মগেট, মগবাজার ও কমলাপুর এলাকার যানজট নিরসন করবে।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রীর ছোটবোন শেখ রেহানা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম, দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রওশন আরা মান্নান, সংসদ সদস্য হাবিব হাসান ও মোহাম্মদ আলী আরাফাত প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সেতু সচিব মঞ্জুর হোসেন।