Dhaka রবিবার, ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পাঁচ বছরে ভরাট বুড়িগঙ্গার ১১ শাখা খাল

শ্যামপুর-কদমতলী খাল ভরাট করে একাংশে হয়েছে রাস্তা, অন্য অংশে উঠেছে বাড়িঘর। পার্শ্ববর্তী খালগুলোও আবর্জনায় পূর্ণ

বুড়িগঙ্গার ওপর পরিচালিত সম্প্রতি এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ আশপাশ এলাকায় বুড়িগঙ্গার ১৯টি শাখা খালের তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে গত পাঁচ বছরেই ভরাট হয়েছে ১১টি খাল।

রাজধানীর মানচিত্রে এখনো এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে শ্যামপুর-কদমতলী খাল। ৫০-৬০ ফুট প্রস্থ ও ১ দশমিক ২৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এ জলাশয়ের উৎসমুখ শ্যামপুরে আর পতন কদমতলীতে। যদিও সেখানে গিয়ে এ খালের অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সর্বশেষ প্রকাশিত (২০১৯) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রাস্তা নির্মাণের ফলে সেটি ভরাট হয়ে যায়। পার্শ্ববর্তী তিতাস, জিয়া সরণিসহ অন্যান্য খালও দখল আর দূষণে বিপর্যস্ত। পরিণত হয়েছে ছোট নালায়।

পরিবেশবিদরা বলছেন, খালের সীমানা নির্ধারণ না থাকায় সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও এসব খাল ভরাট হয়েছে। এর ফলে বুড়িগঙ্গার প্রাণ-প্রকৃতি যেমন বিপর্যস্ত হয়েছে তেমনি নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে ঢাকার বাসযোগ্যতায়। তাই দ্রুত সীমানা নির্ধারণ করা না হলে বিদ্যমান খালগুলোও দখল হওয়ার আশঙ্কা করেছেন তারা।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন একটি প্রকল্পের আওতায় ৪৮টি নদী সমীক্ষা করেছে। সেই সমীক্ষা শিগগিরই প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ হবে বলে সংস্থা সূত্রে জানা গেছে। তবে প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, এ সমীক্ষায়ও বুড়িগঙ্গা নদীর ১৯টি শাখা খালের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১১টির এখন আর কোনো অস্তিত্বই নেই। ভরাট হওয়া খালের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটির পাঁচটি, কেরানীগঞ্জ উপজেলার পাঁচটি ও নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার একটি খাল রয়েছে।

বুড়িগঙ্গাসহ বিভিন্ন খাল-বিল-নদী ভরাট ও দখলের বিষয়টি দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সদস্য মালিক ফিদা আব্দুল্লাহ খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দখল হয়ে যাওয়া খালগুলো উদ্ধারে তৎপর হওয়ার জন্য আমরা বারবার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বলে আসছি। কেননা ঢাকার জলাবদ্ধতা ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় এগুলো উদ্ধারের কোনো বিকল্প নেই। শুধু বুড়িগঙ্গার খালই নয়, আমরা মনে করি, যেকোনো প্রাকৃতিক খাল ভরাট হয়ে গেলে সেটি উদ্ধার করে প্রবাহিত করতে হবে। তবে নদী রক্ষা কমিশনের যেহেতু অ্যাকশনের ক্ষমতা নেই তাই আমরা শুধু সুপারিশ করে যাচ্ছি। আশা করছি, সংশ্লিষ্টরা দ্রুত এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটির ভরাট হওয়া পাঁচটি খালের মধ্যে রয়েছে শ্যামপুর খাল, সূত্রাপুর খাল, কামরাঙ্গীরচর খাল, হাইক্কার খাল ও শ্রীখণ্ড খাল। এ খালগুলো বয়ে চলা এলাকার জলাবদ্ধতা ও বুড়িগঙ্গার জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। কিন্তু ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে এলাকাবাসীকে দীর্ঘমেয়াদি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। সরজমিনে শ্যামপুর-কদমতলী এলাকায় দেখা যায়, খালের একাংশে বিশাল রাস্তা হয়েছে। অন্য অংশে উঠেছে বাড়িঘর। পার্শ্ববর্তী খালগুলোও আবর্জনার স্তূপপূর্ণ।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শ্যামপুর খালটি দিয়ে পোস্তগোলা, জুরাইন, শ্যামপুর, পাগলা এলাকার পানি বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ত। কিন্তু খালটি না থাকায় শ্যামপুরের পানি দুই কিলোমিটার কাছের বুড়িগঙ্গায় গিয়ে না পড়ে এখন ড্রেন দিয়ে ২০ কিলোমিটার দূরের শীতলক্ষ্যা নদীতে যাচ্ছে। ফলে পাগলা, শ্যামপুর, ডেমরা, সাইনবোর্ড এলাকার মানুষকে দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতায় ভুগতে হয় অল্প বৃষ্টিতেও।

স্বল্প সময়ের মধ্যেই একে একে পাঁচ খাল ভরাট হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুর) মো. খায়রুল বাকের বলেন, ‘দীর্ঘদিন খালগুলো ঢাকা ওয়াসার তত্ত্বাবধানে ছিল। আমরা খালের দায়িত্ব পেয়েছি দুই বছর হলো। এ সময়ের মধ্যে বুড়িগঙ্গা আদি চ্যানেলকে আমরা সচল করেছি। সেখানে অনেক স্লুইসগেট বন্ধ ছিল, সেগুলোও সচল করেছি। খালের সীমানা নির্ধারণের কাজ শুরু করেছি। ক্রমান্বয়ে সিএস ম্যাপ দেখে ভরাট হওয়া খালগুলো উদ্ধার করা হবে।’

ঢাকার পর সবচেয়ে বেশি খাল ভরাট হয়েছে কেরানীগঞ্জে, পাঁচটি। সেগুলো হলো শাক্তা ইউনিয়নের ঝাউচর খাল, আগানগর ইউনিয়নের ওয়াপদার খাল, শুভাঢ্যা ইউনিয়নের হাসনাবাদ খাল, কোন্ডা ইউনিয়নের বসুন্ধরা বন্ধ খাল ও মুগদা খাল। এ খালগুলোও ভরাট হয়েছে ব্যক্তি ও সরকারি উদ্যোগে। কোনো কোনো খালের ওপর গড়ে উঠেছে একাধিক আবাসন প্রকল্প।

দেশের নদ-নদী ও খাল-জলাভূমি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মো. এজাজ। তিনি বলেন, ‘এসব খালে একসময় মাছ ছিল। নৌকা চলত। ঢাকা ও বুড়িগঙ্গার প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় খালের ভূমিকা এখন সবাই অনুভব করছে। খালগুলো টিকে থাকলে ঢাকার বাসযোগ্যতার প্যারামিটার আরো শক্তিশালী হতো কোনো সন্দেহ নেই।’

পাঁচ বছরের মাথায় বুড়িঙ্গার শাখা খালগুলো ভরাট হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘খালগুলোর সীমানা নির্ধারণ না করার ফলে যে যেভাবে পেরেছে দেদার ভরাট করেছে। তাই আমাদের দাবি থাকবে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর যেন দ্রুত সিএস ম্যাপ অনুযায়ী বিদ্যমান ও হারিয়ে যাওয়া খালের সীমানা নির্ধারণ করে দেয়। পাশাপাশি ভরাট হওয়া খালগুলো দ্রুত উদ্ধারেরও পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানচ্ছি।’

বুড়িগঙ্গার দুটি শাখা খাল নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলায় পড়েছে। এর মধ্যে একটি ফতুল্লা ইউনিয়নের ডিএনডি খাল। অন্যটি এনায়েতনগর ইউনিয়নের ফাজিলপুর ও গোয়ালবাড়ি খাল। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রকাশিতব্য প্রবিদেন অনুযায়ী ফাজিলপুর ও গোয়ালবাড়ি খালটি ভরাট হয়ে গেছে।

৪৮ নদী সমীক্ষা প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক এনভায়রমেন্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ স্পেশালিস্ট মনির হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা নদীগুলোর সমীক্ষা করতে গিয়ে শাখা খালগুলো নিয়েও বিস্তারিত স্টাডি করেছি। সেখানে দেখেছি বুড়িগঙ্গা নদীর ১৯টি শাখা খালের মধ্যে ১১টিই ভরাট হয়েছে। এর কোনোটি সিটি করপোরেশন ভরাট করেছে, কোনোটি ভরাট করেছে ওয়সা। এছাড়া ঢাকার বাইরে কোনো কোনো খাল আবাসন প্রকল্পের মাধ্যমে ভরাট করা হয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরাও ভরাট করেছে অনেক খাল। কোনো খাল যখন ভরাট হয়, তখন সিটি করপোরেশন, রাজউক সংশ্লিষ্টরা অ্যাকশন নেয় না। ভরাট হওয়ার পর বলে কিছু করার নেই। অথবা রাষ্ট্রের টাকা অপচয় করে সেটা আবার উচ্ছেদ করে। এখনো ঢাকায় অনেক খাল ভরাট হচ্ছে। আমাদের চোখে যেমন পড়ছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চোখেও তো পড়ছে। তাহলে তারা দেখেও না দেখার ভান করছেন কী কারণে? নিশ্চয় এখানে অবৈধ কোনো লেনদেন আছে। নয়তো চুপ থাকার তো কথা নয়।’

সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময়ে ঢাকার খাল নিয়ে বিভিন্ন তথ্য পেয়েছি। বেশির ভাগ সরকারি কাগজে খালের সংখ্যা ৪৩ দেখেছি। কোনো কাগজে আমরা ৫২টারও উল্লেখ পেয়েছি। এ খালগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে গেছে, এগুলো ২০ বছর ধরেই আলোচনা হচ্ছে। সে পরিপ্রেক্ষিতে মাত্র গত পাঁচ বছরে নতুন করে আবার খাল হারিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। যখন থেকে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তখন থেকেই যদি এগুলোর ব্যাপারে আমরা মনোনিবেশ করতাম, তাহলে এ খালগুলোকে অন্তত বাঁচানো সম্ভব হতো। আশা করব, আর কালক্ষেপণ না করে সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগী হবে।’

জনপ্রিয় খবর

আবহাওয়া

ফরিদপুর-বরিশাল মহাসড়ক চার লেন দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে মানববন্ধন 

পাঁচ বছরে ভরাট বুড়িগঙ্গার ১১ শাখা খাল

প্রকাশের সময় : ১১:১৯:১৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২ এপ্রিল ২০২৩

বুড়িগঙ্গার ওপর পরিচালিত সম্প্রতি এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ আশপাশ এলাকায় বুড়িগঙ্গার ১৯টি শাখা খালের তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে গত পাঁচ বছরেই ভরাট হয়েছে ১১টি খাল।

রাজধানীর মানচিত্রে এখনো এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে শ্যামপুর-কদমতলী খাল। ৫০-৬০ ফুট প্রস্থ ও ১ দশমিক ২৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এ জলাশয়ের উৎসমুখ শ্যামপুরে আর পতন কদমতলীতে। যদিও সেখানে গিয়ে এ খালের অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সর্বশেষ প্রকাশিত (২০১৯) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রাস্তা নির্মাণের ফলে সেটি ভরাট হয়ে যায়। পার্শ্ববর্তী তিতাস, জিয়া সরণিসহ অন্যান্য খালও দখল আর দূষণে বিপর্যস্ত। পরিণত হয়েছে ছোট নালায়।

পরিবেশবিদরা বলছেন, খালের সীমানা নির্ধারণ না থাকায় সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও এসব খাল ভরাট হয়েছে। এর ফলে বুড়িগঙ্গার প্রাণ-প্রকৃতি যেমন বিপর্যস্ত হয়েছে তেমনি নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে ঢাকার বাসযোগ্যতায়। তাই দ্রুত সীমানা নির্ধারণ করা না হলে বিদ্যমান খালগুলোও দখল হওয়ার আশঙ্কা করেছেন তারা।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন একটি প্রকল্পের আওতায় ৪৮টি নদী সমীক্ষা করেছে। সেই সমীক্ষা শিগগিরই প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ হবে বলে সংস্থা সূত্রে জানা গেছে। তবে প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, এ সমীক্ষায়ও বুড়িগঙ্গা নদীর ১৯টি শাখা খালের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১১টির এখন আর কোনো অস্তিত্বই নেই। ভরাট হওয়া খালের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটির পাঁচটি, কেরানীগঞ্জ উপজেলার পাঁচটি ও নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার একটি খাল রয়েছে।

বুড়িগঙ্গাসহ বিভিন্ন খাল-বিল-নদী ভরাট ও দখলের বিষয়টি দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সদস্য মালিক ফিদা আব্দুল্লাহ খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দখল হয়ে যাওয়া খালগুলো উদ্ধারে তৎপর হওয়ার জন্য আমরা বারবার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বলে আসছি। কেননা ঢাকার জলাবদ্ধতা ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় এগুলো উদ্ধারের কোনো বিকল্প নেই। শুধু বুড়িগঙ্গার খালই নয়, আমরা মনে করি, যেকোনো প্রাকৃতিক খাল ভরাট হয়ে গেলে সেটি উদ্ধার করে প্রবাহিত করতে হবে। তবে নদী রক্ষা কমিশনের যেহেতু অ্যাকশনের ক্ষমতা নেই তাই আমরা শুধু সুপারিশ করে যাচ্ছি। আশা করছি, সংশ্লিষ্টরা দ্রুত এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটির ভরাট হওয়া পাঁচটি খালের মধ্যে রয়েছে শ্যামপুর খাল, সূত্রাপুর খাল, কামরাঙ্গীরচর খাল, হাইক্কার খাল ও শ্রীখণ্ড খাল। এ খালগুলো বয়ে চলা এলাকার জলাবদ্ধতা ও বুড়িগঙ্গার জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। কিন্তু ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে এলাকাবাসীকে দীর্ঘমেয়াদি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। সরজমিনে শ্যামপুর-কদমতলী এলাকায় দেখা যায়, খালের একাংশে বিশাল রাস্তা হয়েছে। অন্য অংশে উঠেছে বাড়িঘর। পার্শ্ববর্তী খালগুলোও আবর্জনার স্তূপপূর্ণ।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শ্যামপুর খালটি দিয়ে পোস্তগোলা, জুরাইন, শ্যামপুর, পাগলা এলাকার পানি বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ত। কিন্তু খালটি না থাকায় শ্যামপুরের পানি দুই কিলোমিটার কাছের বুড়িগঙ্গায় গিয়ে না পড়ে এখন ড্রেন দিয়ে ২০ কিলোমিটার দূরের শীতলক্ষ্যা নদীতে যাচ্ছে। ফলে পাগলা, শ্যামপুর, ডেমরা, সাইনবোর্ড এলাকার মানুষকে দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতায় ভুগতে হয় অল্প বৃষ্টিতেও।

স্বল্প সময়ের মধ্যেই একে একে পাঁচ খাল ভরাট হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুর) মো. খায়রুল বাকের বলেন, ‘দীর্ঘদিন খালগুলো ঢাকা ওয়াসার তত্ত্বাবধানে ছিল। আমরা খালের দায়িত্ব পেয়েছি দুই বছর হলো। এ সময়ের মধ্যে বুড়িগঙ্গা আদি চ্যানেলকে আমরা সচল করেছি। সেখানে অনেক স্লুইসগেট বন্ধ ছিল, সেগুলোও সচল করেছি। খালের সীমানা নির্ধারণের কাজ শুরু করেছি। ক্রমান্বয়ে সিএস ম্যাপ দেখে ভরাট হওয়া খালগুলো উদ্ধার করা হবে।’

ঢাকার পর সবচেয়ে বেশি খাল ভরাট হয়েছে কেরানীগঞ্জে, পাঁচটি। সেগুলো হলো শাক্তা ইউনিয়নের ঝাউচর খাল, আগানগর ইউনিয়নের ওয়াপদার খাল, শুভাঢ্যা ইউনিয়নের হাসনাবাদ খাল, কোন্ডা ইউনিয়নের বসুন্ধরা বন্ধ খাল ও মুগদা খাল। এ খালগুলোও ভরাট হয়েছে ব্যক্তি ও সরকারি উদ্যোগে। কোনো কোনো খালের ওপর গড়ে উঠেছে একাধিক আবাসন প্রকল্প।

দেশের নদ-নদী ও খাল-জলাভূমি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মো. এজাজ। তিনি বলেন, ‘এসব খালে একসময় মাছ ছিল। নৌকা চলত। ঢাকা ও বুড়িগঙ্গার প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় খালের ভূমিকা এখন সবাই অনুভব করছে। খালগুলো টিকে থাকলে ঢাকার বাসযোগ্যতার প্যারামিটার আরো শক্তিশালী হতো কোনো সন্দেহ নেই।’

পাঁচ বছরের মাথায় বুড়িঙ্গার শাখা খালগুলো ভরাট হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘খালগুলোর সীমানা নির্ধারণ না করার ফলে যে যেভাবে পেরেছে দেদার ভরাট করেছে। তাই আমাদের দাবি থাকবে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর যেন দ্রুত সিএস ম্যাপ অনুযায়ী বিদ্যমান ও হারিয়ে যাওয়া খালের সীমানা নির্ধারণ করে দেয়। পাশাপাশি ভরাট হওয়া খালগুলো দ্রুত উদ্ধারেরও পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানচ্ছি।’

বুড়িগঙ্গার দুটি শাখা খাল নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলায় পড়েছে। এর মধ্যে একটি ফতুল্লা ইউনিয়নের ডিএনডি খাল। অন্যটি এনায়েতনগর ইউনিয়নের ফাজিলপুর ও গোয়ালবাড়ি খাল। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রকাশিতব্য প্রবিদেন অনুযায়ী ফাজিলপুর ও গোয়ালবাড়ি খালটি ভরাট হয়ে গেছে।

৪৮ নদী সমীক্ষা প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক এনভায়রমেন্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ স্পেশালিস্ট মনির হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা নদীগুলোর সমীক্ষা করতে গিয়ে শাখা খালগুলো নিয়েও বিস্তারিত স্টাডি করেছি। সেখানে দেখেছি বুড়িগঙ্গা নদীর ১৯টি শাখা খালের মধ্যে ১১টিই ভরাট হয়েছে। এর কোনোটি সিটি করপোরেশন ভরাট করেছে, কোনোটি ভরাট করেছে ওয়সা। এছাড়া ঢাকার বাইরে কোনো কোনো খাল আবাসন প্রকল্পের মাধ্যমে ভরাট করা হয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরাও ভরাট করেছে অনেক খাল। কোনো খাল যখন ভরাট হয়, তখন সিটি করপোরেশন, রাজউক সংশ্লিষ্টরা অ্যাকশন নেয় না। ভরাট হওয়ার পর বলে কিছু করার নেই। অথবা রাষ্ট্রের টাকা অপচয় করে সেটা আবার উচ্ছেদ করে। এখনো ঢাকায় অনেক খাল ভরাট হচ্ছে। আমাদের চোখে যেমন পড়ছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চোখেও তো পড়ছে। তাহলে তারা দেখেও না দেখার ভান করছেন কী কারণে? নিশ্চয় এখানে অবৈধ কোনো লেনদেন আছে। নয়তো চুপ থাকার তো কথা নয়।’

সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময়ে ঢাকার খাল নিয়ে বিভিন্ন তথ্য পেয়েছি। বেশির ভাগ সরকারি কাগজে খালের সংখ্যা ৪৩ দেখেছি। কোনো কাগজে আমরা ৫২টারও উল্লেখ পেয়েছি। এ খালগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে গেছে, এগুলো ২০ বছর ধরেই আলোচনা হচ্ছে। সে পরিপ্রেক্ষিতে মাত্র গত পাঁচ বছরে নতুন করে আবার খাল হারিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। যখন থেকে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তখন থেকেই যদি এগুলোর ব্যাপারে আমরা মনোনিবেশ করতাম, তাহলে এ খালগুলোকে অন্তত বাঁচানো সম্ভব হতো। আশা করব, আর কালক্ষেপণ না করে সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগী হবে।’