নিজস্ব প্রতিবেদক :
বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে জিয়া উদ্যানে তার স্বামী, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে দাফনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) সকাল ৬টায় বিএনপি চেয়ারপারসন ও তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
এদিন সকালে পরিবার ও দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, খালেদা জিয়ার জানাজা আগামী বুধবার ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে অনুষ্ঠিত হবে।
জানাজার পর তাকে সংসদ ভবন এলাকায় অবস্থিত জিয়া উদ্যানে দাফন করা হতে পারে। সেখানে তার স্বামী ও বাংলাদেশের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবর অবস্থিত।
মৃত্যুর সময় বেগম খালেদা জিয়ার শয্যাপাশে ছিলেন তার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এসময় হাসপাতালে আরো উপস্থিত ছিলেন তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান, মেয়ে জাইমা রহমান এবং প্রয়াত ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শার্মিলী রহমান সিঁথি।
স্বজনদের মধ্যে ছোট ভাই শামীম এসকান্দার ও তার স্ত্রী, বড় বোন সেলিনা ইসলামসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকেরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
বেগম খালেদা জিয়া গত ২৩ নভেম্বর থেকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। হাসপাতালটির আইসিইউতে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার অবস্থা অত্যন্ত জটিল এবং তিনি সংকটময় মুহূর্ত পার করছিলেন বলে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন জানিয়েছিলেন।
বেগম খালেদা জিয়া ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ইস্কান্দার মজুমদার ও মা তৈয়বা মজুমদার। শৈশবে তিনি দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং পরবর্তীতে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৯৬০ সালে তিনি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন তিনি ফার্স্ট লেডি হিসেবে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন।
১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদতবরণের পর দলের সংকটময় মুহূর্তে তিনি রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়। এরপর ১৯৮৩ সালে তিনি দলের ভাইস-চেয়ারম্যান এবং ১৯৮৪ সালে চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।
আশির দশকে তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। আপসহীন সংগ্রামের কারণে তিনি ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। এই দীর্ঘ আন্দোলনে তিনি সাত দলীয় জোট গঠন করেন এবং স্বৈরাচারের পতন না হওয়া পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার দৃঢ় ঘোষণা দেন। এই দীর্ঘ লড়াইয়ে তাকে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সাতবার আটক ও গৃহবন্দী করা হয়েছিল।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়লাভ করে তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তার সময়েই দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি শিক্ষা খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন; যার মধ্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, মেয়েদের জন্য দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা এবং উপবৃত্তি কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া তিনি সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ থেকে ৩০ বছরে উন্নীত করেন।
১৯৯৬ সালের জুন মাসের নির্বাচনে বিএনপি পরাজিত হলেও তিনি ১১৬টি আসন নিয়ে সংসদে বৃহত্তম বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি চারদলীয় জোট গঠন করেন এবং ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় নিয়ে আবারও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ২০০৫ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন তাকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় ২৯ নম্বরে স্থান দেয়।
বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসে কোনো আসনেই পরাজিত না হওয়ার অনন্য রেকর্ডের অধিকারী। তিনি ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনে যে কয়টি আসনে দাঁড়িয়েছেন, তার সবকটিতেই জয়লাভ করেছেন। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি স্টেট সিনেট গণতন্ত্রের প্রতি তার অবদানের জন্য তাঁকে ‘গণতন্ত্রের যোদ্ধা’ উপাধিতে ভূষিত করে।
২০১৮ সালে একটি বিতর্কিত মামলার রায়ে তাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। যদিও আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। পরে ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে একে একে সব মামলায় খালাস পান বিএনপি চেয়ারপারসন।
নিজস্ব প্রতিবেদক 




















