নিজস্ব প্রতিবেদক :
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জুলাই হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। গণহত্যায় জড়িত শেখ হাসিনাসহ আসামিদের বিচার না হলে জুলাই শহীদ-আহতদের ওপর অবিচার করা হবে।
বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিন জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে যুক্তি উপস্থাপনকালে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করেছিলাম, শেখ হাসিনা ন্যায়বিচারের মুখোমুখি হবেন। কারণ তিনি অন্যের উদ্দেশে বলেছিলেন, সাহস থাকলে বিচারের মুখোমুখি হন। কিন্তু তিনি এই কথা মন থেকে বলেননি। বললে আজ দেশের মাটিতে এসে বিচারের মুখোমুখি হতেন।
মো. আসাদুজ্জামান বলেন, এই আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে বাংলাদেশের আরও অগণিত মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে না পারলে বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ভীরু-কাপুরুষ হয়ে রয়ে যাবে। আমি তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করছি।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বাংলাদেশকে সভ্যতার সোপানে নিয়ে যেতে আজ দাঁড়িয়েছি। এই ন্যায় বিচার যদি আমরা না করতে পারি, তাহলে আমরা বাংলাদেশে মানুষ হিসেবে- কবি হেলাল হাফিজের ভাষায় “উত্তর পুরুষের ভীরু কাপুরুষ হয়ে রয়ে যাব”।
তিনি বলেন, যে এভিডেন্স (প্রমাণ) আপনাদের সামনে এসেছে, তা বিশ্বের যেকোনো দেশের যেকোনো আদালতে যেকোনো সাক্ষ্য আইনের সামনে উপস্থাপন করলে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে এই আসামীদের সাজা প্রদান ছাড়া বিকল্প কোনো পথা থাকে না।
সাহস থাকলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ন্যায়বিচারের মুখোমুখি হতেন উল্লেখ করে মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কোনো শাসক-শোষক বা ফ্যাসিস্টকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আমি প্রত্যাশা করেছিলাম তিনি ন্যায়বিচারের সামনে আসবেন। ক্ষমতায় থাকতে তিনি আরেকজন রাজনৈতিক নেতাকে বলেছিলেন সাহস থাকলে বাংলাদেশের মাটিতে এসে বিচারের মুখোমুখি হোক। আমার বিশ্বাস ছিল এ কথাটা মন থেকে বলেছিলেন। এটা বিশ্বাস করে বলেছিলেন। কিন্তু দেখলাম তিনি মন থেকে বলেননি। তার যদি সাহস থাকতো তাহলে বাংলাদেশের মাটিতে এসে এই বিচারের মুখোমুখি হতেন।
পবিত্র কোরআনের সুরা নিসাসহ দুটি সুরার আয়াতের রেফারেন্স টেনে আনেন অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি বলেন, আজ আমি ন্যায়বিচার প্রত্যক্ষ ও সাক্ষী হতে এসেছি। এ মামলায় সব ধরনের দালিলিক-মৌখিক প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন প্রসিকিউশন পক্ষ। তবে আসামিরা কোনো নির্দেশ দেননি, বলেননি যুক্তি দেখিয়েছেন স্টেট ডিফেন্স। ভাগ্যিস বলেননি এ দেশে কোনো জুলাই রেভ্যুলেশন হয়নি, কেউ মারা যাননি কিংবা আহত হননি। অথচ বাংলাদেশে ১৪০০ মানুষ মারা গেলেন। এত বড় একটা জুলাই রেভ্যুলেশন হলো। হত্যাকাণ্ড হলো সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় স্টেট অ্যাপারেটাস (রাষ্ট্রযন্ত্র) ব্যবহার করে।
একপর্যায়ে তিনি বলেন, বিচার যত কঠিনই হোক যত বাধার প্রাচীর আসুক, সব বাধার প্রাচীর ভেঙে যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা না সম্ভব হয় তাহলে আমরা জাতি হিসেবে আগামী দিন এগোতে পারবো না। আমি একটা বিচারের মানদণ্ড তুলে ধরতে চাই। ১৯৫১ সালে মাত্র এক মাসের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করেছিলেন আমেরিকান আদালত। সেই বিচারের মুখোমুখি হয়েছিলেন জুলিয়াস রোজেনবার্গ ও ইথেল রোজেনবার্গ। এ দম্পতির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যারা দেশের বিরুদ্ধে অপরাধ করছে গুপ্তচর ভিত্তি করে যার কারণে কোরিয়াদ্বীপে লাখ লাখ নিরীহ মানুষ মারা গেছেন। তাদের বিচার প্রক্রিয়ায় আমেরিকার সিভিল সোসাইটি থেকে শুরু করে গোটা বিশ্ব জেগে উঠেছিল। সব নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীরা এর বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। খালাস দিতে বলেছিলেন। এই বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার অবস্থা গিয়েছিল। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে তাদেরও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। দুজন মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর অবশ্যই একটি বড় ঘটনা। আমরাও মনে করি নিশ্চয়ই এ আসামিদের মৃত্যুদণ্ড দাবি করা, মৃত্যুদণ্ড হওয়া, কার্যকর হওয়া।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ন্যায় শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে এই আসামিদের হাতে বাংলাদেশের অসংখ্য-অগণিত মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। তাদের হাতে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাবে। পাঁচ বছরের শিশু মারা যাবে। ১০ বছরের আনাস মারা যাবে। পানি বিতরণ করা অবস্থায় মুগ্ধ মারা যাবে। বুক চিতিয়ে আবার রাজপথে দাঁড়িয়ে আবু সাঈদরা মারা যাবেন। আমরা যদি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে না পারি বা এই দুজনের বিচার ব্যাহত হয় অথবা শাস্তি না হয় যেটা আইনে প্রেসক্রাইব করা আছে। তাহলে বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাসে একটি ভীরু কাপুরুষের উপমা হয়ে রয়ে যাবে। সেই কারণেই আমরা মনে করি এই বিচারে আমরা যা প্রমাণ করেছি সেটা বিয়ন্ড অল রিজনেবল ডাউট (এ নিয়ে কোনো যুক্তিসংগত সন্দেহ নেই)।
আসামিদের প্রতি আকাঙ্ক্ষা রেখে আসাদুজ্জামান বলেন, আমি প্রত্যাশা করি ন্যায়বিচারের মানদণ্ড নিশ্চিত করতে হলে এই আসামিরা বলবেন যেমন বলেছিলেন জুলিয়াস নিজের আইনজীবীর মাধ্যমে। তিনি গোটা বিশ্বকে জানিয়েছিলেন স্বাধীনতা ও অন্য যেসব জিনিস জীবনকে সত্যিই সুন্দর-স্বার্থক করে তোলে তা পাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে খুব বেশি মূল্য দিতে হয়। তারা হয়তো এমন একটি উক্তি দিয়েই এই বিচারের রায় মেনে নেবেন। অন্য কোনো পথ বেছে নেবেন না। অন্য কোনো পথে তারা হাঁটবেন না। যেন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাসযোগ্য ভূমি গড়ে তোলা যায়। সবশেষ ট্রাইব্যুনালের কাছে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ সাজা প্রার্থনা করেন দেশের এই সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা।
শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থাপনকালে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা প্রত্যাশা করছি। বিচার যত কঠিনই হোক, বাধার প্রাচীর ভেঙ্গে যদি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব না হয়, তাহলে জাতি হিসেবে আমরা আগামী দিনে এগুতে পারব না। এই আসামিদের মৃত্যুদণ্ড হওয়া, মৃত্যৃদণ্ডের মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা একটি বড় ঘটনা হিসেবে অনেকেই দেখবেন। এই আসামিদের যদি শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে তাদের হাতে বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন হবে।
মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ন্যায়বিচারের সাক্ষী হতে এসেছি। ১৪০০ লোক মারা গেছে। ৩০ হাজার পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। রাষ্ট্রপক্ষ দেখিয়েছে–কে নির্দেশ দিয়েছে, কাকে দিয়েছে, কে পালন করেছে, কীভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে। এই খুনের পর গোটা জাতি জেগে উঠেছে। অপরাধীরা পালিয়ে গেছে। তারা বিচারকাজ প্রতিহত করতে নানা রকম নির্দেশনা দিচ্ছে। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, প্রসিকিউশন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। যে সাক্ষ্য-প্রমাণ এসেছে, তা যেকোনো দেশে, যেকোনো আদালতে উপস্থাপন করলে আসামিদের সাজা ছাড়া বিকল্প কিছু হবে না।
মানবতাবিরোধী অপরাধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের উদাহরণ এসময় তুলে ধরেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
তিনি বলেন, এটা দিবালোকের ন্যায় সত্য, এখানে গণহত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে। এখানে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। কারা ঘটিয়েছে, কীভাবে ঘটিয়েছে-তা আমরা প্রমাণ করেছি। আমরা মনে করি, এই আদালতে যদি আসামিদের শাস্তি না হয়, তাহলে এদেশের খুন হওয়া মানুষ, পঙ্গুত্ব বরণ করা মানুষ, এই রাষ্ট্র অবিচারের শিকার হবে। আমরা দাঁড়িয়েছি ইতিহাসের দায় পরিশোধ করার জন্য। আপনারা ন্যায়বিচার করলে গোটা বিশ্ব দেখবে এই দেশে ন্যায় বিচার হয়।
এই মুহূর্তে শেখ হাসিনাসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে সর্বশেষ দিনের যুক্তিতর্ক তুলে ধরছে প্রসিকিউশন। এরপর রায়ের জন্য দিন ধার্য করবেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
এর আগে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলায় জুলাই আন্দোলনে শহীদ পরিবার, আহত, চিকিৎসকসহ ৫৪ জন সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্যে উঠে আসে– জুলাই গণহত্যা, নৃশংসতা, আওয়ামী লীগের আমলে গুম-খুনসহ নির্যাতনের নানা বিষয়।
এই মামলায় রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন জুলাই আগস্টের গণহত্যাকালীন পুলিশের আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি তুলে ধরেন গণহত্যার পেছনের ঘটনাও। উঠে আসে নির্দেশদাতা ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকাদের নাম।
প্রসিকিউশন বলছে, এখন পর্যন্ত যেসব সাক্ষ্য, প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে, তা দ্বারা পৃথিবীর যেকোনো আদালতে আসামিদের অপরাধ প্রমাণে যথেষ্ট।