নিজস্ব প্রতিবেদক :
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল ১৯৭১ সালে। কিন্তু শোষণ থেকে মুক্তি পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। এই স্বাধীনতা যেন কেউ হাইজ্যাক করে না নিতে পারে এজন্য বাংলার ১৮ কোটি মানুষকে পাহারা দিতে হবে।
সোমবার (১৬ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের উদ্যোগে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে পল্টন মোড়ে অনুষ্ঠিত সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
শেখ পরিবারকে উদ্দেশ করে জামায়াতের আমির বলেন, একটি পরিবার স্বাধীনতার ক্রেডিট হাইজ্যাক করে বাংলার আপামর জনতাকে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে উপস্থাপন করেছিল। একজন নাগরিকও যেন ভোটার তালিকা থেকে বাদ না পড়েন। এজন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারকে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। জনগণ জামায়াতকে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিলে দেশ বিগত দিনের মতো বিক্রি হবে না।
জিয়াকে স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি কেন প্রশ্ন রেখে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, স্বাধীনতা ছিনতাই করে এক পরিবারের সম্পদ বানানো হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান কবে, কোথায় স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছে সেটি এদেশের কারো জানা নেই। ৭ মার্চ যদি শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রামে ডাক দিয়ে থাকেন, তাহলে ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে শেখ মুজিবুর রহমান নিজের বাসভবনে কেন পাকিস্তানের পতাকা ঝুলিয়েছে? তৎকালীন ছাত্ররা সেই পতাকা খুলে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ঝুলিয়ে দিয়েছিল।
তিনি বলেন, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিক্রি করে দিয়েছে, তারাই দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। তারা যে দেশের আদর্শ ধারণ ও লালন করে সেই দেশেই চলে গিয়েছে। শেখ হাসিনা এদেশে ফিরে এসেছে শুধুমাত্র তার বাবার হত্যার প্রতিশোধ নিয়ে ভারতের কাছে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ক্ষমতার বিনিময়ে বন্ধক দিতে। তার বাবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বেরিয়ে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদের যাত্রা শুরু করার কারণে স্বাধীনতার সপক্ষের সেনা সদস্যরা তাকে হত্যা করেছে। তার মেয়েও পরবর্তীতে ভারতের তাঁবেদারি করতে এদেশের আলেম-ওলামা, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক সাধারণ জনগণকে হত্যা করছে।
জামায়াতের আমির বলেন, এই পল্টন ময়দানে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষকে সাপের মতো পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ আবু সাঈদের বক্তব্য ছিল ‘বুকের ভিতর তুমুল ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’ এই তুমুল ঝড় এদেশের ১৮ কোটি জনগণের বুকের ভিতরের ঝড়। জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সকল হত্যাকাণ্ডের সঠিক তদন্ত ও ন্যায়বিচার করবে। দেশকে কারও তাঁবেদার বানাতে দেওয়া হবে না।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ সাক্ষী, এই বিশ্ব সাক্ষী আমরা অন্যায়ের কাছে মাথা নত করিনি, করবোও না। আমরা প্রিয় দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব কোনো আগ্রাসীদের কাছে, কোনো হেজিমোনিস্টদের কাছে বিক্রি করবো না, করতেও দেবো না।
তিনি বলেন, যারা বিক্রি করেছিল আজকে তারা পালিয়ে গিয়ে ওখানেই আশ্রয় নিয়েছে। তারা এই দেশকে নিজের দেশ মনে করতো না। কারণ এই দেশে তাদের বাচ্চা-কাচ্চা বসবাস করতো না। তাদের বাচ্চাদের নিরবে অন্য দেশে পাঠিয়ে দিয়ে তারা সন্ত্রাস-ত্রাসের মাধ্যমে এই দেশকে শোষণ করেছিল।
জামায়াতের আমির বলেন, তারা (আওয়ামী লীগ) মূলত প্রতিশোধ নিতে এসেছিল, আপনারা জানেন কীসের প্রতিশোধ। আমি জিজ্ঞেস করি সেদিন আপনার বাবাকে কারা হত্যা করেছিল? যারা একাত্তরের রণাঙ্গনে বুক চিতিয়ে যুদ্ধ করেছিল তাদের হাতে আপনার বাবাকে নিহত হতে হবে কেন? আপনারাই জবাব খুঁজেন। এরজন্য দায়ী কারা? কারা সেদিন ব্যাকফুটে ছিল? কারা সেদিন নব্য সৃষ্টি হওয়া বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুঁড়িতে পরিণত করেছিল। কাদের নেতা বলেছিল, ডানে যেদিক তাকাই তারা চোর, বামে যেদিক তাকাই তারাও চোর। সামনে যেদিকে তাকাই ওরাও চোর, পেছনে যেদিকে তাকাই ওরাও চোর। কাদের উদ্দেশ করে বলেছিলেন? সেই জবাব আজকে তাদের খুঁজতে হবে। কাজেই প্রতিশোধ জনগণের ওপর নয়, প্রতিশোধ নেন আপনাদের অপকর্মকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর।
তিনি বলেন, আশ্চর্য লাগে তারা (আওয়ামী লীগ) বাংলাদেশটাকে টুকরা টুকরা করে বিভক্ত করে হিংসার রাজত্ব কায়েম করে পালিয়ে গিয়ে এখনো বাংলাদেশকে তারা স্থির থাকতে দেন না। তারা মাঝে-মধ্যেই ফণা তুলে ফুসফাস করার চেষ্টা করে। যেই জাতি আপনাদের উচিত শিক্ষা দিয়ে তাড়াতে পেরেছে সেই জাতি আপনাদের ফণাও একদম গুড়া করে দিতে পারে। এটা মনে রাখবেন, এই দেশে যোদ্ধা দুই লাখ চার লাখ নয়। এই দেশে যোদ্ধা মিনিমাম দশ কোটি। এই দশ কোটি যোদ্ধার বিশ কোটি হাত সদা প্রস্তুত যেকোনো ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার জন্যে। আমরা আল্লাহ তায়ালার সাহায্য চাই আমরা যেন অন্যায় এবং অসত্যের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই করতে পারি। প্রিয় দেশবাসী আসুন আজকে আমরা আরেকবার অঙিকার করি এই বিজয় দিবসে আমরা অবশ্যই দেশকে ভালোবাসবো, আমরা কারো তাঁবেদার বানাতে এই দেশকে দেব না এবং কেউ তাঁবেদারি করতে এলে তাকেও আমরা ছাড় দেবো না।
শফিকুর রহমান বলেন, আমরা জাতি হিসেবে কৃতজ্ঞ জাতি। কিন্তু একটি পরিবার সে কৃতজ্ঞতাকে নষ্ট করে দিয়েছিল। স্বাধীনতার সমস্ত অর্জন ধূলিসাৎ করে সে পরিবারের সম্পত্তিতে পরিণত করা হয়েছিল। বাংলাদেশকে তারা তাদের জমিদারি মনে করে নিয়েছিল। জনগণকে তারা তাদের প্রজা ও ভাড়াটিয়া বানিয়েছিল। আমাদের সন্তানদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছিল। তারা একটি ক্যাডারভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। আজকের এমন একটি বিজয় দিবস বাংলাদেশের মানুষের মাথায় মাথায় লাল সবুজের একেকটি খুঁটি। সবুজ হচ্ছে আমাদের শ্রমিক ও জমিন, আর লাল হচ্ছে শহীদ ভাইদের রক্ত। এই রক্ত দেওয়া কিন্তু শুরু হয়েছিল ৪৭ সাল থেকেই। সে রক্ত দেওয়ার ধারা অব্যাহত রয়েছে ২৪ এর আগস্ট পর্যন্তও।
তিনি বলেন, কিন্তু দুঃখের বিষয়, ৪৭ এর পরেও জাতি স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারেনি। আবার ৭১ এর পরেও জাতির স্বাধীনতা হাইজ্যাক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জাতির সামনে এর কোনো জবাব দেওয়া হয়নি। স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া শহীদ জিয়াউর রহমানকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সেই পরিবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে জাতিকে শোষণ করেছে, ধোঁকা দিয়েছে, জুলুম করেছে, অধিকার কেড়ে নিয়েছে। জাতিকে দাসে পরিণত করেছিল।
জামায়াতের শীর্ষ এই নেতা বলেন, ৭২ এর পর জনগণের হাতে সত্যিকারের স্বাধীনতা তুলে দেওয়ার যে সংগ্রাম হয়েছিল, তা শেষ হয়েছে ২৪ এর আগস্টে। এই ২৪ এর লড়াইয়েও জনগণকে নিজ দেশের স্বৈরশাসকের কাছে জবাব দিতে হয়েছে। তারা জনগণকে পাত্তাই দেয়নি। মাটি থেকে, আকাশ থেকে গুলি করে জনগণের বুক ঝাঁজরা করে দেওয়া হয়েছে। এই লড়াইয়ের প্রতীক ছিল শহীদ আবু সায়ীদ। হাতের মধ্যে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না, কোনো বোমা ছিল না। খালি হাতে শুধু একটি লাঠি নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল। সে বলেছিল বুকের ভেতর তুমুল ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর। সেই ঝড় কী শুধু তার ছিল? না। অধিকার কেড়ে নিয়ে জনগণকে দাসে পরিণত করার ঝড় তার বুকের মধ্যে ছিল। মানুষের ঝড়।
তিনি বলেন, এত রক্ত,এতো ত্যাগের পর এটাকে বলা হচ্ছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা। স্বাধীনতার প্রতি সম্মান দেখানো আমাদের জাতীয় ও নাগরিক দায়িত্ব। যারা বিদায় নিয়েছে তারাও আমাদের জাতীয় বীর। দেশের বাইরে যারা শহীদ হয়েছে তারাও আমাদের জাতীয় বীর। জাতীয় বীরদের উচ্চ শিখরে রেখে সম্মান জানাতে চাই। তাদের অবদান যেন কোনো গোষ্ঠী, পরিবার, দলের লোলুপ দৃষ্টির সামনে হারিয়ে না যায়। সুতরাং এই বিজয়, অবদানকে পাহারা দিতে হবে।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির মো. নূরুল ইসলাম বুলবুলের সভাপতিত্বে এবং কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারী ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদের পরিচালনা পল্টন মোড়ে অনুষ্ঠিত মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে সমাবেশ রূপ নেয় জনসমুদ্রে। সকাল ১০টায় সমাবেশ শুরুর নির্ধারিত সময়ের আগেই পল্টন মোড় থেকে কাকরাইল মোড় পর্যন্ত বিজয় সমাবেশে উপস্থিত নেতাকর্মী ও জনসাধারণের অংশগ্রহণে মুখরিত হয়ে ওঠে।