Dhaka রবিবার, ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

স্ত্রীর কিডনিতে নতুন জীবন পাচ্ছেন জহিরুল

নেত্রকোনা জেলা প্রতিনিধি

বছর দেড়েক আগে মাথা ঝিমঝিম, উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন নেত্রকোনার জহিরুল হক জুনাইদ (৩৯)। পরীক্ষা-নিরীক্ষার একপর্যায়ে ধরা পড়ে তার দুটি কিডনিই বিকল। এখানে-সেখানে খোঁজ করে যখন কিডনি মিলছিল না তখন স্ত্রী সায়মা জাহান পলি (২৭) নিজের একটি কিডনি দিতে এগিয়ে আসেন। তার দেওয়া কিডনিতে এখন সুস্থ হয়ে উঠছেন জহিরুল হক। ঘটনাটি এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।

এ দম্পতি বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের সপ্তম তলায় চিকিৎসা নিচ্ছেন।

জহিরুল হকের বাড়ি জেলার পূর্বধলা উপজেলার হিরণপুর বাজার এলাকায়। তিনি ওই এলাকার মো. মোজাম্মেলন হক ও জয়নব আক্তার দম্পতির পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার বড়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা জহিরুল একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। তার স্ত্রী সায়মা জাহান নেত্রকোনা সরকারি কলেজ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পাশ করেছেন। জহিরুল ও সাইমা দম্পতির জুনাইনা জান্নাত রাইসা নামের পাঁচ বছরের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ছয় বছর আগে আটপাড়া উপজেলার পাঁচগজ গ্রামের সায়মা জাহানের সঙ্গে জহিরুল হকের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তারা একসঙ্গে ঢাকায় থাকতেন। গত বছরের ২৭ মে জহিরুল ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আসেন। ওই দিন উচ্চ রক্তচাপসহ তার শারীরিক পরিস্থিতি খারাপ অনুভব হলে স্বজনরা নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান স্বজনরা। জরুরি বিভাগের চিকিৎসক পরীক্ষা করে দেখেন তার ব্লাড প্রেসার (বিপি) ৩০০ বাই ২৪০। চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার কিডনি রোগ ধরা পড়ে। ময়মনসিংহ ও ঢাকায় বিভিন্ন স্থানে তিনি চিকিৎসা নেন। এরপর সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে তিনি ডায়ালাইসিস করতে থাকেন। কিন্তু শারীরিক পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছিল।

মাসখানেক আগে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসক জানান, তার দুটি কিডনি অচল হয়ে গেছে। রোগীকে বাঁচাতে হলে কমপক্ষে একটি কিডনির প্রয়োজন। এরপর বিভিন্ন কিডনি ব্যাংকে যোগাযোগ করেও কিডনি সংগ্রহ করতে পারেননি। এতে পরিবারের লোকজন হতাশ হয়ে পড়েন। পরীক্ষায় জহিরুলের সঙ্গে স্ত্রী সায়মার কিডনি মিলে যায়। এ অবস্থায় স্বামীকে বাঁচাতে সায়মা জাহান নিজের একটি কিডনি দেন। গত ৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচার করা হয়। বর্তমানে হাসপাতালের সপ্তম তলায় নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে কেটে (আইসিসিইউ) চিকিৎসাধীন রয়েছেন জহিরুল। আর সায়মা জাহানকে গত শনিবার হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি রামপুরা এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় কোয়ারেন্টাইনে আছেন।

জহিরুলের ছোট ভাই পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) আশিকুল হক বলেন, ভাবি এখন কিছুটা সুস্থ। চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছেন। ভাইয়ের অবস্থাও ভালোর দিকে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা কমলে তাঁকেও হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে।

ভাবির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমরা ভাই হয়ে যা পারিনি, ভাবি পেরেছেন। তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই। সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করি, উভয়েই যেন সুস্থ হয়ে ওঠেন। আপনারাও দোয়া করবেন।

কিডনি প্রতিস্থাপনের আগে জহিরুলের স্ত্রী সায়মা জাহান নিজের ফেসবুক আইডি থেকে বেশ কয়েকটি ছবি ও ভিডিও পোস্ট দেন। ৫ সেপ্টেম্বর সকালে অস্ত্রোপচার কক্ষে নেওয়ার আগের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি হেসে হেসে হাত নাড়ছেন। ছোট্ট মেয়েকে কাছে টেনে চুমু খাচ্ছেন। গতকাল হাসপাতাল ছাড়ার আগে স্বামীর কাছে বসা আরেকটি ভিডিও পোস্ট করেন সায়মা। সেখানে তিনি বলেন, ‘আপনারা জানতে চেয়েছেন, আমরা কেমন আছি। আমরা এখন অনেক ভালো আছি। আপনাদের দোয়ায় আমরা ভালোর দিকে।’

জানতে চাইলে সায়মা জাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বামীকে নিজের কিডনি দিতে পেরে আমি গর্বিত। তিনি (স্বামী) কখনো বলেননি, আমি নিজের ইচ্ছায় কিডনি দিয়েছি। তিনি সুস্থতার দিকে যাচ্ছেন, এটা দেখে খুবই ভালো লাগছে। এখন বাঁচলে দুজনে বাঁচব, মরলে দুজনে মরব।

পূর্বধলার নারানদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল কুদ্দুস ব্যাপারী বলেন, গৃহবধূ সায়মা নিজের কিডনি স্বামীকে দিয়ে এলাকায় প্রশংসায় ভাসছেন। এটি সত্যিই বিরল উদাহরণ। তাঁরা উভয়ই দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

জনপ্রিয় খবর

আবহাওয়া

মানিকগঞ্জে জরাজীর্ণ বেইলি ব্রিজে দুর্ঘটনার শঙ্কা

স্ত্রীর কিডনিতে নতুন জীবন পাচ্ছেন জহিরুল

প্রকাশের সময় : ০২:০৪:৪১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩

নেত্রকোনা জেলা প্রতিনিধি

বছর দেড়েক আগে মাথা ঝিমঝিম, উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন নেত্রকোনার জহিরুল হক জুনাইদ (৩৯)। পরীক্ষা-নিরীক্ষার একপর্যায়ে ধরা পড়ে তার দুটি কিডনিই বিকল। এখানে-সেখানে খোঁজ করে যখন কিডনি মিলছিল না তখন স্ত্রী সায়মা জাহান পলি (২৭) নিজের একটি কিডনি দিতে এগিয়ে আসেন। তার দেওয়া কিডনিতে এখন সুস্থ হয়ে উঠছেন জহিরুল হক। ঘটনাটি এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।

এ দম্পতি বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের সপ্তম তলায় চিকিৎসা নিচ্ছেন।

জহিরুল হকের বাড়ি জেলার পূর্বধলা উপজেলার হিরণপুর বাজার এলাকায়। তিনি ওই এলাকার মো. মোজাম্মেলন হক ও জয়নব আক্তার দম্পতির পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার বড়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা জহিরুল একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। তার স্ত্রী সায়মা জাহান নেত্রকোনা সরকারি কলেজ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পাশ করেছেন। জহিরুল ও সাইমা দম্পতির জুনাইনা জান্নাত রাইসা নামের পাঁচ বছরের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ছয় বছর আগে আটপাড়া উপজেলার পাঁচগজ গ্রামের সায়মা জাহানের সঙ্গে জহিরুল হকের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তারা একসঙ্গে ঢাকায় থাকতেন। গত বছরের ২৭ মে জহিরুল ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আসেন। ওই দিন উচ্চ রক্তচাপসহ তার শারীরিক পরিস্থিতি খারাপ অনুভব হলে স্বজনরা নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান স্বজনরা। জরুরি বিভাগের চিকিৎসক পরীক্ষা করে দেখেন তার ব্লাড প্রেসার (বিপি) ৩০০ বাই ২৪০। চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার কিডনি রোগ ধরা পড়ে। ময়মনসিংহ ও ঢাকায় বিভিন্ন স্থানে তিনি চিকিৎসা নেন। এরপর সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে তিনি ডায়ালাইসিস করতে থাকেন। কিন্তু শারীরিক পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছিল।

মাসখানেক আগে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসক জানান, তার দুটি কিডনি অচল হয়ে গেছে। রোগীকে বাঁচাতে হলে কমপক্ষে একটি কিডনির প্রয়োজন। এরপর বিভিন্ন কিডনি ব্যাংকে যোগাযোগ করেও কিডনি সংগ্রহ করতে পারেননি। এতে পরিবারের লোকজন হতাশ হয়ে পড়েন। পরীক্ষায় জহিরুলের সঙ্গে স্ত্রী সায়মার কিডনি মিলে যায়। এ অবস্থায় স্বামীকে বাঁচাতে সায়মা জাহান নিজের একটি কিডনি দেন। গত ৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচার করা হয়। বর্তমানে হাসপাতালের সপ্তম তলায় নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে কেটে (আইসিসিইউ) চিকিৎসাধীন রয়েছেন জহিরুল। আর সায়মা জাহানকে গত শনিবার হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি রামপুরা এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় কোয়ারেন্টাইনে আছেন।

জহিরুলের ছোট ভাই পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) আশিকুল হক বলেন, ভাবি এখন কিছুটা সুস্থ। চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছেন। ভাইয়ের অবস্থাও ভালোর দিকে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা কমলে তাঁকেও হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে।

ভাবির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমরা ভাই হয়ে যা পারিনি, ভাবি পেরেছেন। তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই। সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করি, উভয়েই যেন সুস্থ হয়ে ওঠেন। আপনারাও দোয়া করবেন।

কিডনি প্রতিস্থাপনের আগে জহিরুলের স্ত্রী সায়মা জাহান নিজের ফেসবুক আইডি থেকে বেশ কয়েকটি ছবি ও ভিডিও পোস্ট দেন। ৫ সেপ্টেম্বর সকালে অস্ত্রোপচার কক্ষে নেওয়ার আগের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি হেসে হেসে হাত নাড়ছেন। ছোট্ট মেয়েকে কাছে টেনে চুমু খাচ্ছেন। গতকাল হাসপাতাল ছাড়ার আগে স্বামীর কাছে বসা আরেকটি ভিডিও পোস্ট করেন সায়মা। সেখানে তিনি বলেন, ‘আপনারা জানতে চেয়েছেন, আমরা কেমন আছি। আমরা এখন অনেক ভালো আছি। আপনাদের দোয়ায় আমরা ভালোর দিকে।’

জানতে চাইলে সায়মা জাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বামীকে নিজের কিডনি দিতে পেরে আমি গর্বিত। তিনি (স্বামী) কখনো বলেননি, আমি নিজের ইচ্ছায় কিডনি দিয়েছি। তিনি সুস্থতার দিকে যাচ্ছেন, এটা দেখে খুবই ভালো লাগছে। এখন বাঁচলে দুজনে বাঁচব, মরলে দুজনে মরব।

পূর্বধলার নারানদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল কুদ্দুস ব্যাপারী বলেন, গৃহবধূ সায়মা নিজের কিডনি স্বামীকে দিয়ে এলাকায় প্রশংসায় ভাসছেন। এটি সত্যিই বিরল উদাহরণ। তাঁরা উভয়ই দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।